আইন নেই, শিকার বাড়ছে
ভুঁইফোঁড় অর্থলগ্নি সংস্থার
দিনে ১০ টাকা। দু’বছরে ৭,৩০০ জমালে ফেরত পাওয়া যাবে ১২,০০০। টাকা প্রায় দ্বিগুণ করার এমন টোপ দেখিয়ে উড়ে গিয়েছে পাখি। বিশ্বাস করে টাকা দিয়ে পথে বসেছেন ভ্যানরিকশা চালক বাঁকু মণ্ডল। সঙ্গে তাঁর মতোই আরও অনেকে। পশ্চিমবঙ্গে ভুঁইফোঁড় অর্থলগ্নি সংস্থার হাতে বাঁকুর মতো শিকারের সংখ্যা বেড়েই চলেছে।
বারাসত স্টেশনের স্ট্যান্ডে ভ্যানরিকশা রাখেন বাঁকু। দিনে আয় কম-বেশি ২০০ টাকা। বছর দু’য়েক আগে ওই রিকশা স্ট্যান্ডেই সনত্‌ নামে এক যুবকের সঙ্গে আলাপ। সেই সূত্রে জনা পাঁচেক ভ্যানচালক মিলে সনতের কাছে ‘ডেলি সেভিংস পলিসি’ করেন বাঁকুবাবুরা। টাকার রসিদও দেওয়া হয় একটি অর্থলগ্নি সংস্থার নামে। বাঁকুর অভিজ্ঞতা, “রোজ স্ট্যান্ড থেকে টাকা নিয়ে যেতেন সনত্‌। আমাদের প্রত্যেকের যখন হাজার পাঁচেক করে জমানো হয়ে গিয়েছে, সনত্‌বাবু হঠাত্‌-ই আসা বন্ধ করে দিলেন। মধ্যমগ্রামে নিজের বাসার যে ঠিকানা দিয়েছিলেন সনত্‌বাবু সেখানে গিয়ে জানা গেল, ওই নামে কেউ কোনও দিন ওখানে ছিলই না। টাকা জমা দেওয়ার রসিদে যে কোম্পানির নাম-ঠিকানা লেখা ছিল, অনেক খোঁজ করেও তার হদিস করতে পারিনি।”
এ ধরনের ভুঁইফোঁড় অর্থলগ্নি সংস্থাগুলি নিজেদের ‘নন-ব্যাঙ্কিং ফিনান্স’ সংস্থা হিসেবে পরিচয় দেয় এবং প্রতারণা করে পাওয়া টাকায় সংস্থার কর্তারা শহর বদলে ব্যবসা ফাঁদেন বলে জানালেন রিজার্ভ ব্যাঙ্কের এক কর্তা। কিন্তু সরকার স্বীকৃত ‘নন-ব্যাঙ্কিং ফিনান্স’ সংস্থার কর্তারা বলছেন, “নন-ব্যাঙ্কিং ফিনান্স সংস্থা হতে গেলে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের অনুমতি লাগে। ভুঁইফোঁড় সংস্থাগুলোর একটা বড় অংশের সেই অনুমোদন নেই। এদের বেশির ভাগই ‘কোম্পানিজ অ্যাক্ট’-এ নথিভুক্ত। ওই ভাবে নথিভুক্ত সংস্থাগুলি টাকা জমা নেওয়া বা দেওয়া কোনওটাই করতে পারে না।” কিন্তু আইন রয়েছে আইনের জায়গায়, রিজার্ভ ব্যাঙ্ক সূত্রের খবর, এ রাজ্যে এখন ভুঁইফোঁড় অর্থলগ্নি সংস্থাগুলির মোট ব্যবসা ৩০ হাজার কোটি টাকারও বেশি।
কী ভাবে গ্রাহক টানে এরা? এ রকমই এক লগ্নি সংস্থার এক প্রাক্তন এজেন্ট বলেছেন, “মূল আকর্ষণ হল, অবিশ্বাস্য সুদ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি। তা ছাড়া, ব্যাঙ্কে বা ডাকঘরে টাকা রাখতে গেলে নানা ধরনের কাগজপত্র, তথ্য যাচাইয়ের ব্যাপার থাকে। অনেকেই সেই প্রক্রিয়াটাকে ঝামেলা ভাবেন। এই সব সংস্থায় গ্রাহক হতে গেলে প্রায় কোনও কাগজপত্রই লাগে না। ব্যাঙ্ক বা ডাকঘরে গিয়ে লাইন দিয়ে টাকা জমা দেওয়ার মতো ঝক্কিও নেই। এজেন্ট সরাসরি গ্রাহকের থেকে টাকা নিয়ে যান। এ সব কারণেই এই সংস্থার রমরমা।”

কারা বৈধ অর্থলগ্নি সংস্থা
