তালিবানি বিষনজর না ভারত-পাক দ্বৈরথ কোন সমীকরণের বলি হলেন সুস্মিতা বন্দ্যোপাধ্যায়, ধোঁয়াশা বাড়ছেই।
সম্প্রতি একটি অনলাইন মার্কিন পত্রিকায় তালিবানের এক গোষ্ঠী এই হত্যার দায় স্বীকার করে দাবি করেছে, ভারতীয় চর ছিলেন সুস্মিতা। আবার আফগান গোয়েন্দা সংস্থার মতে, ওই গোষ্ঠী আইএসআই মদতপুষ্ট এবং কট্টর ভারত-বিরোধী। এ দিকে, সুস্মিতা-হত্যায় জড়িত সন্দেহে ধৃতরা জেরায় স্বীকার করেছে, এই হত্যার সঙ্গে জড়িত রয়েছে পাক-তালিবানের তিন জন। সব মিলিয়ে তাই সুস্মিতা-হত্যার পিছনে পাকিস্তানি মদতের সম্ভাবনাও জোরদার হয়ে উঠছে ক্রমে।
মার্কিন অনলাইন পত্রিকাটির দাবি, ‘সুইসাইড গ্রুপ অফ দা ইসলামিক মুভমেন্ট অফ আফগানিস্তান’ নামে এক তালিবান গোষ্ঠী সুস্মিতাকে ভারতীয় চরের তকমা দিয়েছে। তাদের মুখপাত্র কারি হামজা ওই মার্কিন পত্রিকাকে জানিয়েছে, মূলত চরবৃত্তির জন্যই তারা হত্যা করেছে কাবুলিওয়ালার বাঙালি বৌ-কে। তার বয়ানে, “আমরা ওকে (সুস্মিতাকে) অপহরণ করি, কঠোর ভাবে জেরা করি এবং তার পর মেরে ফেলে রেখে যাই।” এখনও পর্যন্ত পাওয়া তথ্য বলছে, হত্যার দিন গভীর রাতে সুস্মিতার স্বামী জানবাজ খানকে বন্দুকের ডগায় রেখে ও তাঁর চোখ, মুখ, হাতে কাপড় বেঁধে সুস্মিতাকে অপহরণ করে সশস্ত্র জঙ্গিরা। এবং সুস্মিতার দেহ মেলে তাঁর বাড়ি থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরের একটি মাদ্রাসায়। অর্থাৎ প্রাথমিক ভাবে, তালিবানের এই গোষ্ঠীর বয়ান এবং ঘটনাক্রমে সঙ্গতি রয়েছে। কিন্তু উঠে আসছে বেশ ক’টি প্রশ্নও।
প্রথমত, প্রথমে অস্বীকার করার পর হত্যার দায় কেন স্বীকার করল তালিবান? বিশেষত যখন আফগান গোয়েন্দা সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, মহিলাদের হত্যা করলে সচরাচর তার দায় স্বীকার করার প্রবণতা দেখা যায় না তালিবানের মধ্যে। দ্বিতীয়ত, যদি চরবৃত্তি এবং আধুনিক মানসিকতাই সুস্মিতাকে আফগান-তালিবানের বিষনজরে ফেলে থাকে, তা হলে সে হত্যার পিছনে পাক-তালিবানের হাত কেন? তৃতীয়ত, সুস্মিতা-হত্যার নেপথ্যে তাঁর স্বামীর সঙ্গে ঝামেলার যে তত্ত্ব উঠে এসেছিল, তা কি তা হলে মিথ্যে?
