|
|
|
|
|
|
রবিবাসরীয় প্রবন্ধ ১... |
ডায়েরিরা |
একটা ছোট্ট মেয়ের ডায়েরি, তার বাবার ডায়েরি, মা’র ডায়েরি। হয়তো এই সময়ের
অনেকের ডায়েরিতে এমন এক দিন বহু দিন। লিখছেন অর্পিতা রায়চৌধুরী
|
তনয়া |
চাকরিটা দুম করে ছেড়েছি, তাই আজ পর্যন্ত রোজ কারুর না কারুর কাছে বকুনি খাই। কিন্তু কী করব? পুতুলের মতো ছোট মেয়েটার জীবনের একটা মুহূর্তও মিস করতে চাইনি। যাই, সে উঠল বলে, আমায় ছাড়া তার চলে না, ছ’বছর হয়েছে তার, পাকা পাকা কথায় আমরা সবাই হতভম্ব হয়ে যাই, খালি পটির সময় তার মনে হয়, ‘মাম্মা আমি তো ছোট! তুমি আমায় হেল্প করো না প্লিজ!’
সকালে সব গোলমাল করে ফেলি, মেয়ের স্কুলের ব্যাগে সব ঠিক করে দিলাম তো? জুতো ঠিক করে পরালাম তো? মোজাটা ভিজে নেই তো? ওরে আর এক বার রাইমটা বল বাবা! আন্টি বকবে যে! আর মেয়েটা খালি খিকখিক করে হাসবে! সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ওর বাবাও হেসে যাবে! বোঝে না, মা’দের কত চিন্তা থাকে। এ মা! আমি পুরো আমার মায়ের মতো কথা বলছি!
যাক, মেয়েটা স্কুলে চলে গেল। আমার যদি উপায় থাকত, মেয়েটার সঙ্গে স্কুলে ভর্তি হয়ে যেতাম, ওকে ছেড়ে এক মুহূর্তও থাকতে ভাল লাগে না। আর কী মজার সব কথা বলবে! ‘মাম্মা তুমি কিচ্ছু জানো না। মাম্মা আমার বেস্ট ফ্রেন্ড-এর কী সমস্যা!’ সত্যি বলছি, ‘সমস্যা!’ ছোট্ট মেয়েটা এই শব্দটাই ব্যবহার করে!
|
|
কিছুতেই ওকে বাড়ির গাড়িতে যেতে দিইনি, যাক সবার সঙ্গে। স্কুলবাসে স্কুলে যাক, মাটির কাছাকাছি থাক, সবার সঙ্গে মিলেমিশে বড় হোক। একটা ভাল মানুষ হোক! সবাইকে ভালবাসুক। তবে আমার বর আমাকে ভীষণ বকে, বলে দুনিয়াটা ভীষণ কঠিন, এ ভাবে সবাইকে নিয়ে চলার শিক্ষা না-দেওয়াই ভাল! কিন্তু আমি তো আছি, বুকে করে আগলাব, কোনও ঝড়কে আসতেই দেব না, কী নরম হাত-পা, মাঠে খেলতে নিয়ে গেলে আমি মুখে কিছু বলি না, কিন্তু একটা আঁচড়ে ওর ছোট্ট পা-টা লাল হয়ে যায়! আমি চেয়েও চোখের জল আটকাতে পারি না, বকা খাই। বর বলে, মেয়েকে আতুপুতু বানিয়ে ফেলব আমি!
