বর্ষায় বার বার ভাসছে রাইপুরের ভৈরববাঁকির কজওয়ে। বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে বাঁকুড়ার জঙ্গল মহলের একাংশ। কিন্তু সেতু তৈরির টাকা এসেও পড়ে থাকলেও কাজ শুরু হয়নি এখনও। তাই ক্ষোভ বাড়ছে মানুষের মধ্যে।
বাঁকুড়া জেলায় বেশ কয়েকটি কজওয়ে নিয়ে একই সমস্যা থাকলেও ২০১২ সালের ৬ সেপ্টেম্বর এখানেই নদীর জলে বাস ভেসে গিয়ে ঘটেছিল সাম্প্রতিক কালে জেলার সব চেয়ে বড় মর্মান্তিক দুর্ঘটনা। এলাকার বাসিন্দাদের স্মৃতিতে এখনও টাটকা সে দিনের ঘটনা। ভৈরববাঁকির কজওয়ের উপর দিয়ে তীব্র স্ত্রোতে বয়ে যাচ্ছিল নদীর জল। যাত্রী নিয়ে কজওয়েতে নামতেই বেসামাল বাস ভেসে গেল। জলে পড়ে গেলেন বাসের ছাদে ও ভিতরে থাকা কিছু যাত্রী। প্রশাসনের তৎপরতায় নদী থেকে অধিকাংশকে উদ্ধার করা গেলেও প্রাণ গেল শিশু, মহিলা-সহ আট যাত্রীর। |
বর্ষায় বার বার ডুবে যায় ভৈরববাঁকির এই কজওয়ে। —নিজস্ব চিত্র। |
দুর্ঘটনার পরের দিন এলাকায় গিয়ে বাসিন্দাদের বিক্ষোভের মুখে পড়ে জেলা তৃণমূলের চেয়ারম্যান তথা রাজ্যের শিশু কল্যাণ মন্ত্রী শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় কজওয়ের বদলে সেতু তৈরির আশ্বাস দিয়েছিলেন। পরে জেলা সফরে আসা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে রাইপুরের বিডিও কিংশুক মাইতি ওই সেতু নির্মাণের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন। মুখ্যমন্ত্রী আশ্বাস দিয়েছিলেন। জেলা প্রশাসন জানাচ্ছে, মাস চারেক আগে ওই সেতু নির্মাণের ৫ কোটি ২৫ লক্ষ টাকা বরাদ্দ হয়েছে। কিন্তু টেন্ডার না ডাকায় সেই কাজই শুরু করা যায়নি।
রাইপুরের বিডিও কিংশুক মাইতি বলেন, “ভৈরববাঁকি নদীর উপরে সেতু নির্মাণের দায়িত্ব রাজ্য পূর্ত দফতরের (সড়ক)। ওই সেতু তৈরির প্রাথমিক সমীক্ষার কাজও শেষ হয়ে গিয়েছে। টাকাও চলে এসেছে।” রাজ্য পূর্ত দফতরের (সড়ক) বাঁকুড়া ডিভিশনের এগ্জিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার সৌগত সরকার অবশ্য বলেন, “ভৈরববাঁকি নদীর উপরে অমৃতপাল গ্রামে প্রায় ৩০০ ফুট লম্বা ও ২০ ফুট চওড়া সেতু নির্মাণের জন্য ৫ কোটি ২৫ লক্ষ টাকা বরাদ্দ হয়েছে। সমস্ত পরিকল্পনার কাজ সারা। বর্ষা শেষ হলেই কাজ শুরু করা হবে। শীঘ্রই টেন্ডার ডাকা হবে।”
