ফুটপাত আর সেই সঙ্গে রাস্তার একাংশ দখল করে অর্থাৎ পথচারীদের চলার পথে চলার অধিকারকে এক প্রকার তোয়াক্কা না-করে কিছু কিছু মানুষের ব্যবসা করাটা আমাদের এক প্রকার গা-সওয়া হয়ে গেছে। মুখে না-বললেও, প্রশাসনের সর্বোচ্চ স্তর থেকে শুরু করে আমরা সাধারণ নাগরিকেরা পর্যন্ত এটাই মেনে নিয়েছি যে, কোনও কোনও ক্ষেত্রে নিয়ম মেনে চলা নাগরিকদের চেয়ে নিয়মভঙ্গকারীদের জোর ও কদর বেশি। তবে ফুটপাত দখলদারিতে রাজনৈতিক সাহায্যপুষ্ট হকারদের ভূমিকা প্রধান হলেও, এটা কিন্তু হকারদের একচেটিয়া নয়। কলকাতা শহরের বেশ কিছু ব্যস্ত বাণিজ্যিক এলাকায় ফুটপাত বা তার অংশ দখল করে ব্যবসা চালানোর ক্ষেত্রে কলকাতা পুরসভার অনুমোদনপ্রাপ্ত দোকানদারেরা ও তাঁদের কর্মচারীরাও এগিয়ে আসছেন।
প্রসঙ্গত, শ্যামবাজার ভূপেন বসু অ্যাভিনিউয়ের দক্ষিণ ফুটপাত লাগোয়া পাঁচমাথার মোড় থেকে শ্যামবাজার মেট্রো রেলওয়ে স্টেশনের মূল প্রবেশদ্বার পর্যন্ত বেশ কিছু নিয়মিত অর্থাৎ পুরসভার অনুমোদনপ্রাপ্ত দোকানদারদের আগ্রাসী আচরণের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। ফুটপাত দখলদারিতে লিপ্ত নিয়মিত দোকানগুলোর অধিকাংশই ফাস্ট ফুড বিক্রেতা। তাঁদের ফুটপাত দখল করার প্রক্রিয়া আপাতদৃষ্টিতে সরল হলেও কার্যত বেশ অভিনব।
কিছু কিছু দোকানদার তাঁদের সামগ্রী সমেত শোকেসগুলো সরাসরি দোকানের সামনেই ফুটপাতের ওপর নামিয়ে দেন। আবার, কোনও কোনও দোকানদার দোকানের মেঝের সঙ্গে কাঠ বা লোহার পাটাতন জুড়ে দেন। যেগুলো ফুটপাতের উপর ঝুলন্ত অবস্থায় থাকে। সন্ধের পর খদ্দেরে ঘিরে-থাকা এই সব দোকানের সামনে ফুটপাতের কী অবস্থা হয় তা এক দিন এসে দেখে যেতে পারেন। আবার ইলেকট্রিক্যাল বা ইলেকট্রনিক সামগ্রীর ব্যবসা করে— এ রকম কয়েকটি দোকানের সঙ্গে যুক্ত মানুষেরা দোকানের সামনে ফুটপাতের উপর টুল পেতে বসে মেরামতি বা সার্ভিসিংয়ের কাজ চালিয়ে যান। |
তবে সব কিছুকে টেক্কা দিয়েছেন এক শরবত ও ফলের রস বিক্রেতা। দোকানের সামনে ফুটপাতে বড় শোকেস বসিয়েই তিনি থেমে থাকেননি। ফুটপাতের ধারে বসানো পুরসভার রেলিংয়ের একাংশকে গ্লাস, থালা, চামচ ইত্যাদি রাখার জন্য একাধিক তাকবিশিষ্ট র্যাকে রূপান্তরিত করে নিয়েছেন।
শ্যামবাজার পাঁচমাথার মোড় এমনিতেই ব্যস্ত জনবহুল এলাকা বলে চিহ্নিত হয়ে আছে। সন্ধের পর বর্ণিত এলাকায় অবস্থাটা যা দাঁড়ায় তা এক কথায় অসহনীয়। এক দিকে খাবারের দোকানগুলোকে ঘিরে ধরে খদ্দেরদের চাক আর অন্য দিকে মেট্রো স্টেশন থেকে বেরোনো বাড়িমুখো যাত্রীদের স্রোত। সংকুচিত ফুটপাতে গুঁতোগুঁতি ছাড়া এগোনোই যায় না। অবস্থাটা অনেকটা দুর্গাপুজোর সময়ে নামী পুজোমণ্ডপে দর্শনার্থীদের ঢল নামার মতো। শুধু তাঁদের চোখেমুখে প্রতিমা, মণ্ডপসজ্জা আর আলোকসজ্জা দেখার প্রত্যাশাটা নেই। কেউ কেউ এই প্রাণান্তকর ভিড় এড়াতে ফুটপাত ছেড়ে সরাসরি রাস্তাতেই নেমে পড়েন। ফলে, শহরের এক ব্যস্ততম এলাকায় যানজটের সমস্যা আরও জটিল হয়।
মূলত নিয়মিত দোকানদারদের বেপরোয়া আচরণজনিত এই বিশৃঙ্খল অবস্থাটা কিন্তু নতুন নয়, বেশ কয়েক বছর ধরেই চলে আসছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তার মাত্রাটাও বেড়েই চলেছে। স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন ওঠে, নির্দিষ্ট কিছু শর্তে কলকাতা পুরসভা ও কলকাতা পুলিশের কাছে অনুমোদন পাওয়া দোকানগুলো সকলের চোখের সামনে এতটাই দুঃসাহসী হয়ে উঠছে কী করে? তার চেয়ে বড় প্রশ্ন, বিধিভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নিয়ে সাধারণ নাগরিকদের ফুটপাতে স্বাভাবিক ভাবে চলাফেরা করার অধিকার ফিরিয়ে দিতে কলকাতা পুরসভা আর কলকাতা পুলিশের এত অনীহা কেন? সাধারণ নাগরিকরা কি তাদের কাছে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক?
এই প্রশ্ন শুধু শ্যামবাজার এলাকার বাসিন্দাদের আর ওই এলাকা দিয়ে যাতায়াতকারী মানুষদের নয়, শহরের অন্যান্য বেশ কিছু এলাকার বসবাসকারী আর ব্যবহারকারীদেরও এই প্রশ্নগুলো পীড়া দেয়।
অনুপম শেঠ। কলকাতা-২ |