শুরু থেকেই বিতর্ক সঙ্গী খাদ্য সুরক্ষা বিলের। বিস্তর বাধাবিপত্তি পেরিয়ে বাদল অধিবেশনের শেষ পর্বে বিলটি পাশ হয়েছে বটে, তবে বিতর্ক কমেনি। বরং বেড়েই চলেছে। কারণ, প্রকল্পটি রূপায়ণের আর্থিক দায়, কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক, অর্থনৈতিক ভাবে একেবারে প্রান্তিক মানুষের কাছে এর সুবিধা পৌঁছে দেওয়ার মতো বিষয়গুলি নিয়ে বেশ কিছু ধোঁয়াশা রয়ে গিয়েছে বিলটিতে।
আজই খাদ্য বিলে সম্মতি দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়। এর পর সেটির আইনে পরিণত হওয়ার অপেক্ষা। কিন্তু তার আগেই যে ভাবে রাজ্য সরকার ও বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছে তাতে বেজায় অস্বস্তিতে কেন্দ্র। এই সব জটিলতা ও সংশয় দূর করার জন্য আগামী ৩-৪ অক্টোবর দিল্লিতে রাজ্যের খাদ্যমন্ত্রীকে বৈঠকে ডেকেছেন কেন্দ্রীয় খাদ্যমন্ত্রী কে ভি টমাস। কিন্তু তাতে ওই জট কাটবে কি না, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। অথচ অস্পষ্টতাগুলি দূর করা না গেলে ভবিষ্যতে বড় ধরনের জট তৈরি হওয়ারও আশঙ্কা করছেন রাজনৈতিক দলগুলির নেতা থেকে শুরু করে প্রশাসনিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কর্তারা।
কেন্দ্রের ইউপিএ সরকার অঙ্গীকার করেছে, শহরে ৫০ শতাংশ ও গ্রামীণ এলাকার ৭৫ শতাংশ গরিব মানুষ এই সুরক্ষা পাবেন। কিন্তু বিলটি খতিয়ে দেখলে প্রথম যে খামতিটি নজরে আসছে তা হোল, একেবারে সহায়-সম্বলহীন, গৃহহীন মানুষরাই খাদ্যের অধিকার থেকে বঞ্চিত হবেন। খোলা আকাশের নীচে কিংবা ফুটপাথে যাঁরা জীবন কাটান, যাঁদের নাম সরকারের কোনও পরিসংখ্যানে নেই, তাঁদের খাদ্য সুরক্ষা দিতে দায়বদ্ধ থাকবে না সরকার। অথচ, প্রথম যে বিলটি লোকসভায় পেশ করা হয়েছিল, ওই সব নিঃস্বজনকে আইনের আওতায় আনার কথা বলা হয়। কিন্তু চূড়ান্ত বিলে তা নেই। ফলে দেশের একটি বড় জনসংখ্যা এর সুফল পাবে না বলেই অভিযোগ সমাজকর্মী দীপা সিংহের। খাদ্য সুরক্ষা বিল তৈরির সময় থেকেই বিষয়টির সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন তিনি।
প্রশ্ন উঠেছে খাদ্যশস্যের পরিমাণ নিয়েও। নতুন আইনে অন্ত্যোদয় অন্ন যোজনার বাইরে থাকা পরিবারের প্রত্যেককে মাসে ৫ কিলোগ্রাম খাদ্যশস্য দেওয়ার কথা। তাতে পূর্ণবয়স্ক ও শিশু দু’পক্ষেরই ভাগে পড়ছে দিনে ১৬৬ গ্রাম খাদ্যশস্য। এটা অবাস্তব। তা ছাড়া, ইন্ডিয়ান কাউন্সিল ফর মেডিক্যাল রিসার্চের সমীক্ষা বলছে, ভারতের মতো দেশে পূর্ণ বয়স্ক ব্যক্তির ১৪ কিলোগ্রাম ও শিশুর ৭ কিলোগ্রাম খাদ্যশস্য প্রয়োজন প্রতি মাসে। অর্থাৎ অপুষ্টিজনিত সমস্যা মোকাবিলা মূল লক্ষ্য হলেও খাদ্য সুরক্ষার নামে একটি শিশুকেও তার পুরো খোরাক দেওয়া হবে না। বড়দের তো নয়ই।
অপুষ্টির বিরুদ্ধে লড়াইটা কোন পর্যায় থেকে শুরু করা হবে, ধোঁয়াশা সেখানেও। অধিকাংশ শিশু যে-হেতু মায়ের গর্ভে থাকার সময় থেকেই অপুষ্টির শিকার হয়, তাই সরাসরি গর্ভবতী মায়েদের হাতে ১০০০ টাকা করে মোট ৬ হাজার টাকা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কেন্দ্র। কিন্তু সমস্যা সেখানেও। কোন মাস থেকে গর্ভবতী মায়েরা ওই টাকা পাবেন, রাজ্য না কেন্দ্র, কে ওই টাকা দেবে তার কোনও দিশা নেই বিলে।
বিভিন্ন নাগরিক সংগঠনের মতে, মূল সমস্যা আসবে কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কের ক্ষেত্রে। প্রকল্প রূপায়ণে কেন্দ্র ও রাজ্যের প্রশাসনিক ভূমিকার বিষয়ে স্পষ্ট উল্লেখ থাকলেও উভয় পক্ষের আর্থিক দায় কী দাঁড়াবে, তা বলা নেই বিলটিতে। যা পরে বড় জটিলতার জন্ম দিতে পারে। যেমন বিলে বলা রয়েছে, গর্ভবতী মায়েদের টাকা দেওয়ার বিষয়টি ছাড়াও শহরে-গ্রামে কারা ওই আইনের সুফল পাবেন সেই তালিকা বানাবে রাজ্য। কিন্তু সে কাজের খরচ কে বহন করবে, তা বলা নেই। কেন্দ্রের দেওয়া খাদ্যশস্যের বিজ্ঞানসম্মত সংরক্ষণ ও প্রান্তিক মানুষের কাছে তা পৌঁছে দেওয়ার খরচ কেন্দ্র-রাজ্যের মধ্যে কী সমীকরণে ভাগ হবে, তারও দিশা নেই বিলে। নতুন আইনে প্রতিটি রাজ্যকে একটি স্টেট ফুড কমিশনারের দফতর রাখতে হবে। সেই কমিশনারেট তৈরি ও চালানোর খরচ কে জোগাবে, খাদ্য মন্ত্রক সে বিষয়ে নীরব।
সংসদে পেশ করার আগে বিভিন্ন মহলের চাপে বিলটির একাধিক ধারায় পরিবর্তন করতে হয়েছে খাদ্যমন্ত্রীকে। তার পরেও এত ফাঁকফোকর নিয়ে এই আইন কার্যকর করে ভোটে কি তার ফায়দা পাবে কংগ্রেস? না কি মুলায়মের কথা মতো ‘নির্বাচনী গিমিক’ হয়েই থেকে যাবে গোটা বিষয়টি? সব চেয়ে বড় প্রশ্ন, এই বিল আইন হয়ে এলে আদৌ কি খাদ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করা যাবে দেশের ৬৭ শতাংশ গরিব মানুষের? সমাজকর্মীরা বলছেন, এখনও অনেক কিছু ভাবতে হবে সরকারকে।
|