আমানতকারীদের প্রাপ্য মেটাতে ভুঁইফোঁড় অর্থলগ্নি সংস্থাগুলির সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার আইনি ক্ষমতা হাতে পেতে চায় রাজ্য। একই সঙ্গে বর্তমান পরিস্থিতিতে যে সংস্থার এজেন্টরা আমানতকারীদের টাকা ফেরত দিতে না পেরে পথে নেমেছেন, তাঁদের আদালতে যাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছে সরকার। সরকারের বক্তব্য, ওই এজেন্টরা আদালতে গিয়ে অর্থলগ্নি সংস্থার মালিকের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে টাকা ফেরতের আবেদন করুন।
সারদা সংস্থায় একাধিক অনিয়মের অভিযোগকে কেন্দ্র করে টানাপোড়েনের পরিপ্রেক্ষিতে শুক্রবার দিনভর এই ধরনের সংস্থাগুলির কার্যকলাপ পর্যালোচনার জন্য দফায় দফায় বৈঠক করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সরকার যে কোনও ভুইফোঁড় অর্থলগ্নি সংস্থার ‘জনবিরোধী’ কাজ বরদাস্ত করবে না, তা অফিসারদের জানিয়ে দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি বলেছেন, এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় যে কোনও রকম পদক্ষেপ করতে হবে। দলের যাঁরা এই ধরনের সংস্থার সঙ্গে লেনদেন করেছেন, তাঁদেরও সেই সংক্রান্ত বিশদ তথ্য মহাকরণে পাঠাতে বলা হয়েছে।
ইতিমধ্যেই রাজ্যের এই ধরনের ভুঁইফোড় অর্থলগ্নি সংস্থাগুলির ব্যাপারে তদন্ত শুরু করেছে সিকিউরিটি অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ বোর্ড অফ ইন্ডিয়া বা সেবি। সোমবার সেবি-র একটি বিশেষ দল রাজ্যে আসবে বলে জানা গিয়েছে। কোম্পানি বিষয়ক দফতরের ‘সিরিয়াস ফ্রড ইনভেস্টিগেশন অফিস’ বা এসআইএফও সারদা গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে আলাদা ভাবে তদন্ত শুরু করেছে। |
মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ির সামনে। সুবিচার চেয়ে সমাবেশ, কালীঘাটে শুক্রবার। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক |
ভুঁইফোঁড় সংস্থাগুলির অনিয়ম রোখার বিষয়ে রাজ্য সরকার যে ভাবে তৎপরতা দেখাচ্ছে তাতে খুশি অর্থ মন্ত্রক। কর্পোরট বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী সচিন পায়লটও বলেন, “আমি সম্প্রতি কলকাতা গিয়েছিলাম। তখন রাজ্য সরকারের সঙ্গে আমার এ বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। এ ব্যাপারে আমার মন্ত্রক অর্থ মন্ত্রকের সঙ্গে সমন্বয় রেখে তদন্ত শুরু করেছে। রাজ্য সরকার যে ভাবে সংস্থাগুলির বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করেছে তাতে কেন্দ্র খুশি। সংস্থাগুলির বিরুদ্ধে জালিয়াতির অভিযোগ প্রমাণিত হলে ভারতীয় দণ্ডবিধি অনুসারে শাস্তি দেওয়া হবে।”
বর্তমান পরিস্থিতিতে রাজ্য সরকারের একমাত্র লক্ষ্য, যে কোনও মূল্যে বিনিয়োগকারীদের টাকা ফেরতের ব্যবস্থা করা। সেই সঙ্গে যারা এই কারবারে যুক্ত হয়ে জালিয়াতি-প্রতারণা করেছে, তাদের গ্রেফতার করার জন্যও পুলিশকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। শুক্রবার দিনভর অর্থ দফতরের অর্থনৈতিক অপরাধ দমন শাখার কর্তারা এ নিয়ে বৈঠক করেন। কী ভাবে এই ধরনের সংস্থাগুলির বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ মোকাবিলা করা হবে, তা নিয়ে আলোচনা হয়। দেখা যাচ্ছে, সরকারের হাতে আর্থিক অপরাধ দমনের জন্য কোনও আইন নেই। পুরনো চিট ফান্ড আইনের আওতায় এই সংস্থাগুলি পড়ে না। কারণ, এরা কেউই চিট ফান্ডের কারবার করে না। প্রেফারেন্সিয়াল শেয়ার, ডিবেঞ্চার, কোম্পানি ডিপোজিটের মাধ্যমে সংস্থাগুলি টাকা তুলেছে। বর্তমান আইনে এমন ধরনের অপরাধ হলে ব্যবস্থা নেওয়ার মতো কিছুই নেই। ফলে সরকারের হাত-পা বাঁধা।
তা হলে উপায়?
