সুস্মিতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের খুনের পিছনে পারিবারিক কারণই রয়েছে বলে মনে করছে ভারতের বিদেশ মন্ত্রক। দিল্লিতে নিযুক্ত আফগানিস্তানের রাষ্ট্রদূত সাইদা মহম্মদ আব্দালিও আজ দিল্লিতে আনন্দবাজারকে জানিয়ে দিয়েছেন, তালিবান নয়, সুস্মিতার খুনের পিছনে রয়েছে পারিবারিক ষড়যন্ত্র। তবে আজ আফগানিস্তানে নিযুক্ত ভারতের রাষ্ট্রদূত অমর সিন্হা কাবুল থেকে ফোনে জানিয়েছেন, এই খুনের সঙ্গে জড়িত হিসেবে আফগান পুলিশ যে দু’জনকে ধরেছে, তারা পাকিস্তানের মদতপুষ্ট তালিবান জঙ্গিদের সংগঠন হক্কানি গোষ্ঠীর সদস্য।
আফগানিস্তানের দূতাবাস সূত্রের বক্তব্য, খুনের পর সন্দেহভাজন হিসেবে কাউকে গ্রেফতার করা হতেই পারে। তার জঙ্গি-যোগ থাকাও অস্বাভাবিক নয়। তবে তার মানে এই নয় যে, হত্যার উদ্দেশ্য রাজনৈতিক। কেন না পারিবারিক ষড়যন্ত্রের জেরে কাউকে খুন করতে হলেও আফগানিস্তানে সব থেকে ভাল উপায় হল কোনও জঙ্গিদলকে ‘সুপারি’ দেওয়া। সন্দেহমুক্ত থাকার এটা একটা উপায়ও বটে বলে দাবি তাঁদের। ভারতের বিদেশ মন্ত্রকের কর্তাদের একাংশেরও মত একই।
এই অবস্থায় প্রশ্ন উঠছে, তা হলে কি পরিবারের তরফেই এই খুনের জন্য তালিবান জঙ্গিদের সাহায্য নেওয়া হয়েছিল? সে সন্দেহ উড়িয়ে দিচ্ছেন না সুস্মিতার বাপের বাড়ির সদস্যরাও। আফগান রাষ্ট্রদূত আব্দালি-ও আজ বলেন, “ভারতীয় লেখিকার এই পরিণতি অত্যন্ত মর্মান্তিক। তবে আমাদের কাছে যে রিপোর্ট এসেছে, তা থেকে স্পষ্ট, এই ঘটনার পিছনে রয়েছে পারিবারিক ষড়যন্ত্র। কোনও রাজনৈতিক কারণ বা তালিবান সন্ত্রাসের ঘটনা এটি নয়। পুরোটাই পারিবারিক চক্রান্ত।” সুস্মিতা-খুনের পর থেকেই আব্দালি নিয়মিত যোগাযোগ রেখে চলেছেন সে দেশের পুলিশ-প্রশাসনের সঙ্গে। পাকতিকা প্রদেশের (যেখানে হত্যাকাণ্ডটি ঘটেছে) গভর্নরের সঙ্গেও গত কাল কথা বলেছেন তিনি। আব্দালির কথায়, “তালিবান যদি হত্যা করতো, তা হলে তারা অবিলম্বে বিবৃতি দিয়ে সেটা অস্বীকার করত না। এটা তাদের হত্যার ধরনের সঙ্গে একেবারেই মেলে না। বরং তারাই ঘোষণা করত, কী কারণে তারা ওই লেখিকার প্রাণ নিয়েছে।”
ভারতের বিদেশ মন্ত্রকও এই খুনের পিছনে পারিবারিক কারণকেই প্রাথমিক ভাবে দায়ী করেছে। আজ বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র সৈয়দ আকবরুদ্দিন বলেন, “প্রাথমিক ভাবে আমরা যা বুঝছি, তা হল, এই বেদনাদায়ক মৃত্যুর পিছনে কিছু পারিবারিক বিষয় রয়েছে। তবে বিশদে সব কিছু জানার জন্য আমরা অপেক্ষা করব। সেখানকার স্থানীয় পুলিশ এবং প্রশাসনই এ ব্যাপারে শেষ কথা বলতে পারবে।” গোটা বিষয়টির উপরে ভারত সতর্ক নজর রাখছে বলে বিদেশ মন্ত্রকের একটি সূত্র জানিয়েছে।
সুস্মিতা-খুনে ধৃত দু’জনের নাম মহম্মদ ইয়াকুব ও মহম্মদ আসিফ। বয়স ২৫ থেকে ২৮-এর মধ্যে। ধৃতরা সুস্মিতাকে খুনের কথা স্বীকারও করেছে। এ ব্যাপারে মোট ১৬ জনের একটি দলের খোঁজ করছে পুলিশ। অমরবাবু বলেন, “ধৃতদের জেরা করে জানা গিয়েছে, তাদের কম্যান্ডারের নাম আকবর মুসাফির। তবে তাকে পুলিশ এখনও ধরতে পারেনি।”
অমরবাবুর দাবি, জেরায় জঙ্গিরা পুলিশকে জানিয়েছে যে, তারা সুস্মিতা সম্পর্কে প্রচুর তথ্য জানত। তাদের কাছে খবর ছিল, সুস্মিতা ইন্টারনেট ব্যবহার করে বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। বহু মানুষের সঙ্গে সরাসরি কথাও বলতেন। জঙ্গিদের সন্দেহ ছিল, ইন্টারনেটের মাধ্যমে সুস্মিতা তথ্য পাচার করছেন।
এখানেই প্রশ্ন উঠছে, সুস্মিতার ইন্টারনেট ব্যবহারের বিষয়টি বাইরের লোক জানতে পারল কী ভাবে? সুস্মিতার কোনও পরিচিত ছাড়া তাঁর ইন্টারনেট ব্যবহার করার কথা বাইরের লোকের পক্ষে জানা সম্ভব নয়। তা হলে এই বিষয়টি কি সুস্মিতারই সে দেশের কোনও পরিচিত লোক জঙ্গিদের জানিয়েছে?