আজ ভাগ্যি ওর বাবা ছিল সঙ্গে! মাঠে খেলতে নিয়ে গেছি, বলল, লুকোচুরি খেলবে। খেলছি, হঠাৎ চোখের নিমেষে মেয়েটা যেন উবে গেল! পাগলের মতো খুঁজছি, আমি এক দিকে, ওর বাবা আর এক দিকে, কোথাও নেই, সবাই মিলে গোটা মাঠ চষে ফেললাম, পাশের পাড়া সব দেখা হয়ে গেল, সন্ধে হয়ে আসছিল, আমি কেঁদে ফেলেছি, ওর বাবারও প্রায় একই অবস্থা! তার পর দেখি বিনি কাকিমার হাত ধরে মাঠে আসছে, ওঁর বাড়িতে ঢুকে চুপ করে জলের ট্যাঙ্কের পাশে লুকিয়ে বসেছিল! বিনি কাকিমা দেখতে পেয়ে দিয়ে গেলেন, মেয়েটা আমাকে কাঁদতে দেখে নিজেই হকচকিয়ে গেছে, তার পর ওর বাবা তো অনেক বোঝাল, আমি বোঝানোর অবস্থায় ছিলাম না, ওই মুহূর্তে আমি বুঝলাম, মেয়েকে ছাড়া আমার অস্তিত্বই নেই। |
সন্দীপ |
সময় নেই আর লেখার। আমার বস শালা এক নম্বরের...। ভাগ্যি আমার মেয়ে ছিল আমার জীবনে, এই চাকরি নয়তো আমায় নিংড়ে নিত। বউ বলল আজ মেয়ে বাড়ি ফিরে বলেছে, ‘আর পারি না!’ আমি দেখতেও পেলাম না, শুনতেও পেলাম না! কী ভয় করে ভেবে, এক দিন আমার মেয়েটারও বিয়ে হবে, কত দূর চলে যাবে! আমিও যাব ওর সঙ্গে, তত্ত্বে! কিংবা ঘরজামাই করব, জামাইকে বলেই দেব— আমার মেয়েকে বিয়ে করতে হলে বাড়িতে থাকতে হবে! এ কী লিখছি আমি! এ তো পুরো আমার বউ-এর সঙ্গে থাকার সাইড এফেক্ট! ছ’বছর বয়স! আর আমি ওর বিয়ের কথা ভাবছি?
বড্ড ভালবাসি ছোটুকে, বউয়ের মতো খালি চাকরিটা ছেড়ে সঙ্গে থাকতে পারি না। এত বার করে বলছি, মেয়েকে বাড়ির গাড়িটা করে পাঠাই, কিছুতেই বউ পাঠাতে দেবে না, ওই এক মাটির কাছাকাছি থাকা! শালা একটা চৌত্রিশ বছরের মেয়ে শুধু কনসেপ্ট নিয়ে বেঁচে আছে। বেশ করেছি টাকা রোজগার করি, আমার মেয়ে গাড়িতে যাবে, ঠান্ডা বাড়িতে থাকবে। আরে বাবা ভাল থাকবে! বউয়ের সঙ্গে ঝগড়াটাও করতে পারি না! ওর চুপ করে যাওয়া মুখটা দেখলে খারাপ লাগে।
তবে ওদের একটা সারপ্রাইজ দেব। মেয়ের স্কুলের ঠিক পাশেই একটা ফ্ল্যাট কিনেছি। ফ্ল্যাট থেকে নামবে আর স্কুলে পৌঁছে যাবে। বউ জানলা দিয়ে দিনরাত ওদের স্কুল দেখতে পাবে! ভাবছি, যে দিন বলব, কী করবে ওরা! |
তোড়া |
আমাকে রোজ সকালে উঠতে হয়, তার পর হিসি পায়। মা বলেছে হিসি না বলতে, তাই আমি বলি না। আমি বাথরুমে যাই, সব কিছু করি। ব্রাশ করি। মা আমাকে ভাত আর তার মধ্যে যে সবজিগুলো আমি খাই না, সেগুলো লুকিয়ে লুকিয়ে দিয়ে একটা পোলাও বানিয়ে দেয়। আমি সব বুঝি, তাও খেয়ে নিই। তার পর মা আমাকে রেডি করিয়ে দেয়, জুতো পরার সময় হাজার বার জুতোটা ঝাড়ে, যদি জুতোর ভেতরে পোকা থাকে! আমাকে কামড়ায়! আমি আর বাবাই হেসে মরে যাই। কিন্তু বাবাই বলে, আমার মা বেস্ট মা। আর আমি জানি, আমার মা, আমার বাবাই দুজনেই বেস্ট।
