হয় কাজ করুন। আর না পারলে সরে যান। আমি বুঝে নেব বৃহস্পতিবার হাওড়ায় প্রশাসনিক বৈঠকে সরকারি অফিসার ও পদাধিকারীদের প্রতি এই ভাবেই কড়া বার্তা দিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
কর্মসংস্কৃতি ফেরাতে মুখ্যমন্ত্রীর কঠোর মন্তব্য নতুন নয়। কিন্তু এ দিন বৈঠকে হাজির আধিকারিকদের অনেকেই পরে বলেছেন, কোনও মুখ্যমন্ত্রীই এর আগে এ ভাবে গোড়া ধরে নাড়া দেওয়ার চেষ্টা করেননি। এমনকী, মমতা নিজেও নন। তাঁদের বক্তব্য, একটা কাজ কেন হচ্ছে না বা আটকে থাকছে, তার একাধিক কারণ থাকে। উদাহরণ দিয়ে তাঁরা বলছেন, ছাদের ট্যাঙ্ক থেকে নীচের কলে জল আসার জন্য যে লাইন, তাতে একাধিক স্টপ কক থাকে। সেগুলি ঠিকমতো কাজ না করা হলে ট্যাঙ্ক ভর্তি আর কল ভাল থাকলেও জল পাওয়া যায় না। এ দিন মুখ্যমন্ত্রী ঝাঁকি দিয়ে সেই পুরো ব্যবস্থাটিকেই নাড়িয়ে দিতে চেয়েছেন।
এই ঝাঁকিদর্শনের মাত্রা কতটা, তা পরিষ্কার হয়েছে মুখ্যমন্ত্রীর আরও কিছু কথায়। কাজে গতি না এলে অফিসার থেকে আধিকারিক, কাউকেই যে ছাড়া হবে না, এ ইঙ্গিত দিয়ে তিনি বলেছেন, “মনে রাখবেন, কারও উপরে আমার কোনও দুর্বলতা নেই।” যদিও বৈঠকটি ছিল হাওড়া জেলাকেন্দ্রিক, কিন্তু সরকারি মহল ধরে নিয়েছে, মুখ্যমন্ত্রীর এই বার্তা আসলে রাজ্যের সর্বত্র সমান ভাবে প্রযোজ্য। |
এ দিন বৈঠকে কাজে গতি আনার কথা ওঠে একশো দিনের কাজ নিয়ে আলোচনার সময়। বছরখানেক আগে হাওড়ায় প্রথম প্রশাসনিক বৈঠক করতে গিয়ে জেলায় একশো দিনের কাজের অগ্রগতি দেখে ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। সরকারি কর্তাদের ভর্ৎসনাও করেছিলেন। তাঁর নির্দেশ ছিল, যে কোনও উপায়ে লক্ষ্যমাত্রা সামনে রেখে একশো দিনের কাজ করতে হবে। কিন্তু এ দিন দ্বিতীয় বারের জন্য শরৎ সদনে বৈঠক করতে এসে মুখ্যমন্ত্রী জানতে পারেন, জেলায় একশো দিনের কাজ হয়েছে মাত্র ১৩ দিন। এই তথ্য জানার পরে কোনও রাখঢাক না করে বৈঠকে উপস্থিত রাজ্য ও জেলা প্রশাসনের কর্তাদের তুলোধোনা করেন তিনি। কেন যথেষ্ট সংখ্যক দিন কাজ হয়নি, রাজ্যের পঞ্চায়েত আধিকারিকদের কাছে তার ব্যাখ্যা চান মুখ্যমন্ত্রী। মঞ্চে তখন ছিলেন পঞ্চায়েতমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়। কাজে অগ্রগতি না হওয়ার কারণ হিসেবে এ বছরের অতি-বর্ষা এবং পঞ্চায়েত ভোটে ব্যস্ততার কারণ তুলে ধরেন পঞ্চায়েত দফতরের অফিসারেরা। মুখ্যমন্ত্রী এই ব্যাখ্যায় পুরোপুরি সন্তুষ্ট না হয়ে পরিষ্কার জানিয়ে দেন, খুব দ্রুত একশো দিনের কাজে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে হবে। এই নিয়ে আর কোনও গাফিলতি তিনি বরদাস্ত করবেন না।
