চাষের পরে নষ্ট হওয়া সব্জি এবং ফলের পরিমাণের নিরিখে দেশের মধ্যে শীর্ষে পশ্চিমবঙ্গ। বণিকসভা ‘অ্যাসোসিয়েটেড চেম্বার্স অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ’ (অ্যাসোচ্যাম)-এর সাম্প্রতিক সমীক্ষা রিপোর্ট বলছে, বছরে ১৩,৬০০ কোটি টাকারও বেশি ফল-সব্জি নষ্ট হয় এ রাজ্যে।
চাষিদের পরিশ্রম এ ভাবে জলে যাওয়ার পিছনে এ রাজ্যে উৎপাদিত ফল-সব্জি সংরক্ষণের উপযুক্ত পরিকাঠামো না থাকাকেই দায়ী করছে ওই বণিকসভা। তবে কেন সেই পরিকাঠামো তৈরি হয়নি, তা হয়ে দাঁড়িয়েছে রাজনৈতিক চাপান-উতোরের বিষয়। আর এই সূত্রে সামনে আসছে কোন সব্জি বা ফল হিমঘরে রাখা যাবে বা যাবে না, রাখলে কত দিন রাখা যাবেএ সম্পর্কে কৃষিজীবীদের একটা বড় অংশে সম্যক ধারণার অভাব এবং হিমঘর ব্যবহার করার মতো সঙ্গতি না থাকার প্রশ্নগুলিও।
অ্যাসোচ্যাম-এর সমীক্ষা অনুযায়ী, গোটা দেশে ফি বছর চাষের পরে ২ লক্ষ কোটি টাকারও বেশি ফল এবং সব্জি নষ্ট হয়, যার ৬ শতাংশের বেশি (দেশে সর্বোচ্চ) পশ্চিমবঙ্গে। দ্বিতীয় গুজরাত (ক্ষতি বছরে ১১,৪০০ কোটি টাকা), তৃতীয় বিহার (ক্ষতি বছরে ১০,৭০০ কোটি টাকা)। বণিকসভাটির মতে, এই ক্ষতির একটা বড় অংশই হয় হিমঘর এবং বহুমুখী হিমঘরের স্বল্পতার জন্য।
হিমঘরের অভাবে উৎপাদন সংরক্ষণে কী সমস্যা হয়, তা হাড়েহাড়ে জানেন উত্তরবঙ্গের আনারস চাষিরা। উত্তরবঙ্গে শিলিগুড়ি মহকুমার ফাঁসিদেওয়া, খড়িবাড়ি, জলপাইগুড়ির রাজগঞ্জ, কোচবিহারের দিনহাটা, উত্তর দিনাজপুরের চোপড়া এবং মালদহের নালাগোলায় প্রায় ২৫ হাজার হেক্টর জমিতে আনারস চাষ হচ্ছে। এ বছরও সম্ভাব্য উৎপাদন সাড়ে ৪ থেকে ৫ লক্ষ টন। |
রাজ্যে বছরে প্রায় সাড়ে ৫ হাজার হেক্টর জমিতে ৫৫ হাজার টন ফল এবং ৫৫ হাজার হেক্টর জমিতে প্রায় ৯০০ হাজার টন সব্জি উৎপাদিত হয়। প্রায় ৫ থেকে ৭ শতাংশ হারে প্রতি বছর তা বেড়েও চলেছে। দেশের মোট আনারস উৎপাদনের ২৭ শতাংশ, কলা উৎপাদনের ১২ শতাংশ এই রাজ্যে হয়। এ ছাড়া আম, পেঁপে, পেয়ারা, কাঁঠাল, টোমাটো, ফুলকপি, বাঁধাকপি, বেগুন, কুমড়োর উৎপাদন দেশের মোট উৎপাদনের ১০ শতাংশের কাছাকাছি। |
|
কিন্তু চাষিদের অভিজ্ঞতা, সরকারি ভাবে আনারস সংরক্ষণের ব্যবস্থা না থাকায় অনেক সময়েই তাঁরা নামমাত্র দামে ফসল বেচেন। শিলিগুড়ি-জলপাইগুড়ি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ বিধাননগর এলাকায় একটি আনারস উন্নয়নকেন্দ্র তৈরির কাজ করছে। সেখানে একটি হিমঘরও হয়েছে। তবে তা চালু হয়নি। ‘নর্থ বেঙ্গল পাইন্যাপল গ্রোয়ার্স অ্যাসোসিয়েশন’-এর সম্পাদক অরুণ মণ্ডলের দাবি, “উত্তরবঙ্গে অন্তত ১০টি হিমঘর দরকার।”
মদনপুরের সব্জি বিক্রেতা সুহাস বিশ্বাস বলেন, “কোলে মার্কেটে সব্জি এনে দিনের দিন বিক্রি করতে হয়। ফিরিয়ে নেওয়ার উপায় না থাকায় অনেক সময়ে কম দামে মাল ছেড়ে দিতে হয়। মান নষ্টও সংরক্ষণ-ব্যবস্থা থাকলে এমন হত না।” কেন বাম-আমলে সব্জি সংরক্ষণে বড় বিনিয়োগ আসেনি? ফরওয়ার্ড ব্লক নেতা তথা কৃষি বিপণন পর্ষদের প্রাক্তন চেয়ারম্যান নরেন চট্টোপাধ্যায়ের জবাব, “উৎপাদনের উপরে নিয়ন্ত্রণ না পেলে বিনিয়োগকারীরা বাজারে টাকা ঢালেন না। চুক্তি-চাষ করে চাষিকে নিজেদের ইচ্ছেমতো পণ্য উৎপাদনে তাঁরা বাধ্য করতে পারলে তবেই এটা হতে পারে। আমরা চাষিদের পুঁজিপতিদের হাতে তুলে দিইনি।”
