প্রবন্ধ ১...
ছাদে বুঝি লাগল গ্রহণ
ই দুনিয়ায় খুব বেশি দিন আসিনি বলে বড়রা বড্ড বেশি কথা শোনায়। তোরা কত অভাগা। আমির খানের চকলেট বয় ফেজ দেখলি না, ঘণ্টাওয়ালার কুলপি-দোসা খেলি না, ঝুলন চিনলি না এটসেট্রা এটসেট্রা। কিন্তু, আমাদের জেনারেশন-এর তো ‘ইয়েপ্পি’-র জায়গা তো বিস্তর। এই যেমন যতই ইঁদুরদৌড় ছুটি না কেন, আমাদেরও খানকতক রেনি ডে-বিশিষ্ট, টিচারের রামঠ্যাঙানি চোখরাঙানি-খচিত, টিনটিন অ্যাসটেরিক্সের বইয়ে বাঁধানো (ই-বুক ডিভিডির থেকে লক্ষগুণ ভাল), যা হোক তা হোক, একটা ছোটবেলা তো ছিল।
তা সেই ছোটবেলারই, প্রথম দিকটায় অন্তত, স্কুল থেকে ফিরলেই বই নিয়ে বসিয়ে দিত না। এই স্কুল থেকে হাতে কালি মুখে কালি এল, খাক-দাক-একটু জিরোক, তার পর নিশ্চয়ই বই খুলে বসবে। তা সেই খাক-দাক-জিরোক পর্বেই আমার বেজায় দোস্তি হয়ে গেল তার সঙ্গে। তিন মিনিটে নাকেমুখে গুঁজেই ফটাস ফটাস হাওয়াই চটিতে তড়াক তড়াক সিঁড়ি ডিঙিয়ে, পৃথিবীর মাথায়। আমাদের ছাদটায়। ওইটেই সেই ছোট্টবেলাটার চল্লিশ চোরের গুহা।
নো স্যার। সে ছাদ কিসুই রাজাগজা টাইপ ছিল না। মোটে তিন তলার ছাদ। তার মাথার এ দিক ও দিক দিয়ে উঠে, পায়রা-বিবির গরবে বুক ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে তখনকার হিরো, চার তলা-ছয় তলারা। যেন অমিতাভ বচ্চন প্রবল দেমাকে সাইড-হিরো শশী কপূরকে নিয়ে রসিকতা করছে। এই দ্যাখ্ আমি তোর থেকে কত্তখানি উঁচুতে, কত্ত কী ধরা পড়ে আমার চোখেতে। মেরে পাস হাওড়া ব্রিজ হ্যায়, ইডেন গার্ডেন্স হ্যায়, রেসকোর্স হ্যায়, গঙ্গামাইভি হ্যায়। তুমহারে পাস কেয়া হ্যায়?