জেলায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জন্য বরাদ্দ ভাতা অনিয়মিত ভাবে দেওয়া হচ্ছে বলেও ক্ষোভ প্রকাশ করেন মুখ্যমন্ত্রী। কৃষকদের স্বার্থে জেলায় কেন কিষান-মান্ডি তৈরি হয়নি, সেই প্রশ্নও তোলেন তিনি। এই প্রসঙ্গ থেকেই চলে আসে সরকারি অফিসারদের কাজ করার বিষয়টি। সরকারের কাজে গতি নেই এই অভিযোগ দীর্ঘদিনের। এর আগে বাম আমলে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ‘ডু ইট নাউ’ স্লোগান দিয়ে এই কর্মসংস্কৃতি পরিবর্তনের চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পারেননি। শাসক বদলেছে, কিন্তু কাজের সংস্কৃতির বিশেষ বদল হয়নি।
সমস্যাটা প্রশাসনের শীর্ষকর্তারা তো বটেই, মুখ্যমন্ত্রী নিজেও ভাল ভাবেই জানেন। তাই একাধিকবার তিনি কাজে গতি আনতে চেয়ে বার্তাও দিয়েছেন। এতে প্রধানত প্রশাসনের ওপরতলার কিছুটা গতি এসেওছে। হাওড়া জেলা প্রশাসনের এক কর্তা এ দিন জানান, ওপরমহলের চাপে এখন আর টেবিলে ফাইল পড়ে থাকে না। কিন্তু এই ছবি যে সর্বত্র, সব স্তরে সমান ভাবে নয় তা বুঝেই মুখ্যমন্ত্রী এ দিন অফিসারদের প্রতি কড়া বার্তা দেন, “আমরা কাজ চাই। কাজের লোক চাই। যাঁরা কাজ করতে চাইছেন না, তাঁরা সরে যান।”
মুখ্যমন্ত্রীর কথায় ওঠে হাওড়া সংক্রান্ত বিষয়গুলিও। এই জেলায় মহিলাদের নিরাপত্তা দিতে পুলিশ কেন ব্যর্থ হচ্ছে প্রশ্ন তুলে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “মহিলারা শহরে-গ্রামে কেন নিরাপদে বাইরে বেরোতে পারবেন না? এ জন্য পুলিশি টহলদারি বাড়াতে হবে। ওসি, আইসি-দের আরও সক্রিয় হয়ে কাজ করতে হবে।”
হাওড়ার উন্নয়ন প্রসঙ্গে মমতা বলেন, “জেলার ক্ষুদ্র শিল্প সংস্থাগুলি পুনর্গঠন করে ৫০ হাজার বেকারের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। গ্রামীণ বিদ্যুদয়নের ক্ষেত্রে খুব শীঘ্রই হাওড়া জেলা ১০০% লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছে যাবে।” শহরের জলসঙ্কট নিয়ে তাঁর অভিযোগ, “এটা হাওড়া পুরসভার সমস্যা। এখানে পুরসভায় লোকই নেই, কাজ করবে কে? তাই এত বছর পরেও শহরে কাঁচা নর্দমা, নিকাশির ব্যবস্থা হয়নি। কোনও নির্দিষ্ট পরিকল্পনা নেই।” তাঁর বক্তব্য, “এখন পুরনির্বাচন এসে যাওয়ায় পুরসভা কাজই করছে না। এই শহরের জন্য নির্দিষ্ট পরিকল্পনা তৈরি করে কাজ করতে হবে।” বিভিন্ন সরকারি প্রকল্প নিয়ে আলোচনার সময় এ দিন দফতর ধরে ধরে কাজের অগ্রগতি জানতে চান মুখ্যমন্ত্রী।
এ দিনের বৈঠকে পঞ্চায়েতমন্ত্রী ছাড়াও ছিলেন পুর ও নগরোন্নয়ন মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম, আবাসনমন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস ও কৃষি, শিল্প, সেচ, পঞ্চায়েত ও স্বাস্থ্য দফতরের পদাধিকারীরা। ছিলেন হাওড়া জেলা থেকে নির্বাচিত তিন মন্ত্রী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়, অরূপ রায় এবং হায়দর আজিজ সফি। বৈঠকে ডাক পেয়েছিলেন জেলার সমস্ত প্রশাসনিক কর্তা, রাজ্য পুলিশের ডিজি নপরাজিত মুখোপাধ্যায় ও জেলার পুলিশ প্রধানরা। |