পঞ্চায়েতে সারদা
ক্ষতিপূরণের প্রত্যাশাই পুঁজি
তৃণমূলের, মানে সিপিএম-ও

কার্তিক লক্ষ্মণ পেশায় তাঁতি। অন্যের তাঁতযন্ত্র চালিয়ে দিনমজুরি জোটে ৮০ টাকা। তিল তিল করে বিশ হাজার টাকা জমিয়েছিলেন, যাতে নিজের তাঁত বসাতে পারেন। সেই পুঁজি সারদা লগ্নিসংস্থায় রেখে এখন কপাল চাপড়াচ্ছেন। পড়শি তাঁতি ধনঞ্জয় লক্ষ্মণ নিজের আড়াই লাখ ছাড়াও সাড়ে তিনশো জনের থেকে মোট প্রায় ৫৫ লাখ টাকা তুলে সারদায় জমা রেখেছিলেন। এখন রাতের ঘুম ছুটেছে। “সকলে দিনমজুর। রোজ অন্তত পাঁচ-দশ জন বাড়িতে চড়াও হচ্ছে।” বলছেন ধনঞ্জয়।
কার্তিক-ধনঞ্জয় বাঁকুড়ার কেঞ্জাকুড়ার বাসিন্দা। জেলা সদরের ১৬ কিলোমিটার দূরের জনপদটিতে সারদার প্রথম এজেন্ট যিনি, সেই বুদ্ধদেব বীর জানাচ্ছেন, ২০১০-এর ফেব্রুয়ারিতে ওখানে সারদার পদার্পণ। রমরমা শুরু ২০১১-র মাঝামাঝি, তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পরে। বুদ্ধবাবুর কথায়, “সারদার সঙ্গে শাসকদলের নেতাদের মাখামাখি দেখে আমরা ভরসা পেয়েছিলাম। লোকজনকে তাই টাকা রাখতে বলেছিলাম।”
গত ১৬ এপ্রিল সারদা ঝাঁপ গুটিয়ে নেওয়ার পরে ভরসা টুটে গিয়েছে। এ অবস্থায় সর্বস্বান্ত মানুষ সপরিবার শাসকদলের প্রতি ক্ষোভ ভোটবাক্সে উগরে দেবেন, এমনটাই মনে করেছিলেন অনেকে। অথচ কেঞ্জাকুড়ায় পঞ্চায়েতের ফল উল্টো কথা বলছে! ১৯৭৮-এ নির্বাচন শুরু হওয়া ইস্তক এই প্রথম কেঞ্জাকুড়া গ্রাম পঞ্চায়েত বামফ্রন্টের হাতছাড়া হয়েছে শুধু নয়, সিপিএম হেরেছে বড় ব্যবধানে। ১৭টি আসনের মধ্যে ১১টি তৃণমূল, সিপিএম সাকুল্যে ৬।
এ নিছক কেঞ্জাকুড়া বা বাঁকুড়া জেলার চিত্র নয়। গোটা রাজ্যে বলতে গেলে মোটামুটি একই ছবি। সিপিএম যেমন আশায় ছিল, তেমন তৃণমূল নেতৃত্বেও আশঙ্কা দানা বেঁধেছিল যে, সারদার জের তাঁদের ভুগতে হবে। কিন্তু হয়নি। বরং বামেদের ভোটব্যাঙ্কে ধস নেমেছে। কেন?
