জাতীয় নমুনা সমীক্ষায় (ন্যাশনাল স্যাম্পল সার্ভে বা এন এস এস) জানা যাচ্ছে যে, দেশের গ্রামের মেয়েরা শ্রমশক্তিতে অর্থাৎ অর্থকরী কাজে ক্রমশই কম সংখ্যায় যোগ দিচ্ছেন। ১৯৮৩ সালে (৩৮তম রাউন্ড) বেশির ভাগ বা আংশিক সময় কাজ করেছেন এবং কাজ খুঁজছেন এমন ১৫-৫৯ বছর বয়সি গ্রামীণ নারীর অনুপাত ছিল হাজার প্রতি ৩৪২ (৩৪.২ শতাংশ), ৬১তম (২০০৪-৫), ৬৬তম (২০০৯-১০) ও ৬৮তম (২০১১-১২) রাউন্ডে তা নেমে এসেছে যথাক্রমে ৩৩৩, ২৬৫ ও ২৫৩-তে। গ্রাম বা শহরের পুরুষদের মধ্যে, ওঠাপড়া থাকলেও, এই প্রবণতা নেই। শহরাঞ্চলের মেয়েদের মধ্যে অনুপাতটা খুব অল্প কমেছে, ১৫৯ থেকে ১৫৫ হয়েছে। এই প্রবণতা ১৯৮৩ সাল থেকে মোটামুটি ধারাবাহিক ভাবে চললেও ৬১ থেকে ৬৬তম রাউন্ডে এসে সেই হ্রাসের প্রবণতা যেন আরও জোরদার হয়েছে, ৬৮তম রাউন্ডেও তা বজায় আছে।
এর কারণ কী? কেউ বলছেন, বেশি বেশি সংখ্যায় গ্রামের মেয়েরা ইস্কুলে যাচ্ছেন, তাই কাজে কম যোগ দিচ্ছেন। অন্যরা বলছেন, পরিবারের আয় বাড়ছে, তাই মেয়েরা কম মজুরির অর্থকরী কাজে আর যোগ দিতে চাইছেন না। অন্য অনেকে বলছেন, গ্রামে মেয়েরা যে কাজগুলি করতেন সেই কাজগুলিই কমছে, তাই মেয়েরা কাজই পাচ্ছেন না।
১৯৮৩ থেকে ২০০৯-১০ হয়ে ২০১১-১২ সাল, ৩৮তম থেকে ৬৬তম হয়ে ৬৮তম রাউন্ডের মধ্যে শিক্ষায় গ্রামীণ মেয়েদের অংশগ্রহণ ৭.৬% থেকে বেড়ে হয়েছে ২৪% ও ২৫%। শিক্ষাগ্রহণের জন্য কাজে অংশ নিচ্ছে না, এ যুক্তি বড়জোর ১৫-২৪ বয়সি মেয়েদের জন্য। কিন্তু কাজে যোগ দিতে পারে এমন মেয়েদের মধ্যে এই বয়সের মেয়েরা ৩০%, তাই তাদের অনুপাত কমলে মোট অনুপাতটা কিছু কমে। কিন্তু এই বয়ঃসীমার বাইরে গ্রামীণ বাকি মেয়েদের কাজে যোগ না দেওয়ার কারণ তা হলে কী হতে পারে? শহরের মেয়েদের মধ্যেও শিক্ষায় অংশগ্রহণের হার বেড়েছে, ১৮% থেকে ২৬% হয়েছে, কিন্তু সেখানে কাজে যোগদানের হার এতটা তো কমেনি। |
এই সময়ে গ্রামাঞ্চলে মজুরির হার বেড়েছে, বিশেষত একদম নীচের দিকে। এ ছাড়া গ্রামীণ পরিবারের গড় ভোগব্যয় ১৯৯৩-৯৪ সালের ৯৪২ টাকা (২০১১-১২ সালের দামে) থেকে ২০১১-১২ সালে ১২৮৭ টাকা হয়েছে, মানে ৩৭% বৃদ্ধি। অর্থাৎ পরিবারের আয় বেড়েছে। তার ফলে গ্রামীণ মেয়েরা কাজে কম যোগ দিচ্ছেন। শহরের ক্ষেত্রে উচ্চ আয়ের পরিবারের মেয়েরা তবু কাজে কম হলেও যোগ দিচ্ছেন, গ্রামে যে সব পরিবারে পুরুষ আয় করেন, সেখানে মেয়েরা কাজে যাচ্ছেন না। যাঁদের সেই সহায় নেই, সেই বিধবাদের ৬৫% বা বিচ্ছিন্না/পরিত্যক্তাদের ৭৫% শ্রমশক্তিতে অংশ নেন, যেখানে অবিবাহিতাদের ২৪% বা বিবাহিতাদের ৪১%। কিন্তু গ্রামীণ পরিবারের মেয়েদের কাজ এতটুকুও কমছে কি? দেখা যাচ্ছে, ১৯৮৩ সালে ৩০% গ্রামীণ নারী পুরো সময়ের জন্য ঘরের কাজে নিযুক্ত ছিলেন, ২০১২ সালে তা বেড়ে ৪২%। শহরে অবশ্য ওই সময়ে তা ৩৮ থেকে ৪৮% হয়েছে।