কৃষি বিপণনমন্ত্রী অরূপ রায় অবশ্য বলেন, “আলুর জন্য যে হিমঘর তৈরি হয়েছে তাতে তো বড় বিনিয়োগকারীরা আসেননি। তা হলে সব্জির হিমঘরে অসুবিধা কোথায়? আগের সরকার পরিকল্পনা করতে পারেনি। আমরা দু’বছরে সেই পরিকল্পনা করেছি।” গত সোমবারই রাজ্য সরকার ‘বৃহৎ কৃষক বাজার’ নামে একটি প্রকল্প ঘোষণা করেছে যেখান থেকে বড় বিনিয়োগকারীরা সরাসরি চাষিদের থেকে ফল এবং সব্জি কিনতে পারবে। অরূপবাবু জানিয়েছেন, প্রথম দফায় রাজ্যে ৯০টি কৃষক মান্ডিও তৈরি করা হচ্ছে। সেখানে মান্ডির পাশেই সব্জি সংরক্ষণ কেন্দ্র থাকবে। চাষিরা বাজারে বিক্রি না করতে চাইলে সংরক্ষণ কেন্দ্রে উৎপাদিত সব্জি রাখতে পারবেন।
একাধিক কৃষক সংগঠন, হিমঘর মালিক পক্ষের সঙ্গে কথা বলে এই সমস্যার অন্য দিকগুলিও জানা গিয়েছে। যার অন্যতমচাষিদের সামর্থ্যের প্রশ্ন। ঐতিহ্যগত ভাবে পশ্চিমবঙ্গে ছোট চাষিরা দলে ভারী। তার উপরে বাম-আমলে ছোট জমিতে পাট্টা পেয়ে তাঁদের সংখ্যা বেড়েছে। কমেছে ব্যক্তিগত সামর্থ্য। তাই ফসলের দাম না পেলে তাঁরা হিমঘরে বাড়তি দাম দিয়ে তা সংরক্ষণ করতে পারেন না। অভাবী বিক্রিতে বাধ্য হন।
তা ছাড়া, অভ্যাস না থাকায় এ রাজ্যের চাষিদের একটা বড় অংশ চট করে সব্জি বা ফল সংরক্ষণের রাস্তায় হাঁটতে চান না। ফলে, রাজ্যে বিচ্ছিন্ন ভাবে যে ক’টি বহুমুখী হিমঘর তৈরি হয়েছে, অনেক সময় তার ‘চেম্বার’ ফাঁকা পড়ে আছে। সেখানে চাষিরা না সব্জি রাখছেন, না ফল। তাই বহুমুখী হিমঘরে টাকা ঢেলেও সেই ভাবে ভাড়া পাচ্ছেন না বলে দাবি হিমঘর মালিকদের একাংশের। হুগলির মহানাদ অঞ্চলে বহুমুখী হিমঘর আছে শান্তনু গুহরায়ের। ১৪ কোটি টাকা খরচ করে বছর তিনেক আগে তিনি হিমঘরটি করেন। তিনি বলেন, “সমস্যা হচ্ছে, চাষিদের হিমঘরে সব্জি বা ফল রাখার অভ্যাস সে ভাবে গড়ে ওঠেনি। এ জন্য অনেকের সামর্থ্য না থাকাটাও একটা ব্যাপার।”
আশার কথা শোনা গিয়েছে শেওড়াফুলির একটি বহুমুখী হিমঘরে। মালিক অশোক কোলে জানিয়েছেন, এখন সেখানে বাঁধাকপি, টমেটো, গাজর থেকে শুরু করে আপেল, ন্যাসপাতি, খেজুরও রাখছেন চাষিরা।
রাজ্যের উদ্যানপালন ও খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ দফতরের মন্ত্রী সুব্রত সাহা বলেন, “অ্যাসোচামের ওই সমীক্ষা-রিপোর্টের সঙ্গে কিছুটা একমত আমি। সংরক্ষণের অভাবে এ রাজ্যে ফল-সব্জি নষ্ট যেমন হয় তেমন বাজারে দামও বেড়ে যায়।” তবে তাঁর সংযোজন, “দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা না থাকলে ফল-সব্জি সংরক্ষণের জন্য যে প্রযুক্তি এবং বিনিয়োগ প্রয়োজন তা আসে না। আমাদের আগের সরকার সেই পরিকল্পনা তৈরিতে ব্যর্থ।” সুব্রতবাবুর দাবি, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেই পরিকল্পনা নিয়েছেন। সংরক্ষণের সেই পরিকল্পনাকে রূপ দেওয়ার জন্য পিপিপি-মডেলে (পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ) জোর দেওয়া হচ্ছে। সংরক্ষণের প্রযুক্তির সহায়তার জন্য মুম্বইয়ের ‘ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ প্যাকেজিং’ এবং খড়্গপুর আইআইটি-র সঙ্গে কথা বলা হয়েছে। |