|
|
|
|
ফাঁসির সাজাই মিলল নির্ভয়ার চার ধর্ষকের |
প্রেমাংশু চৌধুরী • নয়াদিল্লি |
সাজা ঘোষণা হওয়ার কথা ছিল দুপুর আড়াইটেয়। কিন্তু ২টো ৩৫ বাজার আগেই সাকেতের জেলা আদালতের ৩০৪ নম্বর ঘরের দরজাটা আবার খুলে গেল। বেরিয়ে এলেন এক খাকি উর্দি। ডান হাতের চারটে আঙুল তুলে এক বার নাড়লেন। ইঙ্গিত বুঝতে দেরি হল না। তুমুল হাততালিতে ফেটে পড়ল বাইরের ভিড়টা।
নির্ভয়া গণধর্ষণ মামলার চার অপরাধী মুকেশ সিংহ, বিনয় শর্মা, পবন গুপ্ত এবং অক্ষয় সিংহ ঠাকুরকে ফাঁসির সাজাই দিলেন ফাস্ট ট্র্যাক আদালতের বিচারক যোগেশ খন্না। মোট ৬ অপরাধীর মধ্যে বাসচালক রাম সিংহের আগেই মৃত্যু হয়েছে তিহাড় জেলে। ধর্ষক নাবালককে তিন বছর সংশোধনাগারে রাখার নির্দেশ দিয়েছে জুভেনাইল বোর্ড। সে বাদে বাকিদের গত ১০ তারিখেই দোষী সাব্যস্ত করেছিল আদালত। সাজা ঘোষণার কথা ছিল আজ।
এ দিন আদালত শুরু হওয়া মাত্রই বিচারক খন্না তাঁর ২৭ পৃষ্ঠার আদেশের মূল অংশ পড়তে শুরু করে দেন। বলেন, “অন্য অপরাধ ছেড়ে আমি সরাসরি ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩০২ ধারায় (খুন) চলে আসছি। দেশজুড়ে মেয়েদের প্রতি অত্যাচার যখন বাড়ছে, তখন আদালত চোখ বুজে থাকতে পারে না। এই বর্বরোচিত ব্যবহার বিরলের মধ্যে বিরলতম পর্যায়ভুক্ত। চার জনকেই মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হল।” |
অবশেষে |
|
|
আদালত কক্ষের ভিতরে তখন চিৎকার করে কেঁদে উঠেছে ২০ বছরের বিনয় শর্মা। বিনয়ের সঙ্গে মুকেশ, অক্ষয়, পবনকে আজ একেবারে পিছনের দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড় করিয়েছিল পুলিশ। সাজা শুনে সকলেই ক্ষমাভিক্ষা করতে থাকে। মুকেশ আর পবনও কেঁদে ফেলে। শুধু অক্ষয়ের চোখে জল দেখা যায়নি। সব চেয়ে বেশি ভেঙে পড়েছিল মেরুন শার্ট পরা স্পাইক করা চুলের বিনয়। হাউহাউ করে কাঁদতে থাকা বিনয়কে বাকিদের সঙ্গে কার্যত টেনেহিঁচড়ে কোর্ট থেকে বার করে নিয়ে যেতে হয়।
বিনয়দের ঠিক সামনেই দুই ছেলেকে নিয়ে বসেছিলেন নির্ভয়ার বাবা-মা। মেয়ের ধর্ষকদের ফাঁসির সাজা শুনে কোর্ট থেকে যখন বেরিয়ে আসছেন, তখন মায়ের চোখে জল। বললেন, “শ্বাসটা গলার কাছে আটকে ছিল এত ক্ষণ। এ বার সেটা বেরিয়ে এল। গোটা দেশের মানুষকে ধন্যবাদ। সংবাদমাধ্যমকেও ধন্যবাদ।” নির্ভয়ার বাবা বললেন, ‘‘ওরা ক্ষমার যোগ্য নয়। আমরা খুশি। সুবিচার মিলেছে।”