অর্থ দফতরের কর্তারা জানাচ্ছেন, এখনই ব্যবস্থা নিতে হলে ফৌজদারি বিধি অনুযায়ী পদক্ষেপ করা যায়। সরাসরি প্রতারণা, জালিয়াতি, বিশ্বাসভঙ্গ ইত্যাদি মামলা করে যেতে পারে। যে হেতু রাজ্যজুড়ে অসংখ্য মামলা রুজু হতে পারে, সে ক্ষেত্রে সংস্থা মালিকদের একবার ধরা গেলে নানা মামলায় তাদের আটকে রাখা যাবে। তত দিনে আর্থিক আইনটি চলে এলে তাদের সম্পত্তি আদায়ের বিষয়টিও কার্যকর করা যাবে। অর্থনৈতিক অপরাধ দমন শাখাটি পোক্ত করার জন্য ইতিমধ্যেই পদক্ষেপ করতে শুরু করেছে রাজ্য। দীর্ঘদিন ধরেই এই শাখার সিনিয়র অফিসারদের পদগুলি খালি পড়ে রয়েছে। সেখানে পুরনো অফিসারদের ফেরত আনার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। |
মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ির সামনে এজেন্টদের বিক্ষোভ। —নিজস্ব চিত্র |
অর্থ দফতরের কর্তারা জানাচ্ছেন, রাষ্ট্রপতির সম্মতি আদায় করে নতুন আইন কার্যকর হতে অন্তত এক-দেড় বছর সময় লেগে যাবে। তত দিনে শুধু সারদা গোষ্ঠী নয়, অন্য সংস্থাগুলিও মুখ থুবড়ে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে। তেমনটা হলে রাজ্যজুড়ে আইন-শৃঙ্খলার বড় ধরনের অবনতি হতে পারে বলেও আশঙ্কা রয়েছে। সেই কারণে মহাকরণ থেকে জেলা প্রশাসনকে বলা হয়েছে, আপাতত পুলিশ দিয়েই পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হবে। ভুঁইফোঁড় সংস্থার এজেন্ট, কর্মী, বিনিয়োগকারী যে কেউ অভিযোগ করলেই মামলা শুরু করতে বলা হয়েছে। যেখানেই বিক্ষোভ হবে, সেখানেই পুলিশ যাতে বিক্ষোভকারীদের কাছ থেকে অভিযোগ নিয়ে রাখে, সেই নির্দেশও পাঠানো হয়েছে। রাজ্যের এক পুলিশ কর্তা জানান, শুক্রবার মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ির সামনে পর্যন্ত বিক্ষোভ হয়েছে। আগামী কয়েক দিন অত্যন্ত সতর্ক থাকার জন্য জেলাগুলিকে বলে দেওয়া হয়েছে। গোয়েন্দারা জানিয়েছেন, সারা রাজ্যেই সারদা গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। ফলে যে কোনও স্থানে ক্ষোভে ফেটে পড়তে পারেন মানুষ।
সরকার যে বিনিয়োগকারীদের অর্থ উদ্ধারের জন্য সচেষ্ট, এখন সেই বার্তাই দেওয়া হচ্ছে। সে জন্য ভূমি দফতরকে বলা হয়েছে, সংস্থাগুলির বেনামী সম্পত্তি (অধিকাংশ সংস্থাই জমি-বাড়িতে লগ্নি করে টাকা সরিয়ে নিয়েছে) খুঁজে বের করতে। ভূমি দফতর ইতিমধ্যেই বেশ কয়েকটি সংস্থার কয়েক হাজার একর বেনামী জমির সন্ধান পেয়েছে। সেই জমি খাস ঘোষণা করে সরকার তা নিজের হাতে নিতে পারে। এ ছাড়া পুলিশ সংশ্লিষ্ট সংস্থার ব্যাংক অ্যাকাউন্টগুলিও বাজেয়াপ্ত করবে। এই ধরনের একাধিক ভুঁইফোঁড় সংস্থার সঙ্গে কিছু দিন আগে পর্যন্ত সরকারের ভালো রকম ঘনিষ্ঠতা ছিল। কখনও সরকারের ডাকে সাড়া দিয়ে মোবাইল মেডিক্যাল ভ্যান চালু করেছে কোনও সংস্থা। কখনও আবার এই সব সংস্থার প্রকাশিত কাগজ সরকারি গ্রন্থাগারে রাখার নির্দেশ জারি করা হয়েছে। এখন পরিস্থিতি বুঝে এই সংস্থাগুলি থেকে দূরত্ব বাড়াচ্ছে রাজ্য সরকার।
|