|
|
|
|
খুশির দিল্লিতে বেমানান, হতাশ এক বস্তি |
অনমিত্র সেনগুপ্ত • নয়াদিল্লি |
সময় যেন হঠাৎ থমকে গিয়েছে ছোট্ট ঘিঞ্জি এই মহল্লায়।
পোশাকি নাম রবিদাস ক্যাম্প। জায়গাটি দক্ষিণ দিল্লির অভিজাত এলাকা আর কে পুরম হলেও রবিদাস ক্যাম্প আসলে বস্তিই। পরপর এক কামরার খুপরি চালা। বিকেলের পড়ন্ত আলোয় টাইম কলে জল ভরার ব্যস্ততা। ছোট্ট মহল্লার ততোধিক ছোট্ট মনিহারি দোকানে হাল্কা বিকিকিনি। বিকেলের জটলা সবই চলছে নিয়মমাফিক, কিন্তু কোথায় যেন ছন্দ কাটার সুর। পুলিশের ইতস্তত জটলা, মিডিয়ার ভিড় বুঝিয়ে দিচ্ছে মহল্লার আজকের দিনটা একটু অন্য রকম। হবে নাই বা কেন! ঘণ্টা দেড়েক আগেই নির্ভয়া মামলার রায় জানিয়েছে আদালত। আশঙ্কা সত্যি করে বিরলতম শাস্তিই ঘোষণা হয়েছে পাড়ার ছেলে মুকেশ সিংহ, বিনয় শর্মা, পবন গুপ্ত ও অক্ষয় ঠাকুরের।
খুশির দিল্লিতে তাই আজ বড্ড বেমানান হতদরিদ্র এক বস্তি।
মূল অভিযুক্ত রাম সিংহের তিহাড় জেলে অস্বাভাবিক মৃত্যু, কিংবা তার ভাই মুকেশ ও অন্য অভিযুক্ত অক্ষয়ের শাস্তি মেনে নিতে অসুবিধা হয়নি মহল্লার। বলছে, যা হয়েছে, ঠিক হয়েছে। ওদের জন্যই আমাদের পাড়ার নাম খারাপ হয়েছে। আত্মীয়-স্বজনেরা প্রশ্ন করছেন। মেয়েদের বিয়ে দিতেও অসুবিধা হচ্ছে। কিন্তু এত সব সমস্যা মেনেও স্তম্ভিত মহল্লা এখনও পবন ও বিনয় যে দোষী তা মেনে নিতে পারছে না! রায়দানে মুড়ি-মিছরি এক দর করে ফেলেছে আদালত, এমন মতও উঠে আসছে মহল্লার অনেকের কথায়।
মাতাল ও ঝামেলাবাজ বলে পাড়ায় পরিচিত ছিল বাসচালক রাম সিংহ। ভাই মুকেশ বাসের ক্লিনারের কাজ করত। মাঝেমধ্যে স্টিয়ারিংয়েও বসত হাত পাকাতে। মক্কেলকে নির্দোষ প্রমাণে ১৬ ডিসেম্বর রাতে মুকেশই বাস চালাচ্ছিল বলে দাবি করেছিলেন তার আইনজীবী। কিন্তু ফাস্ট ট্র্যাক কোর্টে প্রমাণ হয়ে গিয়েছে, সে রাতের নারকীয় অভিযানে কারও চেয়ে পিছিয়ে ছিল না ছ’জনের কেউই। |
|
দণ্ডিতদের বস্তি রবিদাস ক্যাম্পে পুলিশ পাহারা। ছবি: পিটিআই। |
রাম-মুকেশদের সঙ্গেই ওঠাবসা থাকায় বাসের হেল্পার অক্ষয় সম্পর্কে এ কথা মেনে নিতে রাজি রবিদাস ক্যাম্প। কিন্তু ফল বিক্রেতা পবন বা জিমের ফিটনেস ট্রেনার বিনয়কে অন্য চেখেই দেখে এসেছে এই মহল্লা। বিশেষ করে বিনয় আবার স্কুলের গণ্ডি পেরোনো ছেলে। ইংরেজিটাও বলতে পারে। এ দু’জনকে পাড়ায় অন্তত তেমন কোনও উচ্ছৃঙ্খল আচরণ করতে দেখেননি প্রতিবেশীরা।
আর এই কারণেই পবন আর বিনয়ের ফাঁসির হুকুমে মহল্লায় যেন হতাশার ছায়া। সঙ্গে নিষ্ফল আক্রোশের মিশেলও! তার আঁচ পেলাম রবিদাস ক্যাম্পে পৌঁছতেই। আগন্তুকের প্রতি সপ্রশ্ন চাউনি উপেক্ষা করে বিনয়ের বাড়ির চৌকাঠে দাঁড়াতেই ঘিরে ধরল ভিড়। কী চাই, কেন বিরক্ত করছেন এই ধরনের একাধিক প্রশ্নবাণ কাটিয়ে কোনও মতে ঢোকা গেল বাড়ির ভিতরে। আদালত বিনয়কে দোষী সাব্যস্ত করার পর থেকেই খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে দিয়েছিলেন মা চম্পাদেবী। ক্ষীণ আশা ছিল, হয় তো ফাঁসি নয় যাবজ্জীবন পাবে ছেলে। কী হয়, কী হয় আতঙ্কে আজ সারা দিন টিভি পর্যন্ত খোলার সাহস পাননি তিনি। কিন্তু লোকমুখে খবর পৌঁছে যেতেই ঘনঘন অজ্ঞান হয়ে পড়ছেন। রায় শোনার পরে শুধু জানিয়েছেন, “সকলকেই কেন এক মাপকাঠিতে মাপা হল? ”
