|
|
|
|
কিছু শহরে ট্রামের ভাবনা কেন্দ্রের, আশায় কলকাতা
প্রেমাংশু চৌধুরী • নয়াদিল্লি |
দিল্লি, মুম্বই, চেন্নাই, কানপুর, নাসিক থেকে কবেই তার পাট উঠেছে। ভারতে এখন ট্রামের একমাত্র ঠিকানা কলকাতা। শহর কলকাতায় ট্রামের ঘন্টি নিয়ে নস্ট্যালজিয়া রয়েছে ঠিকই। কিন্তু মেট্রো রেলের সঙ্গে দৌড়ে সে হেরে ভূত। দিল্লি, বেঙ্গালুরুর পরে হায়দরাবাদ, কোচিতেও এখন জাল ছড়াচ্ছে মেট্রো, এক ধাপ এগিয়ে মুম্বইয়ে বসছে মোনোরেল। এই অবস্থায় কলকাতার ট্রামের শেষ ঘন্টা বাজতে বেশি দেরি নেই বলে যখন সবাই ধরেই নিয়েছেন, ঠিক সেই সময়েই দেশের মাঝারি মাপের শহরগুলিতে আবার ট্রাম চালু করার কথা ভাবছে কেন্দ্রীয় সরকার। এর পাশাপাশি, ফ্রান্সের সাহায্য নিয়ে কলকাতার ট্রামকে পুনরুজ্জীবিত করে তোলা যায় কি না, সেই চিন্তাভাবনাও শুরু হয়েছে।
কেন্দ্রীয় নগরোন্নয়ন মন্ত্রী কমল নাথের মতে, মেট্রো চালু করতে খরচ যেমন বেশি, তেমন যথেষ্ট যাত্রী না হলে তা লাভজনকও হয় না। মাঝারি মাপের শহরে তাই মেট্রো চালু করে লাভ নেই। তার বদলে এই শহরগুলিতে ট্রাম চালানো যেতে পারে। মন্ত্রীর কথায়, “আমার মনে হয়, প্রথমে কোনও শহরে পরীক্ষামূলক ভাবে ট্রাম চালানো যাক। সফল হলে অন্যান্য শহরেও ট্রামলাইনের পথে
হাঁটব আমরা।”
উনবিংশ শতাব্দীর যে বাহন মোটরগাড়ির সঙ্গে প্রতিযোগিতাতেই পিছিয়ে পড়েছিল, আজ এই একবিংশ শতাব্দীতে তার দৌড় সফল হবে কী ভাবে? এর জন্যই ফ্রান্সের সঙ্গে হাত মেলাতে চাইছে ভারত। গণ-পরিবহণ নিয়ে ভারত ও ফ্রান্সের মধ্যে ইতিমধ্যেই চুক্তি রয়েছে। ট্রাম নিয়ে আশাই দেখছেন দু’দেশের দ্বিপাক্ষিক আর্থিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ফ্রান্সের বিশেষ দূত পল এর্মেলিন। তাঁর কথায়, “ভারতের বিভিন্ন শহরের চাহিদা মাথায় রেখে নতুন প্রযুক্তির সাহায্যে নতুন করে ট্রাম চালু করা যেতে পারে। চালানোর খরচ বাসের চেয়ে কম, কিন্তু যাত্রী বহন ক্ষমতা বেশি। ফলে লাভও বেশি”
ফরাসি বিশেষজ্ঞদের সাহায্যে কলকাতার ট্রামেও ফের প্রাণসঞ্চার সম্ভব বলে মনে করছেন নগরোন্নয়ন মন্ত্রকের সচিব সুধীর কৃষ্ণ। কিন্তু কী ভাবে? নমুনা দিলেন ফরাসি সংস্থা ‘এগিস’-এর ভারতে নিযুক্ত টেকনিক্যাল ডিরেক্টর হার্ভে কুগনেট। বললেন, “আপনাদের কলকাতার ট্রাম যখন চলে, ঘটাং ঘটাং করে বিরক্তিকর শব্দ হয়। আমরা কিন্তু ট্রামের চাকায় রাবার বেল্ট পরিয়ে সেই সমস্যার সমাধান করে ফেলেছি। তা ছাড়া, বিদ্যুতের তার ট্রামের উপরেই থাকতে হবে, এমন নয়। যদি ট্রামকে উড়ালপুলের তলা দিয়ে যেতে হয় বা সুড়ঙ্গে ঢুকতে হয়, তা হলে মাটির নীচ থেকেই বিদ্যুৎ পাঠানো যেতে পারে।” |
কলকাতায় ট্রাম |
১৮৮০: শিয়ালদহ-বৌবাজার স্ট্রিট-ডালহৌসি স্কোয়ার-স্ট্র্যান্ড রোড হয়ে
আর্মেনিয়ান ঘাট পর্যন্ত ঘোড়ায় টানা ট্রাম চালু
১৮৮২: স্টিম ইঞ্জিন এল
১৯০৫: পুরো ট্রামলাইনের বৈদ্যুতিকরণ
১৯৪৩: হাওড়া ব্রিজের উপর দিয়ে কলকাতা-হাওড়া ট্রাম
১৯৯২: ট্রাম কোম্পানি বাস চালাতে শুরু করল
১৯৯৩: হাওড়া ব্রিজের উপর দিয়ে ট্রাম চলাচল বন্ধ ২০০০ সালের পর থেকে
মেট্রো রেল,