সরাসরি প্রশ্নের উত্তর না দিলেও, ওই মার্কিন পত্রিকার দাবি, তালিবানের যে গোষ্ঠী সুস্মিতা-হত্যার দায় নিয়েছে, তা মূল তালিবান থেকে বেরিয়ে যাওয়া বিক্ষুব্ধ অংশ। মোল্লা নাজিবুল্লার নেতৃত্বাধীন ওই গোষ্ঠী চলতি বছরের গোড়ার দিকেই আলাদা হয়ে গিয়েছিল। আসলে আমেরিকা বা কাবুল প্রশাসন কারও সঙ্গেই শান্তি আলোচনায় বসতে নারাজ এরা। এদের দাবি, এ হেন আলোচনা আসলে তালিবান প্রতিষ্ঠাতা মোল্লা মহম্মদ ওমরের আদর্শের বিরোধী। তা ছাড়া, তালিবানের মূল অংশের তুলনায় এরা ঢের বেশি রক্ষণশীল এবং তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে আরও কট্টর ভারত-বিরোধী। মার্কিন পত্রিকাটি জানিয়েছে, নাজিবুল্লা তাদের কাছে দাবি করেছে, “আফগানিস্তানে ভারতীয়দের জন্য জায়গা নেই।” তার মতে, “পাকিস্তান এবং আফগানিস্তান বিরোধী কার্যকলাপের কেন্দ্র হিসেবে আফগানিস্তানকে ব্যবহার করছে ভারত।” দলনেতার এ হেন আদর্শের রেশ টেনে হামজা জানিয়েছে, সুস্মিতা জেরায় যে সব ভারতীয় চরের নাম জানিয়ে গিয়েছিলেন, তাঁদেরও দেখে নেবে এই গোষ্ঠী। আফগান গোয়েন্দা সংস্থার মতে, তালিবানের এই অংশের চরম ভারত-বিদ্বেষী মনোভাবই কাজে লাগিয়েছে পাক গুপ্তচর সংস্থা আইএসআই। আসলে, আফগানিস্তান থেকে ধীরে ধীরে সেনা সরাচ্ছে আমেরিকা। এই অবস্থায় সে দেশে কূটনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক সব রকম প্রভাব বাড়াতেই সচেষ্ট ভারত ও পাকিস্তান। আফগান রাজনীতিতে স্বমহিমায় ফিরতে থাকা তালিবানের এই কট্টর ভারত-বিরোধী অংশকে তাই নিজেদের পাশে রাখতে চায় আইএসআই। উদ্দেশ্য একটাই। ন্যাটো-পরবর্তী আফগানিস্তানে আধিপত্য কায়েম করা। সুস্মিতা-হত্যায় পাকিস্তান তালিবানের তিন সদস্যের যোগ সেই তালিবান-আইএসআই আঁতাঁতেরই অংশ, দাবি ওই পত্রিকার। আফগান প্রশাসন সম্প্রতি জানিয়েছে, ওই তিন অভিযুক্ত আফগান তালিবানের স্থানীয় কম্যান্ডার আকবর মুসাফিরের অধীনে সুস্মিতা-হত্যার ছক কষে। তাতে মদত ছিল হক্কানি-গোষ্ঠীরও।
তবে তালিবানের ওই গোষ্ঠীর আনা চরবৃত্তির অভিযোগ অবশ্য মানতে নারাজ সুস্মিতার শ্বশুরবাড়ির শহরের লোকজন। তাঁদের স্মৃতিতে গোলগাল, পিছিয়ে পড়া মেয়েদের পাশে দাঁড়ানো, একরোখা ও আধুনিক বাঙালি বৌয়েরই ছবি। যিনি কি না স্বামীর প্রথমা স্ত্রী ও তাঁর তিন মেয়ের সঙ্গে মানিয়ে গুছিয়ে সংসার করতেন।
অর্থাৎ ওই পত্রিকার হিসেব মতো, পারিবারিক ঝামেলার তত্ত্ব খাটছে না। হত্যার কারণ হিসেবে জোরদার হচ্ছে তালিবানি-বিদ্বেষের আড়ালে থাকা ভারত-পাক কূটনৈতিক দ্বৈরথ। সত্যাসত্য সময়ই বলবে। কিন্তু স্বাস্থ্যকেন্দ্রের কর্মী হিসেবে দিনরাত কাজ করে চলা ও নারী অধিকার রক্ষায় সোচ্চার একরোখা সুস্মিতার মৃত্যুর কোনও সরল ব্যাখ্যা যে মিলবে না, তা অবশ্য বুঝে গিয়েছেন পাকটিকা প্রদেশের শারানা শহরের বাসিন্দারা। |