‘কোম্পানিজ অ্যাক্ট’-এ নথিভুক্তি যথেষ্ট নয়। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের অনুমোদন বা ‘চিট ফান্ড অ্যাক্ট’-এ নথিভুক্তি।
চিট ফান্ডের সদস্য ৪৯-এর বেশি নয়।
চিট ফান্ডে সব সদস্যই নির্দিষ্ট টাকা দেবেন।
চিট ফান্ডের সদস্যেরা পালা করে লভ্যাংশ পাবেন। কেউই দু’বার পাবেন না।

সরকারি নজরে আইন ভাঙা এ ধরনের সংস্থাগুলির পরিচয় ‘চিট ফান্ড’ হিসেবে। কেন্দ্রীয় সরকারের চিট ফান্ড অ্যাক্ট, ১৯৮২-র ২ (বি) ধারায় বলা হয়েছে, এটি এমন একটি লেনদেন যেখানে কয়েকজনের মধ্যে একটি চুক্তি হয়। চুক্তি অনুযায়ী, প্রত্যেক সদস্যকেই নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা পর্যায়ক্রমে জমা রাখতে হয়। সেই টাকা বাজারে খাটানো যেতে পারে। নির্দিষ্ট সময় অন্তর চুক্তি অনুযায়ী, খাটানো টাকার লভ্যাংশ এক-এক বার এক-এক সদস্য পান। তবে কোনও সদস্যেরই দু’বার ওই লভ্যাংশ পাওয়ার কথা নয়। কেন্দ্রীয় আইন অনুযায়ী, কোনও ‘চিট ফান্ড’-ই ৪৯ জনের বেশি সদস্যের কাছ থেকে টাকা জমা রাখতে পারবে না। রাজ্য অর্থ দফতর সূত্রের খবর, ভুঁইফোঁড় অর্থলগ্নি সংস্থাগুলি নথিতে দেখায়, তাদের কোনও বিনিয়োগ প্রকল্পেই সদস্য সংখ্যা কেন্দ্র নির্ধারিত অঙ্কের থেকে বেশি নয় এবং তারা বাজারে খাটানো টাকাও সরকারি নীতি মেনেই সদস্যদের মধ্যে বিলি করে।
একাধিক পাততাড়ি গোটানো লগ্নি সংস্থার প্রাক্তন এজেন্ট অবশ্য বলছেন, “কার্যত এই পদ্ধতির কোনও অস্তিত্ব নেই। ব্যবসা ফাঁদার প্রথম দিকে গ্রাহকদের টাকা বাজারে খাটিয়ে পাওয়া সুদ থেকে কয়েকজনকে প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী টাকা ফেরত দেওয়া হয়। সে কথা পাঁচ কান হলে গ্রাহক আরও বাড়ে। ব্যাপারটা মাছের তেলে মাছ ভাজার মতো। অনেক গ্রাহক হয়ে গেলে বহু সংস্থাই পাততাড়ি গোটায়।”
ঘটনা হল, এই সমস্যা নিয়ন্ত্রণে ভারতের পাঁচটি রাজ্য ইতিমধ্যেই নিজস্ব আইন তৈরি করেছে। তামিলনাড়ু, কেরল, অন্ধ্রপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র এবং কর্ণাটক ওই আইনের সাহায্যে ভুঁইফোঁড় অর্থলগ্নি সংস্থার কাজকর্মের উপরে নজরদারি করছে। পক্ষান্তরে, এ রাজ্যে কত ভুঁইফোঁড় অর্থলগ্নি সংস্থা রয়েছে এবং তাদের গ্রাহক তথা সদস্য সংখ্যা কত, সে তথ্য রাজ্য সরকারের কাছে নেই। বাম-আমলে (২০০৯) রাজ্য সরকার ভুঁইফোড় অর্থলগ্নি সংস্থার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য একটি বিল পাস করেছিল। কিন্তু এখনও পর্যন্ত সে বিল রাষ্ট্রপতির অনুমোদন পায়নি।
তাই এ রাজ্যে টাকা নিয়ে ব্যবসা গুটিয়ে কোনও ভুঁইফোঁড় অর্থলগ্নি সংস্থার মালিক চম্পট দিলে গরিব মানুষ কার কাছে যাবে, তা কারও জানা নেই।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.