বিশ্বব্যাঙ্ক বলেছিল, ১৯৯০ থেকে ভারতে বছরে গড়ে ৫৫ লক্ষ কাজের সুযোগ তৈরি হবে। ২০০৪-০৫ থেকে ২০০৯-১০-এর মধ্যে মাত্র ১০ লক্ষ করে কাজের সুযোগ তৈরি হয়েছে। গ্রামীণ মেয়েরা কাজ করতেন সাধারণত কৃষিতে, যা কিনা আদৌ উৎপাদনশীল নয়। আর ক্রমশ যন্ত্র ব্যবহার করে কৃষিও মেয়েদের কাজের সুযোগ আরও কমিয়ে দিচ্ছে। উত্তরপ্রদেশ একাই সারা ভারতের কর্মী-মেয়ের ১৬% জোগান দেয়, সেখানেই গ্রামীণ মেয়েদের শ্রমশক্তিতে যোগদানের হার কমেছে ১২%, এ ছাড়াও অনেকটা কমেছে বিহার, পশ্চিমবঙ্গ, মহারাষ্ট্র আর মধ্যপ্রদেশে। তাই ত্রিপুরা বা জম্মু-কাশ্মীরে বা অন্য ছোট রাজ্যে গ্রামীণ মেয়েদের শ্রমশক্তিতে বৃদ্ধি মোটের উপর প্রভাব ফেলতে পারছে না। ৬৮তম রাউন্ডের হিসেবে গ্রামীণ মেয়েরা কাজ করছেন মূলত কৃষি (৭৫%), উৎপাদন শিল্প (৯.৫%), গৃহনির্মাণ (৫%), ব্যবসা-হোটেল-অন্যান্য পরিষেবায় (৯%)। কৃষির গুরুত্ব কমছে, গ্রামাঞ্চলে মেয়েদের জন্য বাকি ক্ষেত্রগুলি এখনও যথেষ্ট আকর্ষক হয়ে উঠতে পারেনি। তাই আয় বা শিক্ষা বাড়লে মেয়েরা হয়তো ঘরে বেশি থাকাই বেছে নিচ্ছেন। গ্রামের দরিদ্র, নিম্নবর্ণ, নিম্নবর্গ, পুরুষ-অভিভাবকহীন, নিরক্ষর বা কম শিক্ষিত মেয়েরা কাজের বাজারে থাকছেন বাধ্যতায়।
মেয়েরা আরও বেশি পড়াশুনো করলেও গ্রামাঞ্চলে কাজে যোগদানের হার রীতিমত কমছে। গ্রামের মেয়েরা সাধারণ ডিগ্রি কোর্সের পড়াতেই থাকছেন, যার দাম বিয়ের বাজারে, কাজের বাজারে নয়। অথচ অর্থনীতির পাঠ্যবই বলেছিল, পরিবারের আয় বাড়া, পুরুষদের অনুপাতে কম হলেও, মজুরি বাড়া, সন্তান-সংখ্যা কমা— এগুলোই মেয়েদের আরও বেশি করে শ্রমশক্তিতে যোগদানের ভিত্তি তৈরি করবে। পরবর্তী অভিজ্ঞতা সেই ব্যাখ্যার সীমাবদ্ধতা দেখিয়ে দিয়েছে। বাস্তবে মেয়েদের প্রতি বৈষম্য, কাজের বাজারে সবচেয়ে খারাপ কাজ আর সবচেয়ে কম মজুরিতে আটকে থাকা, আইনের চোখে, সমাজের চোখে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকের জীবন— এ সবের থেকে মেয়েরা ঘরের কাজে মন দেওয়াকেই নিজেদের মূল্য বাড়ানোর পথ বলে মনে করতে থাকেন। অর্থনীতি আরও উন্নত হলে, কাজের সুযোগ আর মজুরি আরও বাড়লে, পুরুষের সমান হলে তখন হয়তো মেয়েরা নিজেরা, এবং পরিবারও, মনে