আমার মুখেতে উত্তরগুলো কোত্থেকে জানি ফড়ফড়ফড় এসে বসে যেত। ওর অনেক অনেক আছে। এই তো এভারেস্ট, লর্ডসের মাঠ, আমাজনের কোর এরিয়ার গাছের গুঁড়ির সেতু, আবার প্রফেসর শঙ্কুর গিরিডির জলপ্রপাতটাও দিব্য আছে।
মানে দুনিয়ার ফাইনেস্ট অতিশয় আশ্চর্যগুলো সব ক’খানাই এই চার কাঠার ছাদটার মধ্যে ফিট অ্যান্ড হিট। কোথায়? ও মা, এই যে ছাদের ওপর যে আর একটা বেবি ছাদ, সেখানে যাওয়ার সিঁড়ি কি এমনি এমনি নেই? খাড়াই দেওয়ালে পা রেখে হাতে ভর দিয়ে হাঁচড়পাঁচড় করে উঠতে হয়, হল কিনা রক ক্লাইম্বিং? আর ওই যে জলের ট্যাঙ্ক? ভরতি হয়ে গেলেই খোলা কল দিয়ে হুড়হুড় জল বেরোয়, যেখানে দুনিয়ার কাক আর বেড়ালরা এসে চকাচক তেষ্টা মেটায়, স্নান করে, মাওম্যাও কা-কা হট্টমেলাই বসিয়ে দেয়, সেটা জলপ্রপাত নয়? সে ট্যাঙ্ক থেকে যে সরু পাইপ ছাদের আলসের দিকে গেছে, যেখানে উঠলেই এই পড়লুম এই পড়লুম-এর সঙ্গে যুদ্ধু করতে করতে ছাদের অন্য প্রান্তে পৌঁছে যাওয়া যায়, সেটাই কিং কঙের গুহায় যাওয়ার গাছের গুঁড়ির ন্যাচারাল সেতুটা নয়? বললেই হল? বেশ, বলব না। বললে তো বলবে, রবীন্দ্রনাথ থেকে টুকেছি। ‘আমার রাজার বাড়ি কোথায় শোন্ মা কানে কানে, ছাদের পাশে তুলসী গাছের টব আছে যেইখানে।’
তবে ছাদের কাছে রবীন্দ্রনাথ এবং চিলেকোঠার কাছে ক্যাপ্টেন স্পার্ক ছাড়া, জম্পেশ হিস্ট্রিও ছিল একখানা। দেড়শো বছর ধরে ঠায় দাঁড়িয়ে, তার ঝুলি ঘাঁটলে কলকাতার ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট অতীতটাই পাওয়া যেত ছেঁড়াখোঁড়া। ওইখানে কত প্রজন্মের ঠাকুমা-পিসিমারা বড়ি আর আচার শুকোত, পাশে তেল মাখিয়ে আমাকেও শুকোত দেওয়া হত এক কালে, কাকে-চড়াইতে যাতে মুখ না দেয় সেটা খুব করে খেয়াল রাখত বাড়ির কুকুর (কিন্তু কাক ঠিক কীসে মুখ দিতে চাইত? বড়িতে না আমাতে?)। তার পর তখন প্রতিবেশী বলে এক প্রকার মানুষ হত। তারাও বিকেল গড়ালে তেলের শিশি, চুলের ফিতে, চিরুনি নিয়ে ছাদে ছাদে গোল হয়ে বসে যেত। তেমন বড় ছাদে উঠলেই উইংস থেকে লুচিভাজা ও ছানার ডালনার সুবাস ভাসত, মেমরিতে ঝাড়বাতি জ্বালিয়ে অন হয়ে যেত বিয়েবাড়ি অন্নপ্রাশনের প্রীতিভোজনের স্মৃতি। উত্তম-সুচিত্রা প্লাস বাঙালিয়ানার সেই স্বর্ণযুগে ছাদ ছিল মহিলামহলের পিএনপিসি-র আখড়া এবং যৌবনের বৃন্দাবন। বাক্যের শেষাংশটুকু বিশদে বুঝিয়েছিল ‘পরিপক্ব বলে খ্যাত বলিয়া মিশতে বারণ’ এক দিদি। যা শৈশবে খেলার মাঠ, কৈশোর ও প্রথম যৌবনের লীলাক্ষেত্র ও তৎপরবর্তী দীর্ঘ জীবনে আড্ডানিকেতন, তাকেই নাকি আমরা ফর্মালি ছাদ বলে চিনি।