স্কুলে আমার বেস্ট ফ্রেন্ড আমাকে বলেছে, ওদের বাড়ি আমাকে যেতেই হবে, ওর ভীষণ দরকার। ওর একটা বড় টেডি আছে। সেটাকে ও সামলাতে পারছে না! কী বুদ্ধু! আমি বলেছি টেডিটাকে ওদের বারান্দায় দোলনায় রেখে দিতে। রাস্তা দেখবে, মন খারাপ ভাল হয়ে যাবে! এম্মা! মা দুধ নিয়ে এসেছে, এখুনি আমি বায়না করব আর আমাকে মা ভুলিয়ে ভুলিয়ে খাওয়াবে। দিয়াও আমাকে ভুলিয়ে দিতে পারে, কত্ত গল্প জানে! আমি নাকি এখনও সব গল্প জানি না, সব রাইম্স্ও না। কী যে বলে দিয়া আর মা! জানে না তো, আমাদের স্কুলের আন্টি সব পড়িয়ে দিয়েছে! ডাইরি দাঁড়াও, আবার পরে লিখব। |
|
আজ আইসপাইস-এর পর মা কী কাঁদছিল! বাবাই আমাকে বোঝাল, আমি যদি সত্যি হারিয়ে যাই, আমি তো আর একা একা বাড়ি যেতে পারব না, তখন বাবাই আর মা কী করবে? দিয়া, ঠাম্মা, বম্মা, জেঠু সবাই কষ্ট পাবে। আমিও কেঁদে ফেললাম। আমিও তো বাবাই-মা-দিয়া সবাইকে না দেখে থাকতেই পারব না। আমি তো এখনও মা’কে না জড়িয়ে ধরে ঘুমোতেই পারি না। মায়ের গায়ে একটা ভীষণ মিষ্টি গন্ধ আছে। মা’কে যখন জড়িয়ে ধরি, আসলে সেই গন্ধটাই আমি পাই, এটা কিন্তু কখনও কাউকে বলিনি! মা বলেছে ডাইরি’কে সব বলতে, তাই বললাম।
আমাদের স্কুলের গরমের ছুটি পড়বে আর ক’দিন পর। আমি তো ক্লাস ওয়ানে পড়ি বড় হয়ে গেছি, তাই নিজের ব্যাগ এখন নিজেই নিই, বাবাইকে আর নিতে দিই না। বাবাই বলেছে, আমি যেন ড্রাইভার কাকুর সঙ্গে ভীষণ ভাল ভাবে কথা বলি। মা-বাবা’কে তো সবাই ভালবাসে। যারা অন্যদেরও ভালবাসে, তারাই আসলে ভাল। আমি ভাল মেয়ে হব। সে দিন পাশের বাড়ির আন্টি আমার গাল টিপে দিচ্ছিল আর আমি বলেছি, তোমার হাত আমার গালে দেবে না। ওই আন্টির হাতটা কী রকম কালো কালো। মা বলল, কালো জগতের আলো। যারা আমাদের ভালবাসে, তারাই আদর করে, তাদের সঙ্গে ভাল ব্যবহার করতে হয়।
কিন্তু মা বাবাই তোমরা কিচ্ছু জানো না। আমাদের পাড়ার ছোটাই কাকুকে আমি তো ভালই বাসি, তাই তো ছোটাই কাকু ডাকতেই আমি এসেছি। ভাল মেয়েরা সব সময় বড়দের কথা শোনে। তা হলে ছোটাই কাকু আমাকে বাড়ি যেতে দিচ্ছে না কেন? আমাকে আদর করছে, কিন্তু এটা তো আদর না, আমাকে কষ্ট দিচ্ছে। মা তুমি আমাকে বলোনি কেন— সবাই ভালবাসে না? মা আমার লাগছে। ছোটাই কাকু, আমি বাড়ি যাব। মা, আমার বাথরুম দিয়ে রক্ত পড়ছে! দ্যাখো আমি হিসি বলিনি! আমি তো ভাল! ছোটাই কাকু বলেছে, আমি বাড়ি যেতে চেয়েছি তার শাস্তি! মা তোমাকে না জড়িয়ে কেমন করে ঘুমোব? আমার ভীষণ ঘুম পাচ্ছে। মা আমি ঘুমোই, তোমাকে ছাড়া প্রথম বার। |
ছবি: সুমন চৌধুরী |
|
|
|
|
|