সিপিএম রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য তথা বাঁকুড়ার জেলা সম্পাদক অমিয় পাত্রের পর্যবেক্ষণ, “আমানতকারীরা আশা করেছেন, টাকা ফেরত দিলে তৃণমূল সরকারই দেবে। এজেন্টরা ভেবেছেন, তৃণমূল সরকারই তাঁদের বাঁচাবে।” কাজেই ওঁরা শাসক দলকে বেছেছেন। এমনকী, বাম সমর্থক আমানতকারীদের একটা অংশও টাকা ফেরতের আশায় ঘাস-ফুলে ছাপ্পা দিয়েছেন বলে সিপিএম নেতাদের কারও কারও দাবি। কেঞ্জাকুড়ায় কান পাতলেও যার প্রতিধ্বনি।
যেমন গৃহবধূ মুক্তা হেঁসের সাফ কথা, “সারদা আমাদের সব খেয়েছে। তা-ও তৃণমূলকে ভোট দিয়েছি। সবাই বলেছে, ভোটের পরে সরকার টাকা ফেরত দেওয়াবে।” হেঁস দম্পতি মেয়ের বিয়ের জন্য আধপেটা খেয়ে ২৫ হাজার টাকা জমিয়ে সবটাই সারদায় রেখেছিলেন। কার্তিক লক্ষ্মণ বলেন, “সরকার কথা দিয়েছে, টাকা ফেরত পাওয়া যাবে। তাই ওদের ভোট দিয়েছি।” এজেন্ট দীপঙ্কর বাউরির মন্তব্য, “মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, টাকা ফেরাতে সরকার বদ্ধপরিকর। তাই চেয়েছি, ওঁরাই থাকুন।”
কেঞ্জাকুড়া গ্রাম পঞ্চায়েতের বাসিন্দা হাজার বিশেক। অধিকাংশ নিম্নবিত্ত, পেশায় তাঁতি। সারদার জনা পঁয়ত্রিশ এজেন্ট মিলে হাজার দুয়েক লোকের থেকে প্রায় দু’কোটি টাকা তুলে সারদায় জমা রেখেছিলেন। এজেন্ট আদিত্য লক্ষ্মণের আক্ষেপ, “অবিশ্বাস করব কী করে? সারদার অনুষ্ঠানে গিয়ে দেখেছি, মন্ত্রী প্রদীপ জ্বালছেন, তৃণমূলের এমপি-রা মঞ্চে বসা! মুখ্যমন্ত্রী সারদার অ্যাম্বুল্যান্স উদ্বোধন করেছেন! তখন তো ঘুণাক্ষরেও কিছু বোঝা যায়নি!” কিন্তু বোঝার পরেও শাসক দলের বিপুল জয়ের কারণ কী, তা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে সিপিএম নেতাদের মুখে ঘুরে ফিরে আসছে সরকারের তরফে টাকা ফেরানোর প্রতিশ্রুতি ও জনগণের প্রত্যাশার প্রসঙ্গই। কী রকম?
পার্টির কেঞ্জাকুড়া লোকাল কমিটির সম্পাদক সুদেব পাৎসা থেকে শুরু করে অমিয়বাবু, কিংবা রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য রবীন দেব সকলে মোটামুটি একমত যে, শ্যামল সেন কমিশন গঠন ও টাকা ফেরাতে মুখ্যমন্ত্রীর পাঁচশো কোটির তহবিল তৈরির ঘোষণা রাজ্য জুড়ে ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে, যার প্রতিফলন পড়েছে ব্যালটে। সুদেববাবু বলেন, “অনেক জায়গায় আমানতকারীদের হয়ে এজেন্টরাই কমিশনে আবেদনের ফর্ম পূরণ করে পাঠিয়েছেন। এতে মানুষের আশা বেড়েছে। তাঁদের ভোট তৃণমূল পেয়েছে।” রবীনবাবুর মতে, “সারদার সঙ্গে তৃণমূল নেতাদের ঘনিষ্ঠতার কথা জেনেও অধিকাংশ আমানতকারী ও তাঁদের পরিবার শাসক দলকে ভোট দিয়েছেন। একটাই আশায় টাকা ফেরত পাবেন।”
সব জেলাতেই কম-বেশি এটা দেখা গিয়েছে বলে রবীনবাবুর পর্যবেক্ষণ। এটাই কি একমাত্র কারণ?
