বিয়াল্লিশ বছর আগে এক লোকসভা ভোটের মুখে দাঁড়িয়ে ‘গরিবি হটাও’ স্লোগান তুলেছিলেন ইন্দিরা গাঁধী। আজ আর এক লোকসভা ভোটের মুখে ক্ষুধা আর অপুষ্টির বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করলেন তাঁর পুত্রবধূ সনিয়া। গায়ে জ্বর নিয়েও সংসদে খাদ্য সুরক্ষা বিল সংক্রান্ত বিতর্কে বলতে উঠে আগামী বছরে কংগ্রেসের ভোট স্লোগানটাই স্পষ্ট করে দিলেন তিনি। বললেন, খাদ্যের অধিকারকে আইনি স্বীকৃতি দিয়ে ইতিহাস গড়তে চলেছে ভারত।
গত লোকসভা ভোটের আগে একশো দিনের কাজের মতোই এ বার খাদ্য সুরক্ষার যাবতীয় রাজনৈতিক সুফল কংগ্রেস পাবে জেনেও ক্ষুধা আর অপুষ্টি দূরীকরণের বিরুদ্ধে বিশেষ মুখ খুলতে পারেনি অন্য দলগুলি। এই বিল আনার সময় নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে তারা। সরকারের সমর্থক হয়েও মুলায়ম সিংহ বলেছেন, “আগে গরিব যখন না খেতে পেয়ে মারা যাচ্ছিলেন, তখন এই বিল আনা হয়নি কেন?” একে ‘ভোট সুরক্ষা বিল’ বলে কটাক্ষ করেছেন বিজেপি-র মুরলী মনোহর জোশী। বিলে নীতিগত সমর্থন জানিয়েও ৩৮ নম্বর ধারার বিরোধিতা করে তৃণমূলের কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, কেন্দ্র নির্দেশ দিলে রাজ্য তা মানতে বাধ্য এটা যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় রাজ্যের অধিকারের বিরোধী। কিন্তু দিনের শেষে নির্বিঘ্নেই পাশ হয়ে গিয়েছে খাদ্য সুরক্ষা বিল। এর পর রাজ্যসভায় পাশ হয়ে রাষ্ট্রপতির অনুমোদন পেলেই আইনি স্বীকৃতি পাবে খাদ্যের অধিকার।
মনমোহন সিংহের সরকার অবশ্য সংসদের অনুমোদনের অপেক্ষা না-করে ইতিমধ্যেই অর্ডিন্যান্স জারি করে দারিদ্রসীমার নীচে থাকা পরিবারের হাতে মাসে মাথাপিছু ৫ কেজি খাদ্যশস্য তুলে দেওয়ার পথ খুলে দিয়েছে। এই প্রকল্পে পুষ্টিকর খাবারের জন্য গর্ভবতী মহিলারা ন্যূনতম ৬ হাজার টাকা ভাতা পাবেন। তা ছাড়া, গরিব পরিবারের ১৪ বছর পর্যন্ত বয়সের ছেলেমেয়েদের রান্না করা গরম পুষ্টিকর খাবার সরবরাহ করবে সরকার। আর এ সবই আগামী লোকসভা ভোটে তাদের ফায়দা দেবে বলে আশায় বুক বাঁধছে কংগ্রেস।
সংসদে কোনও বিল নিয়ে বিতর্কে সাধারণত অংশ নেন না সনিয়া। তার উপরে গত কাল রাত থেকে ভাইরাল জ্বরে বেশ কাবু (ভোটাভুটির আগেই আরও অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছে তাঁকে)। কিন্তু খাদ্য সুরক্ষা যে তাঁরই মস্তিষ্ক প্রসূত। তাই অসুস্থতা উপেক্ষা করেই আজ দীর্ঘ ক্ষণ সংসদে বসে রইলেন কংগ্রেস সভানেত্রী। দলীয় প্রচারের নেতৃত্ব দিয়ে বললেন, “গত লোকসভা ভোটের ইস্তাহারে কংগ্রেস ঘোষণা করেছিল, ক্ষমতায় এলে মানুষের খাদ্যের অধিকারকে আইনি স্বীকৃতি দেবে। আমি খুশি, যে সেই প্রতিশ্রুতির পালন করা হচ্ছে। অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন, শেষমেশ সরকার কি এই প্রকল্প রূপায়ণ করতে পারবে? কিন্তু মনে করি, পারা না-পারার প্রশ্নই ওঠে না। আমাদের পারতেই হবে।”
