প্রাচীন গ্রিসে এক গোত্রের প্রবক্তা ছিলেন, যাঁরা নাটক বস্তুটাকে বেশ অবজ্ঞার চোখে দেখতেন। তাঁদের মতে, নাটকের দোষ অনেক। প্রথমত, নাটক বা যে কোনও ‘ইমিটেটিভ আর্ট’ নাকি সত্য থেকে অনেক দূরের জিনিস, আর তাই নাটক মানুষকে ভুল পথে চালিত করে। দ্বিতীয়ত, আরও গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার, নাটকের অভিনেতা নাকি ক্রমশ তাঁর অভিনীত চরিত্রের মতো হয়ে ওঠেন, সুতরাং তা বিপজ্জনকও বটে।
কথাগুলো মনে পড়ল ১২ সেপ্টেম্বর আই সি সি আর-এ ব্রিটিশ কাউন্সিল আয়োজিত স্কুলপড়ুয়াদের অভিনীত কিছু নাটক দেখতে দেখতে। তেত্রিশ বছর হল ব্রিটিশ কাউন্সিল এই স্কুল পর্যায়ের নাটক প্রতিযোগিতার আয়োজন করে আসছে। অংশগ্রহণ করছে একশো আশিটিরও বেশি স্কুল। ব্রিটিশ কাউন্সিলের সঙ্গে ম্যানচেস্টার মেট্রোপলিটান ইউনিভার্সিটিও এই কর্মকাণ্ডে যুক্ত। শেক্সপিয়রের ৪৫০তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে অ্যাভন-এর সেই চারণ নাট্যকারই এ বারের প্রতিযোগিতার থিম।
খুব-ই দরকারি এই উদ্যোগ, সন্দেহ নেই। খুব সহজও নয়, অবশ্যই। এতগুলো স্কুলকে এক জায়গায় নিয়ে এসে স্তরে স্তরে এমন একটি প্রতিযোগিতার বিন্যাস, এবং— সবচেয়ে বড় কথা— এতগুলো কিশোরকিশোরীর অভিনয়ে এতখানি মনোযোগ ও নিষ্ঠা, দেখে অবাক হতে হয়। একটা ভরসাও হয় তার সঙ্গে সঙ্গে। এখনও তা হলে নিজেদের বাইরে বেরিয়ে, এখনকার ছেলেমেয়েরা অনেক কিছু ভাবতে পারে!
এই কথাগুলোই ভাবছিলাম নাটক দেখতে দেখতে। আর সেই সূত্রেই মনে হল সেই প্রাচীন গ্রিক সমালোচকদের কথা। মনে হল, আচ্ছা, ওদের মধ্যে কোনটা ওদের নিজেদের ‘নিজেরা’, সেটা কি ওরা জানে? উপলব্ধি করে? |
অল্প বয়স বলেই হয়তো কথাটা বেশি করে মনে হল, তবে বয়স বাড়লেও আমরা কি সে কথা জানতে পারি? কী জানি। আর এখান থেকেই একটা প্রশ্ন ওঠে। নিজেকে ঠিকমত ‘না জানার’ সেই জায়গাটা দিয়ে কি সত্যিই এই অভিনীত চরিত্রগুলো একটু একটু করে জায়গা করে নেয়? নিজেদের বড় হয়ে ওঠাটা একটু একটু করে বদলে দেয়? গ্রিক মিমেটিক থিয়োরির সমালোচকরা সে দিন আপত্তি করেছিলেন এই আশংকাতেই। আমরা না হয় সমালোচনা না-ই করলাম, কিন্তু এই আশংকা, কিংবা আশা— কি পুরোটাই মিথ্যে? না কি, আসলে এখানে জীবনকে বোঝার এবং সেই বোঝার মধ্যে দিয়ে জীবনবোধকে গড়ে তোলার একটা পথ খুঁজে পাওয়া যেতে পারে? পথটা পাওয়া যাক বা না যাক, খোঁজাটা যে খুব জরুরি, সে বিষয়ে তো কোনও সন্দেহ নেই।