ফাঁসির সাজা ঘোষণার পরেই আদালত কক্ষ ছেড়ে বেরিয়ে যান বিচারক খন্না। তাঁকে বেরিয়ে যেতে দেখে বিনয় ও অক্ষয়ের আইনজীবী এ পি সিংহ গলা চড়িয়ে বলতে থাকেন, “জজসাহেব, আপনি সত্যমেব জয়তের জায়গায় মিথ্যামেব জয়তেকে প্রাধান্য দিলেন। এটা রাজনৈতিক চাপ জয়তে, ভোটব্যাঙ্ক রাজনীতি জয়তে।” কোর্টের বাইরে এসেও পুলিশি ঘেরাটোপে এ পি সিংহ দাবি করলেন, রায় ঘোষণার আগেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুশীলকুমার শিন্দে ফাঁসির কথা বলেছিলেন। এ থেকেই স্পষ্ট, রাজনৈতিক চাপেই রায় হয়েছে। তিনি এ-ও বলেছেন, কাল থেকে দিল্লিতে যদি আর কোনও ধর্ষণ না হয়, তা হলে তিনি হাইকোর্টে আবেদন করবেন না। মুকেশের আইনজীবী ভি কে আনন্দ অবশ্য হাইকোর্টে যাওয়ার কথা স্পষ্টই জানিয়ে দেন। |
|
দোষীদের সাজা ঘোষণার পর সাংবাদিকদের মুখোমুখি আইনজীবী এ পি সিংহ। পিটিআইয়ের তোলা ছবি। |
আদালতের সামনের রাস্তায় আজ সকাল থেকেই গাড়ি চলাচল বন্ধ করে দিয়েছিল পুলিশ। বাইরের ভিড়টা তাই হেঁটেই এসেছিল। আদালত বসার আগে থেকেই চার, পাঁচ, ছ’তলার বারান্দায় উপচে পড়েছিল ভিড়। দেশি-বিদেশি সংবাদমাধ্যম ছাড়াও মোবাইল ক্যামেরা হাতে দাঁড়িয়ে ছিলেন আদালতের কর্মী থেকে আইনজীবী, এমনকী অন্য মামলার অনেক সাক্ষীও। আর সাজা ঘোষণার পরেই আদালতের বাইরে যুদ্ধজয়ের উল্লাস (যা আদালত শেষের পরেও বহুক্ষণ চলল)। হাততালি দিয়েই যাচ্ছিলেন বেশ কিছু মহিলা সংগঠনের সদস্যারা। আলম নামে এক শিল্পী তখন তুলি-ক্যানভাসে ব্যস্ত। বিশেষ সরকারি আইনজীবী দয়ান কৃষ্ণণের সহকারীদের
কাঁধে তুলে নিয়েছেন একদল তরুণ। বয়স্কদের অনেকে দিল্লি পুলিশের কনস্টেবলদের পিঠ চাপড়ে দিচ্ছেন। হাতে হাতে পোস্টার ‘শি ওন। শি ইজ এ সারভাইভর। অ্যান ইনস্পিরেশন।’
আদালত চত্বরে আজ অবশ্য দেখা মেলেনি নির্ভয়ার সেই বন্ধুর। যাঁর সঙ্গে ১৬ ডিসেম্বর রাতে সিনেমা দেখে ওই বাসে উঠেছিলেন ২৩ বছরের তরুণী। যাঁর চোখের সামনেই নির্ভয়ার উপরে অত্যাচার চালিয়েছিল রাম-মুকেশ-অক্ষয়রা। প্রচণ্ড মার খেয়েছিলেন নির্ভয়ার ওই বন্ধুও। এর আগে আদালতে এসে দোষীদের ফাঁসির দাবি তুলেছিলেন তিনি। কিন্তু আজ আসেননি। দোষীদের পরিবারেরও কেউ আজ আদালতমুখো হননি। রাম ও মুকেশের বাবা-মা দিল্লিতে নেই। পবন ও বিনয়ের বাবা-মা, ভাই বোনেরাও আর কে পুরমের রবিদাস ক্যাম্পের বস্তির ঘরে বসেই সাজার খবর শুনেছেন। নির্ভয়ার বাবা-মা-ভাইরা পৌঁছে যান নির্ধারিত সময়ের আগেই। দোষীদের আইনজীবীরা হাইকোর্টে যাবেন শুনে বললেন, তাঁরা দীর্ঘ লড়াইয়ের জন্য তৈরি। |
|
|
অক্ষয় সিংহ ঠাকুর
বয়স ২৮ |
মুকেশ সিংহ
বয়স ২৬ |
বিনয় শর্মা
বয়স ২০ |
পবন গুপ্ত
বয়স ১৯ |
|
|