সনিয়ার এই আক্রমণাত্মক ভূমিকার রাজনৈতিক বার্তা বুঝে পাল্টা কৌশল নিতে চেয়েছে বিরোধীরা। বিলে বলা হয়েছে, যেখানে খাদ্যশস্য সরবরাহ করা যাবে না, সেখানে টাকা দেওয়া হবে। এ নিয়ে প্রশ্ন তুলে লোকসভার বিরোধী দলনেত্রী সুষমা স্বরাজ বলেন, টাকা দিলে পরিবারের পুরুষরা খাবার নয়, মদেই তা খরচ করবে। টাকা মহিলা সদস্যের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে জমা পড়লেও তা কেড়ে নেওয়া হবে।
প্রশ্ন ওঠে দারিদ্রসীমার ঠিক ওপরে থাকা পরিবারগুলিকে ভর্তুকি মূল্যে দেওয়া খাদ্যশস্যের পরিমাণ কমানো নিয়েও। এখন তারা কম দামে মাসে ৩৫ কেজি খাদ্যশস্য পায়। সেই প্রকল্প বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। এ নিয়ে বিজেপি, এডিএমকে-সহ বিভিন্ন দলের আপত্তির উত্তরে খাদ্যমন্ত্রী কে ভি টমাস বলেন, সরকারের ক্ষমতা সীমিত। এমনিতেই ৮২ কোটি মানুষের খাদ্য সুরক্ষা সুনিশ্চিত করতে গিয়ে সরকারের ১৩০ কোটি টাকা খরচ হবে। ফলে ওই প্রকল্প চালু রাখা যাবে না। কিন্তু এর ফলে দারিদ্রসীমার ঠিক উপরে থাকা পরিবারগুলির ক্ষতি হবে না বলেই তাঁর দাবি। কারণ, গ্রামের ৭৫ শতাংশ ও শহরের ৫০ শতাংশ মানুষকে খাদ্য সুরক্ষার আওতায় আনা হচ্ছে। অতএব বরাদ্দ কমলেও আগের চেয়ে কম দামে মাসে মাথাপিছু ৫ কেজি খাদ্যশস্য পাবে দারিদ্রসীমার উপরে থাকা অনেক পরিবারই। এখন তারা চাল কেনে ৮ টাকা কেজি দরে। খাদ্য সুরক্ষার আওতায় এলে দিতে হবে ৩ টাকা। গমের দামও ৬ টাকা কেজি থেকে কমে ২ টাকা হবে।
ভোট বাজারে খাদ্য সুরক্ষা বিলের সবটুকু ফায়দা তুলতে আজ বিরোধীদের যাবতীয় আপত্তিই উড়িয়ে দিয়েছে শাসক দল। বিরোধীদের কোনও সংশোধনীই পাশ করাতে দেয়নি তারা। তাদের যে সব সংশোধনী গ্রহণযোগ্য বলে মনে করেছে, তার সবই সরকারি সংশোধনী করে নিয়েছে।
তবে বিরোধীদের উৎকণ্ঠার জবাবও আজ দিতে চেয়েছেন সনিয়া। তাঁর কথায়, “খাদ্য সুরক্ষা আইন প্রণয়ন শুভারম্ভ মাত্র। প্রকল্প রূপায়ণ করতে গিয়ে কোনও ত্রুটিবিচ্যুতি ধরা পড়লে তা শুধরে নেওয়া হবে।”
একই আশ্বাস দেন খাদ্যমন্ত্রী কে ভি টমাসও। তিনি বলেন, “খাদ্য সুরক্ষা প্রকল্প তখনই সম্ভব হবে, যখন কেন্দ্র ও রাজ্য সুষ্ঠু সমন্বয় করে চলবে। প্রকল্প রূপায়ণ করতে গিয়ে কোনও রাজ্য সমস্যার সন্মুখীন হলে কেন্দ্র যথাসাধ্য সাহায্য করবে।”
|