বাংলার নানা প্রান্তে শিক্ষা ক্ষেত্রে হিংসা-হানাহানির উন্মত্ততার মধ্যে দ্বীপের মতো জেগে আছে স্কুলটি। হাওড়ার যোগেশচন্দ্র বালিকা বিদ্যালয়। পরিচালন সমিতি গড়তে সেখানে ভোটাভুটির দরকার হয়নি অন্তত দু’দশক। এবং এ বারেও সেই ব্যতিক্রমী ঐতিহ্য বজায় রেখেছে যোগেশচন্দ্র। বিনা নির্বাচনে, অনেকটা সর্বসম্মতির ভিত্তিতেই পরিচালন সমিতি গড়া হয়েছে এ বারেও।
রাজ্য জুড়ে স্কুল-কলেজের পরিচালন সমিতির নির্বাচনে সাধারণ ভাবে দলীয় রাজনীতিরই দাপট। হিংসা এড়াতে শিক্ষায় রাজনীতির অনুপ্রবেশ রোখার আওয়াজ উঠছে। কিন্তু রাজনীতিমুক্ত শিক্ষার ব্যাপারে শাসক বা বিরোধী কারও তেমন আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না। যদিও ক্ষমতায় এসেই শিক্ষাকে রাজনীতিমুক্ত করার আশ্বাস দিয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়
তবু যে আশা আছে, সেই আলো দেখাচ্ছে হাওড়ার যোগেশচন্দ্র বালিকা বিদ্যালয়ের মতো প্রতিষ্ঠান। হিংসার দাপটের মধ্যে, এমন টানটান রাজনৈতিক আবহে কী ভাবে এমন দুঃসাধ্য সাধন করছে স্কুলটি? |
যোগেশচন্দ্র মোটেই রামকৃষ্ণ মিশন বা সেন্ট জেভিয়ার্স কর্তৃপক্ষ পরিচালিত প্রতিষ্ঠানের মতো স্কুল নয়। সরকারি অনুমোদনে চলা আর-পাঁচটা স্কুলের মতোই। তা সত্ত্বেও চার পাশের পরিবেশকে আমল না-দিয়ে শুধু সর্বজনের শুভ ইচ্ছার বলে বলীয়ান হয়েই দুঃসাধ্য সাধন করে চলেছে এই স্কুল। এ বারেও পরিচালন সমিতিতে ছ’জন অভিভাবক বাছাই হয়েছে ভোটাভুটি ছাড়াই। সপ্তম হিসেবে এক জন মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছিলেন। কিন্তু নির্বাচন এড়াতে তা প্রত্যাহার করে নিয়েছেন তিনিও।
বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা শুভ্রা চক্রবর্তী বলেন, “আমি এই স্কুলে আছি ১৯৯৫ সাল থেকে। ২০০১ থেকে প্রধান শিক্ষিকা। এই সময়ের মধ্যে পরিচালন সমিতি গড়তে কখনওই ভোটাভুটিতে যেতে হয়নি। এই স্কুলে এটাই ঐতিহ্য হয়ে গিয়েছে বলে অভিভাবক থেকে রাজনৈতিক দল, সকলেই সহযোগিতা করেন। তাই এই ধারা বজায় রাখা যাচ্ছে।”
বিদ্যালয় সূত্রের খবর, গত ৫ অগস্ট পরিচালন সমিতির ভোটার তালিকা প্রকাশিত হয়। মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার দিন ছিল ২৯ অগস্ট। ভোটের দিন ঠিক হয় ৮ সেপ্টেম্বর। ভোটার তালিকা প্রকাশের পরেই স্থানীয় এক তৃণমূলকর্মী বিদ্যালয় থেকে ভোটার তালিকা নিয়ে যান। রাজনীতি অনুপ্রবেশ ঘটতে পারে, এই আশঙ্কায় প্রধান শিক্ষিকা স্থানীয় বিধায়ক তথা রাজ্যের কৃষি বিপণন মন্ত্রী অরূপ রায়কে বিষয়টি জানান।