যদিও অনেকেই বলছিলেন, ১৬ ডিসেম্বরের পর থেকে এই ৯ মাসের লড়াইটাও খুব কম দীর্ঘ, কম কঠিন ছিল না। নির্ভয়ার ঘটনার পর রাজধানী উত্তাল হয়েছে। ধর্ষণের সাজা ফাঁসি হওয়া উচিত কি না, বা ফাঁসি দিলেই ধর্ষণ ঠেকানো যাবে কি না, তা নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ হয়েছে। মহিলাদের বিরুদ্ধে অপরাধ রুখতে নতুন আইন তৈরি হয়েছে। সরকারি আইনজীবীরা ফাঁসির সাজা চাইলেও অভিযুক্তদের আইনজীবীরা আদালতে যুক্তি দিয়েছিলেন, চার জনেরই বয়স কম। অতীতে বড় অপরাধের রেকর্ড নেই। এক বার শোধরানোর সুযোগ দেওয়া উচিত। সকলেই গরিব ঘরের। গোটা পরিবার এদের উপর নির্ভরশীল।
শেষ পর্যন্ত বিচারক যোগেশ খন্নার সামনে সেই সব যুক্তি ধোপে টেঁকেনি। চার জনকে দোষী সাব্যস্ত করার দিনেই তিনি বলেছিলেন, খুন করাটাই ওদের উদ্দেশ্য ছিল, আঘাত করা নয়। অভিযুক্তরা কী ভাবে হাত আর রড ব্যবহার করে নির্ভয়ার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বার করে এনেছিল, তারও উল্লেখ করেন তিনি। আর আজকের রায়ে তিনি বলেছেন, “দোষীরা তরুণীর উপরে যে ভাবে পাশবিক নির্যাতন চালিয়েছে, তাতে চুল খাড়া হয়ে যায়। একজন অসহায় মহিলার উপর অমানবিক অত্যাচার শুধু গোটা সমাজের বিবেককে নাড়িয়ে দেয়নি, এদের চারপাশ থেকে সমাজের সুরক্ষার হাত সরিয়ে নেওয়ারও ডাক দিয়েছে।”
|
খুশি। তবে ওদের ফাঁসি না হওয়া পর্যন্ত লড়াই চলবে।
নির্ভয়ার বাবা |
শ্বাসটা গলার কাছে আটকে ছিল এত ক্ষণ। মেয়েটা সুবিচার পেল।
নির্ভয়ার মা |
|
|
রায় স্বাগত। এই ধরনের ঘৃণ্য ঘটনার অপরাধী চরমতম সাজা পাক, এ আমিও চাই।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় |
‘ন্যায়দেবতা’ অপরাধীদের জন্য নয়া নজির গড়লেন... রায়কে স্বাগত জানাচ্ছি।
সুশীলকুমার শিন্দে |
রায় স্বাগত। ভবিষ্যতে অপরাধ কমাবে এই রায়।
সুষমা স্বরাজ |
একটা সাজাই শেষ কথা নয়। দরকার ধারাবাহিক লড়াই, আন্দোলন ও সচেতনতা।
বৃন্দা কারাট |
চার ধর্ষক চলে গেলেও নারীবিদ্বেষ থেকে যাবে। পুরুষরা ধর্ষণ বন্ধ করবে না।
তসলিমা নাসরিন |
যাঁরা মৃত্যুদণ্ড চাইছেন, তাঁদের কষ্টটা বুঝতে পারছি। তবু ব্যক্তিগত ভাবে মনে হয় ফাঁসির শাস্তিবিধান থেকে সরে আসাই ভাল।
শঙ্খ ঘোষ |
ঈশ্বর আছেন.... অবশেষে ন্যায়বিচারও এল।
কর্ণ জোহর |
এই ‘ফ্রাইডে দা থার্টিন্থ’ ন্যায়বিচারের দিন। জয় হো।
অনুপম খের |
এই জঘন্য অপরাধের জন্য এর থেকে কম কোনও শাস্তি প্রাপ্য নয় ওদের।
অক্ষয় কুমার |
সকলকে ধন্যবাদ। .... জানোয়ার গুলোকে নরকে যেতে দেখে নিশ্চিন্ত লাগছে।
কিরণ বেদী |
|
পুরনো খবর: ধনঞ্জয়ের নাম করে ফাঁসির আবেদন, রায় কাল |
|
|
|
|
|