সেই সন্দেহই ক্রমশ জোরদার হচ্ছে। আর এখানেই আঙুল উঠছে সুস্মিতার শ্বশুরবাড়ির লোকেদের দিকে। সুস্মিতার বাপের বাড়ির সদস্যরাও খুনের পিছনে ‘অন্য কারণই’ দেখছেন। ঘনিষ্ঠ বন্ধু শালিনী নস্করের সঙ্গে সুস্মিতার ফেসবুক-এর কথোপকথন প্রকাশ্যে চলে আসার পরেই তাঁর স্বামী জানবাজকে ঘিরে রহস্য বেড়েছে। সুস্মিতা তাঁর বান্ধবীকে সম্প্রতি জানিয়েছিলেন, জানবাজের ভাই মুশা মারা যাওয়ার পর তাঁর স্ত্রী সুলতান বিবির সঙ্গে জানবাজের অবৈধ সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল। ভাই-এর স্ত্রী সুলতান বিবির সঙ্গে প্রকাশ্যেই তিনি যথেষ্ট মাতামাতি করতেন বলে অভিযোগ। সুলতান বিবি বাড়িতে এলে সুস্মিতাকে সম্পূর্ণ অবজ্ঞা করে তাকে নিয়েই জানবাজ মেতে থাকতেন বলেও বান্ধবীকে জানিয়েছিলেন সুস্মিতা।
চোখের সামনে এ সব দেখেও সুস্মিতাকে চুপ করে থাকতে হতো বলেই দাবি শালিনীর। এই একাকীত্ব থেকেই সম্ভবত সুস্মিতা সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটের মাধ্যমে দিল্লির বাসিন্দা দীপক কুমারের ঘনিষ্ঠ হন। তাঁর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হতে চাইছেন বলেও সুস্মিতা বান্ধবীকে জানিয়েছিলেন। শালিনীর কথায়, “কাউকে আঁকড়ে ধরে বাঁচার চেষ্টা করছিল সুস্মিতা। দীপকই ছিল সেই অবলম্বন।” সেপ্টেম্বর মাসে দিল্লি এসে দীপক কুমারকে বিয়ে করার পরিকল্পনাই সুস্মিতার ছিল বলে দাবি শালিনীর।
বাংলাদেশের নির্বাসিতা লেখিকা তসলিমা নাসরিন ব্যক্তিগত ভাবে সুস্মিতাকে চেনেন দীর্ঘদিন। তিনি জানাচ্ছেন, যে আজ থেকে নয়, পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ‘বনিবনার অভাব’ সুস্মিতার অনেক দিনের। তসলিমার কথায়, “আমি কলকাতায় থাকার সময় কয়েক বার সুস্মিতা আমার বাড়ি এসেছে। মনের অনেক কথাই ও আমাকে বলত। যার থেকে বুঝতে পারতাম, স্বামীর সঙ্গে ওর সম্পর্ক ভাল নয়।” শুধু মুখে নয়, শ্বশুরবাড়ি সম্পর্কে বিরূপ মনোভাবের কথা সুস্মিতা লিখেও গিয়েছেন বলে জানাচ্ছেন তসলিমা। তারই ‘প্রতিশোধ’ এ ভাবে সুস্মিতার উপর নেওয়া হল বলে অনুমান তাঁর।
সুস্মিতার ভাই গোপাল বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন, এ দিনও তিনি জানবাজ বা তার ভাই জার খানের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেননি। জানবাজের ফোন এ দিনও বন্ধ ছিল। আর জার খানের ফোন বেজেই গিয়েছে। |