উড়ালপুলের মতো প্রকল্পের জন্য একের পর এক ট্রাম লাইন বন্ধ হতে শুরু করে |
|
বণিকসভা ফিকি ও ফরাসি দূতাবাস আয়োজিত ‘নেক্সট জেনারেশন ট্রামওয়েজ সলিউশন’ শীর্ষক আলোচনাসভায় যোগ দিতে দিল্লিতে এসেছেন ফ্রান্সের সেনেট সদস্য তথা স্ট্রাসবুর্গের মেয়র রোলাঁ রিস। তাঁর শহরে দিব্যি চলে ঝাঁ চকচকে ট্রামগাড়ি। দূষণ তো নেই-ই। আলাদা করে স্টেশন তৈরিরও দরকার পড়েনি। নিচু মেঝে বলে প্রতিবন্ধীদেরও সুবিধে। সবথেকে বড় কথা, শহরের ঐতিহ্যের সঙ্গেও ব্যাপারটা বেশ খাপ খেয়েছে। রোলাঁ বলছেন, “নগরোন্নয়নে নতুন করে ভাবনাচিন্তা প্রয়োজন। লোকে বলে, রাস্তায় ট্রামলাইন থাকলে গাড়ির গতি কমে যাবে। কিন্তু তাঁদের বোঝাতে হবে, গাড়ির সংখ্যা বাড়তে বাড়তে এক সময় রাস্তায় কোনও ফাঁকা জায়গা থাকবে না। ট্রামের মতো পরিবহণ ব্যবস্থার কথা ভাবতেই হবে।”
নতুন করে অত্যাধুনিক ট্রাম চালু নিয়ে গোটা দেশে সমীক্ষা চালিয়েছিল নগরোন্নয়ন মন্ত্রকের ‘ইনস্টিটিউট অফ আরবান ট্রান্সপোর্ট’ এবং ফিকি। সেই সমীক্ষার রিপোর্টও বলছে, ট্রাম থাকলে গাড়ির গতি কমে যাবে এই ভুল ধারণা থেকেই ডুবেছে কলকাতার ট্রাম। বালিগঞ্জ, বেহালা, কাঁকুড়গাছি সব দিকেই আগে ট্রামের জন্য আলাদা উঁচু রাস্তা ছিল। পিচরাস্তা চওড়া করার তাগিদে সেই ট্রামরাস্তাকে চেঁছে সাফ করে দেওয়া হয়েছে। অথচ ট্রাফিকের যে ভীষণ গতি বেড়েছে, এমন নয়। বরং পিচরাস্তারই একপাশে কংক্রিটে ঢালাই করা লাইনে চলতে গিয়ে ট্রামের গতি আরও মন্থর হয়েছে (বেহালায় তো মেট্রোরেলের কাজের জেরে ট্রামের পাট উঠেই গিয়েছে)। দিন যত গড়িয়েছে, কলকাতা ট্রাম কোম্পানি (সিটিসি)-র পরিষেবার মান ততই পড়েছে, বেহাল হয়েছে আর্থিক দশা। সিটিসি-র বাস চালিয়েও লাভ হয়নি। উল্টে রাজ্য সরকারকে ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। অথচ কলকাতার অনেকেই চান, নতুন প্রযুক্তিতে শহরে ট্রাম চলুক।
সেই নতুন প্রযুক্তি কী? সমীক্ষা বলছে, অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে বিশ্বের বিভিন্ন শহরের ট্রাম এখন কম ওজনের রেল বা ‘লাইট রেল ট্রানজিট’-এ রূপান্তরিত হয়েছে। বিশ্বের সাড়ে তিনশোরও বেশি শহরে ট্রাম চলছে। আরও প্রায় সত্তরটি শহরে চলছে ট্রাম চালুর তোড়জোড়। বাস বা গাড়ির পাশে নিজস্ব আলাদা রাস্তা ধরে ট্রাম ছুটছে। স্টপেজের সংখ্যা কমিয়ে দেওয়ায় গতিও বেড়েছে। নতুন রেকগুলো বাঁক ঘুরতে জায়গা নেয় অনেক কম। ইচ্ছেমতো কামরা জোড়া বা বাদও দেওয়া যায়। সবথেকে বড় সুবিধে আর্থিক সাশ্রয়। এক কিলোমিটার মেট্রো রেল চালু করতে যেখানে ৩৫০ থেকে ৭০০ কোটি টাকা প্রয়োজন, সেখানে ট্রাম চালাতে খরচ হবে মাত্র ৮০ থেকে ১০০ কোটি। কমল নাথ বলেন, “যে সব শহরের জনসংখ্যা দশ লক্ষ, দ্বাদশ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় সেই শহরগুলিতে ট্রামের মতো পরিবহণ ব্যবস্থা চালুর সুপারিশ রয়েছে। এই ধরনের ৫৩টি শহর রয়েছে। মেগাসিটিতেও যে সব এলাকায় জনসংখ্যা তুলনায় কম, সেখানেও ট্রাম চালু করা যেতে পারে।”
|
পুরনো খবর: মহানগরে এ বার চলবে এসি ট্রাম |
|
|
|
|
|