কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে বাঘা বাঘা চিন্তক লইয়া গড়া হইল ‘দ্য সেন্টার ফর দ্য স্টাডি অব এগ্জিসটেনশিয়াল রিস্ক’, যাহা ভাবিবে, কী কী সাম্প্রতিক কারণে মনুষ্যজাতির অস্তিত্ব বিপন্ন হইতে পারে এবং বিপদগুলি সম্পর্কে জগৎকে সতর্ক করিবে। সমিতিতে আছেন মহাকাশচারী, দার্শনিক, অর্থনীতিবিদ, বৈজ্ঞানিক, আরও বহু শাখার বিশেষজ্ঞ। প্রযুক্তির উন্নতি বহু নূতন বিপদ আনিয়াছে। যেমন, কম্পিউটাররা এক দিন এমন বুদ্ধিমান হইয়া উঠিবে যে আর মানুষের কথা মানিতে রাজি থাকিবে না: ইহা আধুনিক সভ্যতার উদ্বেগ। আবার, দুষ্কৃতীরা কম্পিউটারগুলিকে ভাইরাস দিয়া নষ্ট করিয়া বর্তমান জীবন অচল করিবে: দুর্দশা-সম্ভাবনাও সাম্প্রতিক। আবহাওয়া-পরিবর্তন, খাদ্য-মজুত ব্যবস্থার অপ্রতুলতা, রাসায়নিক যুদ্ধাস্ত্র নির্মাণ, কত কারণে যে মনুষ্য-সভ্যতা শেষের সেই দিনের প্রান্তে উপনীত হইতে পারে, ইয়ত্তা নাই। এই প্রলয়ের সাইরেন বাজাইবার জন্য, মহা-মস্তিষ্ক-সমাহার। কেহ বলিবেন, ইহাই সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা। তবে এমন তর্কও তোলা যায়, ইহা মানুষের দুশ্চিন্তা করিবার অভ্যাসকে অহেতুক মাহাত্ম্য প্রদান। অধিকাংশ মানুষ সারা দিন ধরিয়া নানা দুর্গতি কল্পনা করিয়া ঘামিয়া উঠে। যদি কর্তৃপক্ষ অর্ধচন্দ্র দেন, যদি সন্তানের গুটিবসন্ত হয়, যদি গাড়িটি বাইপাসের মধ্যিখানে ঘড়ঘড় করিয়া থামিয়া যায়! যে কোনওটি যে কোনও মুহূর্তে সত্য হইতে পারে, কিন্তু সেই দিক থেকে দেখিলে, এক জনপ্রিয় কমিক স্ট্রিপের চরিত্রের ন্যায়, যে কোনও মুহূর্তে মাথায় আকাশ ভাঙিয়া পড়িতে পারে ভাবিয়া সদা ত্রস্ত হইয়া পথ চলিতে হয়। যাহার আসল অর্থ, পথ চলা বন্ধ করিয়া, কয়েকটি ভয়কে পাশবালিশের ন্যায় আষ্টেপৃষ্ঠে জড়াইয়া নিজ জীবনকে ব্যাহত করা। এক দিন অ্যালঝাইমার্স হইতে পারে ভাবিয়া ভাবিয়া যদি ভীতিবদ্ধ আড়ষ্ট অবশ হইয়া পড়িয়া থাকি, তবে আর এখনই কী অ-অ্যালঝাইমার্স হইল? |
তদুপরি, বিপদ সম্পর্কে সচেতন করিবার জন্য নূতন করিয়া বিশেষজ্ঞ সমিতির প্রয়োজন নাই। একে তো এইগুলি লইয়া সারা পৃথিবীতে নিরন্তর ভাবনা চলিয়াছে, প্রচুর গোষ্ঠী কাজ করিতেছে এবং সতর্কীকরণও কিছু কম জারি হইতেছে না, কিন্তু তাহার চেয়ে বড় কথা: মানুষের মূল সংকট বিপদ সম্পর্কে অচেতনতা নহে, জ্ঞানপাপ। সব জানিয়াশুনিয়াও আগুন লইয়া খেলা করা। ফাঁকি মারিলে ফেল হইতে পারে, সিগারেট খাইলে ক্যানসার হইতে পারে, মশারি না টাঙাইলে ম্যালেরিয়া: পইপই সাবধানবাণী সে শুনিতেছে, চতুষ্পার্শ্বে প্রমাণ প্রত্যক্ষ করিতেছে। তবু সে মৌহূর্তিক আনন্দকে খাজনা দিয়া পাঠ্যবই ফেলিয়া ক্যারম খেলিবে, গরম লাগিতেছে বলিয়া মশারি ছিঁড়িয়া ঘুমাইবে। লাখ টাকার প্রশ্ন হইল: কী ভাবে তাহাকে সুপথে আনা সম্ভব। গাছ কাটিলে এই গ্রহের সমূহ বিপদ: প্রচার কিছু কম হয় নাই। তাহার পরেও গাছ কাটা না কমিলে বুঝিতে হইবে, হয় প্রশাসন অমনোযোগী, বা অপদার্থ, বা গাছ না-কাটিলে মানুষগুলি না-খাইয়া এখনই মারা পড়িবে, ভবিষ্যতের বিশ্বনাশের কথা ভাবিয়া এখনকার সর্বনাশ মানিয়া লইতে তাহারা প্রস্তুত নহে। বিশ্ব-উষ্ণায়ন লইয়া সমগ্র দুনিয়ায় হইহই। কিন্তু কিছু ক্ষমতাশালী দেশের মত: ইহা ‘বানাইয়া তোলা বিপদ’। অন্য দেশগুলি এই কথার পিছনে স্বার্থের গন্ধ পাইতেছে, উৎপাদন-প্রক্রিয়া না বদলাইবার অভিসন্ধি দেখিতেছে। এই সকল জটিল ও বহুস্তর সমস্যার সমাধান করিতে হয়তো সমাজ বদলাইতে হইবে, হয়তো লোককে খাইতে দিতে হইবে, হয়তো অন্য দর্শনসম্পন্ন গোষ্ঠীর ক্ষমতাসীন হওয়া প্রয়োজন, হয়তো পুনরায় আঁক কষিতে হইবে— বিপদবার্তার কতটা মিথ, কতটা কান দিবার যোগ্য। মানুষ, রাষ্ট্র, স্বার্থ, সহজ বুদ্ধি— পাকে পাকে জড়াইয়া প্যাঁচ পড়িয়া গিয়াছে। খোলার উপায় খুঁজিতে হইবে। কিন্তু মুহুর্মুহু অ্যালার্ম বাজাইবার লোভকে প্রশ্রয় দান ও সর্ববিদিত নোটিসগুলি বিদ্যাবোঝাই গাল ফুলাইয়া আবৃত্তির বন্দোবস্ত সেই উপায় নহে। |