একটা কথা খুব পরিষ্কার। এই ছেলেমেয়েদের বড় হয়ে ওঠার সঙ্গে তাদের অভিনয়ের একটা যোগ রাখতে চাওয়া হচ্ছে। তাই প্রতিটি নাটক যেন একটা ‘মেসেজ’ রেখে যায়— একটা নৈতিক বার্তা, সে বিষয়ে সকলেই এখানে অন্তত যত্নবান। অর্থাৎ শিক্ষার একটি প্রয়োজনীয় দিক হিসেবেই এখন নাটককে দেখা হচ্ছে। তাই নানা স্কুলে তৈরি হচ্ছে ‘ড্রামা ক্লাব’, নাটকের ক্লাস। শিক্ষার অঙ্গ হিসেবে দেখা হচ্ছে তাকে। আর, তার ফলে শিক্ষার ধারণাটিরও কোথাও একটা মুক্তি ঘটছে, একটা উত্তরণ ঘটছে। এই মুক্তি, এই উত্তরণ আজ অত্যন্ত প্রয়োজনীয় বলে মনে হয়।
‘মিমেটিক থিয়োরি’র কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম বলে এখানে আরও একটা প্রশ্ন উল্লেখ করি। এ ভাবে যে ছোটদের আত্ম-জিজ্ঞাসা আর আত্ম-উপলব্ধির জায়গা করে দেওয়া হচ্ছে, সেটা কি আসলে আজকের এই আধুনিক ভারতীয় বাস্তবের সঙ্গে তাল মিলিয়েই? শুনেছি এখন মনস্তত্ত্ববিদরাও খুব জোর দিচ্ছেন নাটক-চর্চার ওপর, যাতে বাচ্চাদের চঞ্চলতা একটা সৃষ্টিশীল ভূমিকা পায়। এই সব শুনে একটা অন্য প্রশ্ন মনে আসে। ভাবতে ইচ্ছে করে, আরও অনেক বেশি খেলার সুযোগ, খেলার মাঠ, হাত-পা ছড়ানোর অবকাশ থাকলে কি ‘চঞ্চলতা ম্যানেজমেন্ট’-এর জন্য বাচ্চাদের নাটক করানোর এই উদ্যোগ এতটা জরুরি হয়ে উঠত?
আবার, ভারতীয় বাস্তব বলেও তো এক ছাঁচে ঢালা কিছু হয় না। যে ভারতীয় শিশুদের খেলার মাঠ অফুরন্ত, যাদের পিঠের ব্যাগে ইংরেজি বইয়ের পাহাড় নেই, তাদের জন্য এই উদ্যোগ নয়, তাদের কাছে পৌঁছনোর সম্ভাবনাও নেই। প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারী প্রায় সব স্কুলই ইংরেজি-মাধ্যম। এমনকী কলকাতা শহরের বাংলা (এমনকী হিন্দি) মাধ্যম স্কুলগুলোকেও খুঁজে পাওয়া যাবে না এই কর্মযজ্ঞে। তুলনায় ব্রাত্য ছোট শহরের স্কুলগুলিও। একটু অবাকই করে এই অনুপস্থিতি। সেই স্বাধীনতা-পূর্ব কাল থেকে এই ধরনের সংস্কৃতি চর্চা কেবল এক ধরনের মানুষের জন্যই সংরক্ষিত থেকে গেল। ফলে যে ভারতে ইংরেজির প্রতিযোগিতা, নাগরিকতার প্রতিযোগিতা, সেই ভারতের জন্যই দরকার হয় এই নাটকের প্রতিযোগিতাও। সেই বাচ্চাদের জন্য খুলে দিতে হয় নিজেকে জানা-বোঝার বিকল্প দরজা, অথবা জীবনের নানা নৈতিক বার্তা দেওয়ার বন্দোবস্ত।
এই সব ভাবতে ভাবতেই দেখি মঞ্চ থেকে বিদায় নিচ্ছে সে দিনের রোজালিন্ড আর ভায়োলা’রা। কী অভিজ্ঞতা, কী শিক্ষা নিয়ে বাড়ি ফিরল তারা, যদি জানতে পারতাম...! |