বাঁকুড়া-ঝাড়গ্রাম রাজ্য সড়কের উপর অমৃতপালে ১০০ ফুট লম্বা এই কজওয়ে ভারী বর্ষণেই ভৈরববাঁকির জলে ডুবে যায়। এ বারই নিম্মচাপের বৃষ্টিতে দফায় দফায় বেশ কিছু দিন ওই কজওয়েতে যান চলাচল বন্ধ ছিল। এর ফলে বিস্তীর্ণ হয়ে পড়ে রাইপুর ও বারিকুল থানার বহু এলাকা। পাশাপাশি একই সমস্যায় পড়ে যান পশ্চিম মেদিনীপুরের বেলপাহাড়ি, বিনপুর ও লালগড় থানার বিস্তীর্ণ এলাকার মানুষ। রাইপুর ব্লক সদরের সঙ্গে পুরোপুরি যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে ফুলকুসমা, ঢেকো, মেলেড়া পঞ্চায়েতের প্রায় ৪০টি গ্রাম। অনেকে ঝুঁকি নিয়েও নদী পার হন। এ ভাবে গত কয়েক বছরে বেশ কয়েকটি দুর্ঘটনা ঘটেছে। |
কজওয়ে-কাণ্ড |
|
• ২০০৬ সাল পিকআপ ভ্যান ভেসে গিয়ে মৃত দুই আরোহী
• ২০০৭ সাল ভেসে যায় মোটরবাইক। প্রাণে রক্ষা চালক
• ২০১০ সাল গরু, মোষ, ছাগল ভেসে গেল
• ২০১২ সাল বাস পড়ল নদীতে। শিশু-সহ মৃত আট |
|
তাই এই কজওয়ের পাশে সেতু তৈরির দাবি দীর্ঘদিনের। গত বছরের দুর্ঘটনার পরে সেতু তৈরির দাবি আরও জোরদার হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রীর আশ্বাসের পরে সেতুর আশায় বুক বেঁধেছেন জঙ্গলমহলের মানুষ। কিন্তু বাস্তবে সেতু তৈরির উদ্যোগ এখনও চোখে না পড়ায় তাঁরা হতাশ। বাসিন্দাদের দাবি, প্রতিদিন গড়ে এই রাস্তায় বাস, ট্রাক, ছোটগাড়ি-সহ প্রায় হাজারখানেক গাড়ি যাতায়াত করে। বারিকুলের লুড়কা দেশবন্ধু হাইস্কুলের শিক্ষক বারিদবরণ মাহাতো বলেন, “বর্ষাকালে প্রায় দিনই ভৈরববাঁকি নদীর জল ওই কজওয়ের উপর দিয়ে বইতে থাকে। তখন রাইপুর থেকে ঘুরপথে জানডাঙা মোড় পেরিয়ে জাতাডুমুর ড্যামের উপর দিয়ে প্রাণ হাতে করে প্রায় ১৫ কিমি রাস্তা পেরিয়ে স্কুলে যেতে হয়।” রাইপুরের জয়নগর গ্রামের বাসিন্দা বাঁকুড়া খ্রিস্টান কলেজের ছাত্রী চায়না মণ্ডলের অক্ষেপ, “কতদিন কলেজে যাওয়ার জন্য বেড়িয়ে কজওয়েতে জল দেখে বাড়ি ফিরে যেতে হয়।” লুড়কা গ্রামের বাসিন্দা মলয় পাত্র, অমৃতপাল গ্রামের বাসিন্দা সুদর্শন মাহাতোদের আশা, সেতু তৈরি হলে বর্ষাকালে দুই জেলার মানুষের যাতায়াতের পথ মসৃণ হবে। কিন্তু সেতু তো হল না।
রাইপুরের সিপিএম বিধায়ক উপেন কিস্কুর টিপ্পনী, “গত এক বছর ধরে শুনছি ভৈরববাঁকিতে উঁচু সেতু হবে। তৃণমূলের নেতা, মন্ত্রীরা গালভরা প্রতিশ্রুতি দিলেও কাজ তো কিছুই করছে না।” তবে বাঁকুড়া জেলা পরিষদের সদস্য তথা জেলা তৃণমূলের অন্যতম সম্পাদক শ্যামল সরকার দাবি করছেন, “সিপিএমের সরকার এতদিন ধরে যে কাজ করেনি, সেই কাজই আমাদের মুখ্যমন্ত্রী দ্রুততার সঙ্গে করে দেখাচ্ছেন। সেতুর কাজ শীঘ্রই শুরু হবে।”
সেতু দেখার অপেক্ষায় রয়েছেন জঙ্গলমহলের মানুষ। |