আমার কপাল, না ছাদের কপাল, না এ শহরের কপাল বলতে পারব না। তবে, তিন জনেরই শনির সাড়ে সাতি দশা করে, কলকাতাটা এক দিন বিকেলবেলা ফট করে কসমোপলিটান হয়ে গেল।
বড় হয়ে দুরস্ত কেরিয়ার বাগাতে হবে, তাই আমার বৈকালিক আগডুমবাগডুম খেলায় ঢ্যাঁড়া পড়ল। ম্যাটিনি শো-র সেই হাঁপ ছাড়ার ফাঁকটাতেও এক মাস্টার ঢুকে ছাদের দরজা চিরতরে বন্ধ করে দিলেন। তার পর সে নব্য কলকাতায় মশা, হিউমিডিটি এবং বদ লোকও হুহু করে বেড়ে গেল। ফলে, পাওয়ার কাট কি গভীর রাত, সব অবস্থাতেই ছাদ সর্বান্তঃকরণে পরিত্যাজ্য বস্তু। তদ্দিনে টিভি ইন্টারনেটরা দলে দলে লোকজনকে নেশার পুরিয়া গছিয়ে দিয়ে চলে গেছে, ফলে ছাদের মাথায় ঝুলছে লক-আউটের কলঙ্ক। আড্ডা, প্রেম, লোক দেখা: সবটাই ভাই ফেসবুকে শুয়ে-বসে আঙুল হেলিয়েই হয়ে যায়। অতএব ছাদের নো মোর প্রয়োজন। ও দিকে বাচ্চারা সব ছোটা ভীম দেখে, ই-গেম খেলে, ট্যাব ঘাঁটে। ছাদে উঠে খেললে বাবা-মা ওদের সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে নিয়ে যাবে। খাঁটি, বিশুদ্ধ ছাদ আর এখানে কোত্থাও নেই। কলকাতা শহরকে উড়ন্ত পাখির চোখে দেখবেন। হিজিবিজি গজানো লম্বা-বেঁটে বিল্ডিং। তাদের উঁচুনিচু চ্যাপটা মালভূমির মতো মাথা। তাতে ব্যাঙের ছাতার মতো ডিশ অ্যান্টেনা, ভগবান জানেন কীসের মোটা মোটা তার। বেশি হাইটের ভাগের অট্টালিকা হলেই মাথায় শয়তানের মস্ত শিং। মোবাইল টাওয়ার। কিন্তু একটাও মানুষ নেই। ঘুড়ি ওড়ানো, সময় কাটানো, মন ভোলানো দূর, কাপড় মেলতেও কেউ ছাদে ওঠে না। বোধ হয় জীবন এখন এত হট, জামা গায়ে দিতেই শুকিয়ে কড়কড়ে গরম হয়ে যায়। তাই লোকে ছাদে না উঠে উঠে তাকে এক্কেবারে ‘নেই’ করে দিয়েছে। বাড়ির মাথার এসব আবোলতাবোল জিনিস সরিয়ে, ধুলো ঝেঁটিয়ে যেটুকু ছাদ কুড়িয়েবাড়িয়ে পাওয়া যাবে, আসছে মহানবমীর দিন সেটাই হবে লাউঞ্জ বার। আর ক্রিসমাস এলে হয়ে যাবে ‘ইয়ো ইয়ো হানি সিং’ বাজানোর ওপেন এয়ার ডিস্ক্।
এ বারে, একটা জলবৎতরলং ফর্মুলা। গুনুন দেখি, গেল মাসে, ক’টা কাটা ঘুড়ি কুড়িয়ে পেয়েছেন। বাড়িতে, অফিসে, পথে-ঘাটে। পাঁচটা? তিনটে? নাকি জিরো’টা? তা হলেই বুঝুন। বিশ্বকর্মা ঠাকুর আছেন। কিন্তু ঘুড়ি নেই। অর্থাৎ ছাদ নেই! সিম্পল।
ছাদকে মনে হয় পি সি সরকার মশাই গিলিগিলিছুমন্তর ছুঃ করে দিয়েছেন। ছাদ ভ্যানিশ! একদম ভোঁ-কাট্টা!
অথচ সময়টা কিন্তু ছিল আইডিয়াল। ফিফটিন্থ অগস্ট টু বিশ্বকর্মা পুজো। এ সময়ের পোস্টার বয়ই তো ভেজা ছাদ। কিন্তু এমন ভরা সিজনে, বাঙালির জীবনে ছাদ খুঁজতে গিয়ে, হাতে পেলাম শপিং মলের ফুডকোর্ট!!!


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.