করবে, মেয়েরাও পরিবারের উপার্জনশীল সম্পদ, মেয়েরা ঘরে বসে থাকলে আখেরে পরিবারের ক্ষতি। পরিবারের আয় বাড়া, এক কথায় আর্থিক উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে মেয়েদের কাজে যোগদানের সম্পর্কটা ঊর্ধ্বমুখী সরলরেখায় আঁকা যায় না। অনেকে বলেন সেটা অনেকটা ইংরেজি ‘ইউ’ আকৃতির। প্রথমে কমে, কারণ বৈষম্য বাড়ে, মেয়েরা ঘরে চলে যাওয়াকেই সুবিধা বলে মনে করেন; তার পর আয় অনেকটা বাড়লে, আইন আর সমাজ মেয়েদের কাজে যোগ দেওয়া নিয়ে সহায়ক মনোভাব নিলে আবার মেয়েরা বাইরের কাজে যোগ দিতে শুরু করেন। বহু পশ্চিমি দেশে বিবাহিত মেয়েদের মধ্যেও এই প্রবণতা দেখা গেছে। ভারতেও গ্রামের মেয়েরা এখন হয়তো সেই ‘ইউ’-এর নামার অংশে রয়েছেন, সুযোগ আরও ভাল হলে অংশগ্রহণ বাড়বে, ‘ইউ’-এর উঠতি অংশে মেয়েরা যেতে পারবেন। আবার অনেকের মতে শ্রমশক্তিতে মেয়েদের যোগদানের হারের চেহারা ‘ইউ’ নয়, শোয়ানো ‘এস’ আকৃতির— প্রথমে বেড়ে তার পর নামবে, পরে আবার উঠবে। তবে এ সবই অভিমত, পরিষ্কার বুঝতে আরও গবেষণা প্রয়োজন, প্রয়োজন আরও তথ্যের।
একটা অন্য প্রশ্ন। কেন মেয়েদের অর্থকরী কাজকেই শুধু গুরুত্ব দেওয়া হবে? মেয়েরা যদি বাইরের কাজে ‘যথেষ্ট’ সুবিধে পাচ্ছেন না বলে মনে করেন ও ঘরের কাজ করে পরিবারের কাছে নিজেদের দাম বাড়ান, সেটাকে আমরা শুধু মেয়েদের উপর সমাজের চাপিয়ে দেওয়া পিতৃতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ বলেই দেখব? এক সময় পশ্চিমি দেশগুলিতে ‘পারিবারিক মজুরি’র (ফ্যামিলি ওয়েজ) নামে মেয়েদের ঘরে পাঠাবার বন্দোবস্ত হয়েছিল। অমানবিক কাজের পরিবেশ, অরক্ষিত যৌনসংসর্গ, অনাকাঙ্ক্ষিত শিশুদের প্রতিপালন— এ সব থেকে মুক্তি পেতে অনেক মেয়ে তা স্বেচ্ছায় বেছে নিয়েছিলেন। কেন গ্রামীণ শ্রমশক্তিতে যোগদান কমাকেও বৈষম্যের সামনে মেয়েদের সচেতন নির্বাচন ভাবব না? গ্রামীণ দরিদ্র, ভূমিহীন, তফসিলি জাতি বা জনজাতি পরিবারের মেয়েরা এখনও শ্রমশক্তিতে উল্লেখযোগ্য অংশীদার, তা কি গোষ্ঠীর মেয়েদের অগ্রগতির সত্যিকারের সূচক?
গ্রামের মেয়েরা কি শিক্ষা আর পারিবারিক আয় যথেষ্ট থাকলে কাজে যোগদানের ‘ইউ’ রেখায় চেপে স্বেচ্ছায় নীচে নেমে আসছেন? মেয়েরা ঘরে বন্দি হয়ে গেলে সমাজে পুরুষ-আধিপত্যের দাপট বাড়ে। আরও বাড়তে পারে জাতপাত ধর্মীয় সংকীর্ণতার পরিবেশ। মায়েরাই শিশুর প্রথম শিক্ষক, ফলে আশঙ্কার ক্ষেত্রটি বিস্তৃতও হয়। আপাতত এই সমস্যাকে মেনে নিয়েই কি পরবর্তী অধ্যায়ের জন্য অপেক্ষা করতে হবে? |