ছেলে ধর্ষণ কাণ্ডে ধরা পড়ার পর এক বার সফদরজঙ্গ স্টেশনের কাছে রেললাইনে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলেন বিনয়ের বাবা হরিরাম। স্থানীয় মজদুররা দেখে ফেলায় সে যাত্রা রক্ষা পান। আজ সাজা ঘোষণার পরে কার্যত বাক্শূন্য তিনি। নতুন করে অঘটনের আশঙ্কায় তাঁকে ঘিরে রেখেছেন প্রতিবেশীরা। কিন্তু নিজেদের কাজকর্ম ফেলে কত দিন এ ভাবে আগলে রাখা সম্ভব! সে উত্তর খুঁজছেন ক্যাম্পের বাসিন্দারাই।
কয়েক পা হাঁটলেই পবনের বাড়ি। একই প্রতিচ্ছবি। ছেলের শোকে গত তিন দিন কুটোটি কাটেননি মা ইন্দিরা। স্ত্রীর জন্য দুধের প্যাকেট কিনতে গিয়েছিলেন স্বামী হীরালাল। চোখ-মুখ বসা। এক গাল না কাটা দাড়ি। এখনও বিশ্বাস করতে চান না, ছেলে ওই কাজ করতে পারে। ফলের রস বেচে বাবার ভার লাঘব করতে যে ছেলে ভোট চারটের সময় উঠে আজাদপুরে ফলমান্ডিতে পৌঁছে যেত, বোনকে যে চোখে হারাত সে কী ভাবে ওই কাজ করতে পারে, ঘটনার পর থেকে সেই প্রশ্নেরই উত্তর খুঁজে চলেছেন তিনি। বললেন, “কোথা থেকে যে কী হয়ে গেল। আমার ছেলে এই ধরনের কাজ করতে পারে না।”
আসলে সঙ্গদোষই এই দু’জনকে ডুবিয়েছে বলে মনে করেন স্থানীয় বাসিন্দা সুনীল কুমার, চমনলালরা। রাম সিংহ আর ১৭ বছরের নাবালক অপরাধীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতাই পবন ও বিনয়ের কাল হয়েছে বলে মত তাঁদের। সুনীলের বক্তব্য, “ওই দু’টি ছেলে সত্যিই ভাল ছিল। ছোট থেকে দেখেছি। রাম সিংহই দলবল জুটিয়ে এখানে গোলমাল পাকাত। সেই ফাঁদেই পড়ে গিয়েছিল ওই দু’জন।” কিন্তু তাতে যে পবন-বিনয়ের দোষ লাঘব হয় না, সেই যুক্তি শুনতে
রাজি নন সুনীলরা।
তাঁদের প্রশ্ন, মূল অভিযুক্ত ছিল রাম সিংহ। সে ইতিমধ্যেই আত্মহত্যা করেছে। তা হলে কেন পবন ও বিনয়কেও ওই ঘটনার জন্য সমান ভাবে দোষী সাব্যস্ত করা হল?
অভিযুক্তদের শাস্তি দেওয়ার ক্ষেত্রে কোনও বিভেদ না করার পিছনে রাজনৈতিক চাপ রয়েছে বলেই মনে করছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। বিনয়ের আইনজীবী এ পি সিংহ যে ভাবে এ দিন টিভির পর্দায় রায়ের উপরে রাজনৈতিক প্রভাবের অভিযোগ তুলেছেন, তা-ও প্রভাব ফেলেছে এঁদের মনে। তাঁরা প্রশ্ন তুলছেন রাম সিংহের মৃত্যু নিয়েও। এক হাত যার পঙ্গু, সেই রাম সিংহের পক্ষে গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করা সম্ভব কি না, তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে মহল্লাবাসীদের মধ্যে।
আদালত ফাঁসির সাজা দিতে পারে, এই আশঙ্কায় গত কাল থেকেই দোষী চার জনের কাউন্সেলিং শুরু করেছে তিহাড় জেল প্রশাসন। অভিযুক্তদের বোঝানো হচ্ছে, নিম্ন আদালতের রায়েই সব রাস্তা শেষ হয়ে যাচ্ছে না। এর পর দিল্লি হাইকোর্ট, সুপ্রিম কোর্টে যাওয়ারও সুযোগ রয়েছে অভিযুক্তদের। একই ভাবে অভিযুক্তদের পরিবারের পাশে দাঁড়ানোর ইঙ্গিত দিয়েছে ফাঁসির বিরুদ্ধে থাকা একাধিক মানবাধিকার ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনও।
আগামিকাল থেকেই আবার নতুন লড়াই। ভাঙা মন নিয়েও এখন তার প্রস্তুতিতে ডুব দিতে চাইছেন পবনের বাবা। ফাঁসির বাকি তিন আসামির স্বজনরাও। কিন্তু নির্ভয়া কাণ্ডের পর থেকে গত ন’মাস ধরে যে উত্তেজনা তাঁদের কুরেকুরে খেয়েছে তা
আজ কোথায় যেন এসে থমকে গেল বলেই মনে করছেন রবিদাস ক্যাম্পের বাসিন্দারা।
|
পুরনো খবর: ওরা এ কাজ করেছে! স্তম্ভিত রবিদাস ক্যাম্প |
|
|
|
|
|