প্রধান শিক্ষিকা বলেন, “অরূপবাবুকে বলি, বিভিন্ন সময় স্কুলের ডাকা বৈঠকে অভিভাকদের মধ্যে যাঁরা নিয়মিত উপস্থিত থাকেন, ইতিবাচক ভূমিকা নেন, তাঁদের নিয়েই কমিটি গড়তে চাই। এই স্কুলের এটাই রীতি। সকলে সহযোগিতা করলেই এটা সম্ভব।” অরূপবাবু প্রধান শিক্ষিকার ওই প্রস্তাব মেনে নেন। মন্ত্রী বলেন, “ওই স্কুলের এটাই ঐতিহ্য। তাই আমরাও পরিচালন সমিতির নির্বাচন ঘিরে দলাদলি চাইনি।”
কিন্তু তার পরেও পরে দেখা যায়, ছ’টি অভিভাবক পদের জন্য সাতটি মনোনয়নপত্র জমা পড়েছে। জানা যায়, সপ্তম অভিভাবকের নাম শেখ আহমেদ আলি। স্কুল-কর্তৃপক্ষ ইতিমধ্যেই যাঁদের নাম ভেবে রেখেছেন, সেই তালিকায় আহমেদ আলির নাম ছিল না। ফলে চিন্তায় পড়ে যান প্রধান শিক্ষিকা। আহমেদ আলিকে ডেকে পাঠিয়ে স্কুলের আবহমান রেওয়াজের কথা বলে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে নিতে অনুরোধ জানান তিনি এবং ওই অভিভাবক সেটাই করেন। পরে আহমেদ আলি বলেন, “আমি মনোনয়ন প্রত্যাহার না-করলে ভোটাভুটি হতই। কিন্তু ওই স্কুলে সেটা কেউই চাইছেন না। তাই স্কুলের স্বার্থেই শেষ বেলায় মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে নিয়েছি।”
বিদ্যালয়ের ছাত্রী-সংখ্যা ১৪২৫। অর্থাৎ অভিভাবকের সংখ্যা বেশ কয়েকশো। স্কুলের বাছাই করা ওই ছ’জনের বাইরে আরও অনেকেই পরিচালন সমিতির নির্বাচনে দাঁড়াতে পারতেন। দাঁড়ালেন না কেন?
দ্বাদশ শ্রেণির এক ছাত্রীর বাবা তমালকান্তি সরকার বলেন, “সবাই মুখে বলেন, শিক্ষাঙ্গন রাজনীতিমুক্ত থাকুক। এই স্কুলে আমরা সেটা করে দেখাই। যাঁরা মনোনয়ন জমা দিয়েছেন, তাঁদের ভালই চিনি। তাঁরা কমিটিতে থাকলে স্কুলের ভাল হবে বলেই মনে করি। তাই সবাই মিলে নির্বাচনে গুঁতোগুঁতি করার কথা ভাবিনি।”
মধ্য হাওড়া বিধানসভা কেন্দ্রের কংগ্রেসের সভাপতি দেবাশিস বসু বলেন, “প্রধান শিক্ষিকা এ বিষয়ে আমাদের কিছু বলেননি। কিন্তু আমরা খবর পেলাম, কোনও রাজনৈতিক দলই ওই বিদ্যালয়ে প্রার্থী দেয়নি। তাই আমরাও দিইনি।”
ওই বিদ্যালয়ের পরিচালন কমিটির প্রাক্তন সম্পাদক তথা প্রাক্তন বিধায়ক সিপিএমের অরূপ রায় বলেন, “ওই স্কুলে পরিচালন সমিতি গড়ার ব্যাপারে কোনও দিনই রাজনীতি ঢোকেনি। অভিভাবকেরাই তাঁদের পছন্দের কমিটি তৈরি করেন। এ বারেও তা-ই হয়েছে।” বিগত এবং বতর্মান পরিচালন সমিতির অন্যতম সদস্যা স্বপ্না রায় বলেন, “দিদিমণিরা এবং অন্য অভিভাবকেরা চেয়েছেন, তাই এ বারেও মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছিলাম। এখানে ছাত্রী, শিক্ষিকা এবং অভিভাবকদের মধ্যে খুবই ভাল সম্পর্ক। রাজনৈতিক দলাদলি হয় না।” |