এখানে উঠে আসছে পালাবাদলের আগের প্রসঙ্গ। বাম জমানায় কেন সারদা-রথে রাশ টানা হয়নি, সেই অভিযোগ। এবং কোন ভরসায় মানুষ বিকল্প সন্ধান করবে, সেই প্রশ্ন। তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায়ের দাবি, “সারদার সৃষ্টি ও সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা বামফ্রন্ট জমানায়। সাধারণ মানুষ তা জানেন। পাশাপাশি তাঁরা দেখছেন, ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে দাঁড়াতে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভূমিকা কতটা সদর্থক।” তাই সিপিএম ‘যাবতীয় অপপ্রচার’ চালিয়েও পঞ্চায়েত ভোটে রাজনৈতিক ফায়দা তুলতে পারেনি বলে মনে করেন মুকলবাবু।
এই সুরই প্রকট রাইপুরে। বাঁকুড়া জেলার একেবারে দক্ষিণে, জঙ্গলমহলের গ্রাম পঞ্চায়েত। জেলা সদর থেকে ৭০ কিলোমিটার। জনসংখ্যা প্রায় চল্লিশ হাজার। তুলনায় স্বচ্ছল এলাকাটিতে মূল জীবিকা
ব্যবসা ও চাষবাস। রাইপুরে সারদার এজেন্ট ছিলেন অন্তত আড়াইশো। তাঁদের অন্যতম বুল্টন সাহা
জানালেন, সব মিলিয়ে তাঁরা প্রায় ২০ কোটি টাকা সারদায় রেখেছিলেন। আমানতকারী অশোক দুলের
প্রশ্ন, “সিপিএম সারদার জন্ম দিয়েছে, আর তৃণমূল জামাকাপড় পরিয়েছে। শুধু তৃণমূলকে দায়ী করব কেন?”
১৩-৩ ব্যবধানে রাইপুর গ্রাম পঞ্চায়েতও জিতে নিয়েছে তৃণমূল। বাঁকুড়ার সদ্য প্রাক্তন জেলা সভাধিপতি তথা সিপিএম জেলা কমিটি সদস্য পার্থপ্রতিম মজুমদার খোলাখুলি বলছেন, “রাইপুরের উপরবান্ধা, দেউলি বা মণিপুরে পঞ্চায়েতের প্রচারে সারদা নিয়ে তৃণমূলের বিরুদ্ধে মুখ খুললেই পাল্টা প্রশ্নবাণ ধেয়ে এসেছে। শুনতে হয়েছে, সারদার জন্ম তো আপনাদেরই সময়ে!” পার্টির জেলা কমিটি সদস্য শ্যামসুন্দর সিংহ মহাপাত্র ও রাইপুর জোনাল সম্পাদক ধ্রুবলোচন মণ্ডলের উপলব্ধি, “প্রচারে আমরা সারদা কেলেঙ্কারিকে তৃণমূলের বিরুদ্ধে হাতিয়ার করতে পারিনি। এটা সাংগঠনিক দুর্বলতা।”
বস্তুত সিপিএম নেতৃত্বের একাংশের মতে, সারদা নিয়ে মানুষের ‘স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনের’ ভরসায় বসে থাকারই খেসারত দিতে হয়েছে দলকে। অমিয়বাবুর কথায়, “আমরা ভেবেছিলাম, সারদার অফিস ভাঙচুর, এজেন্টদের মারধর এ সব অচিরে রাজ্য জুড়ে তৃণমূল-বিরোধী গণবিক্ষোভের চেহারা নেবে। আমাদের দলীয় ভাবে কিছু করতে হবে না।” বাস্তবে ওই দমকা হাওয়া ঝড়ে পরিণত হয়নি। “আসলে সারদার টাকা ফেরানোর ব্যাপারে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে সব প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তাতে ভোটের রাজনীতিতে তিনি আপাতত ফায়দা তুলবেনই। কিছু করার নেই।” স্বীকারোক্তি অমিয়বাবুর।
সরকার প্রতিশ্রুতি না-রাখলে?
কেঞ্জাকুড়ায় সারদার শতাধিক আমানতকারীর এজেন্ট আদিত্যবাবু বলছেন, “আমরা রাজনীতি করি না। টাকা ফেরত পাওয়ার আশায় এ বার তৃণমূলকে ভোট দিয়ে জিতিয়েছি। লোকসভা ভোটের আগে টাকা না-পেলে আমরাই অন্য রাস্তা দেখব।” জনগণেশের প্রত্যাশা পূরণ হবে কি না, হলে বা না-হলে রাজনীতির দান ওল্টাবে কি না এমন যাবতীয় প্রশ্নের উত্তর আপাতত ভবিষ্যতের গর্ভে।

পুরনো খবর:



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.