আশঙ্কা ছিল, জুবিন মেটার সুরে লাল হয়ে উঠবে ডাল লেকের জল। সারিবদ্ধ চিনার গাছ হয়ে উঠবে বিষবৃক্ষ। কবরে শুয়ে থাকা হাজার কাশ্মীরি যোদ্ধা এক রাতের জন্য জেগে উঠে প্রতিবাদ জানাবেন এক সুরে।... ডাল লেকের জল শেষ পর্যন্ত লাল হয়ে ওঠেনি। চিনার গাছেরাও তেমনটিই আছে। হাজার ঝামেলার মধ্যে শ্রীনগরে জুবিন মেটার কনসার্টটি হয়েছে। প্রসার ভারতীর দৌলতে সারা দুনিয়ায় অনেকেই অনুষ্ঠানটি দেখেছেন, শুনেছেন। কবরে শুয়ে থাকা কাশ্মীরি যোদ্ধা ও নাগরিকদের কনসার্টটি কেমন লেগেছে, জানা যায়নি। একই দিনে দক্ষিণ কাশ্মীরের সোপিয়ানে সেনার গুলিতে চার জন প্রাণ হারিয়েছেন। মৃতেরা সবাই জঙ্গি কি না, তা নিয়ে তর্ক চলছে। অনুষ্ঠানের সঞ্চালনা করার দায়ে অভিনেত্রী গুল পনাগের কাছে পৌঁছে গেছে হুমকির চিঠি।
শনিবার শ্রীনগরের শালিমার বাগে ছিল ভারত আর জার্মানির যৌথ উদ্যোগে জুবিন মেটার ‘এহসান-ই-কাশ্মীর’। ‘এই অনুষ্ঠান আসলে ভারত নিয়ন্ত্রিত একটি সাংস্কৃতিক সন্ত্রাস, যা নাত্সি জার্মানির হিটলারকে মনে করিয়ে দেয়। কাশ্মীরে শান্তি বিরাজমান, এই ভুল বার্তা বিশ্বের দরবারে পৌঁছে দেওয়ার একটি চক্রান্ত এই কনসার্ট।’ তাই জার্মান সরকারকে চিঠি দিয়ে এই অনুষ্ঠান বন্ধ করার দাবি জানিয়েছিল শ্রীনগরের নাগরিক সমাজের একটি অংশ। পাশাপাশি বেশ কয়েকটি জঙ্গি সংগঠনও এই অনুষ্ঠান বন্ধ করার ফতোয়া জারি করে। অনুষ্ঠানের দিন কাশ্মীরে বন্ধের ডাক দেন কট্টরপন্থী বিচ্ছিন্নতাবাদী সৈয়দ আলি শা গিলানি।
মুম্বইজাত মায়েস্ত্রো জুবিন মেটার কর্মকাণ্ডের সঙ্গে ইজরায়েল নামটি জড়িত থাকার ফলেই যাবতীয় আক্রমণ। তিনি ইজরায়েল ফিলহার্মোনিক অর্কেস্ট্রায় সারা জীবনের জন্য মিউজিক ডিরেক্টর। গত বছরেই আমেরিকার কার্নেগি হলে তাঁর অনুষ্ঠানের প্রতিবাদে চিঠি দিয়েছিলেন পিঙ্ক ফ্লয়েডের রজার ওয়াটার্স, পুলিতজার পুরস্কার খ্যাত সাহিত্যিক অ্যালিস ওয়াকার। প্যালেস্টাইনে ইজরায়েলের অন্যায্য দখলদারির প্রতিবাদেই ছিল এই চিঠি। জুবিন মেটা নিজে অবশ্য এই সমস্ত বিক্ষোভের মধ্যে যথেষ্ট যুক্তি খুঁজে পেয়েছেন। তাঁর কথায়, ‘ইজরায়েল সরকারের বিদেশ নীতি এর জন্য কিছুটা হলেও দায়ী, প্যালেস্টাইনে অবিলম্বে অবৈধ ইজরায়েলি দখলদারি বন্ধ না হলে আমরা সারা পৃথিবীতে আরও একঘরে হয়ে যাব। তবে আমি দু’পক্ষকেই এ জন্য দায়ী করি। দু’পক্ষই একে অপরের দিকে লাগাতার বোমাবাজি চালিয়ে যাচ্ছে। জানি না, কবে এই হামলার ট্র্যাডিশন বন্ধ হবে।’ |
এহ্সান-ই-কাশ্মীর। শালিমার বাগের কনসার্টে জুবিন মেটা। ৭ সেপ্টেম্বর। ছবি: পি টি আই |
জুবিন মেটা ইহুদি নন। হিব্রু বলতে বা লিখতেও পারেন না। ইজরায়েল ফিলহার্মোনিক অর্কেস্ট্রাও ইজরায়েল সরকারের নিজস্ব সংস্থা নয়। ঘোষিত ভাবেই তিনি ইজরায়েল সরকারের বিদেশ নীতির সমালোচক। তবু আক্রমণের কেন্দ্র হিসেবে তাঁকেই বেছে নেওয়া হয়। বলা হয়, তাঁর সংগীত শুনলে অপমান করা হয় প্যালেস্টাইনের অত্যাচারিত নাগরিকদের। বলা হয়, তাঁকে মুখোশ বানিয়েই কাশ্মীরের ভুল ছবি আঁকছে ভারত।
কাশ্মীরেরই এক শিল্পী ওয়াহিদ জিলানি। একই সময়ে আরও পাঁচ কাশ্মীরি সংগীতশিল্পীর সঙ্গে তাঁর অনুষ্ঠান ছিল লন্ডনে। জুবিন মেটার অনুষ্ঠান ঘিরে জিলানির বক্তব্য খুব পরিষ্কার। ‘ইউরোপ যদি কাশ্মীরের সাংস্কৃতিক ধারাকে গ্রহণ করতে পারে, তা হলে কাশ্মীরে কেন জুবিন মেটার কনসার্ট ঘিরে এত আপত্তি?’ ভারতপন্থী, কাশ্মীরপন্থী, পাকিস্তানপন্থী, কট্টর হুরিয়তপন্থী, নরম হুরিয়তপন্থী, ইজরায়েল, না কি আমেরিকা ওয়াহিদ জিলানির গায়ে ঠিক কোন ছাপটা মারা যায়, তা নিয়ে অবশ্য চলছে জমজমাট বিতর্ক।
উপত্যকারই সন্তুর আইকন পণ্ডিত ভজন সোপোরি। জুবিন মেটার কনসার্টের অন্যতম উদ্যোক্তা। এই অনুষ্ঠানের কোনও রাজনৈতিক প্রভাব আছে, এমনটা মানতে নারাজ এই কাশ্মীরি পণ্ডিত। তাঁর কথায়, ‘এটা একটা দুর্দান্ত ধ্রুপদী অনুষ্ঠান, কোনও ইলেকট্রনিক যন্ত্র নেই, গিটার, জ্যাজ, পপ, রক, কিচ্ছু নেই। এটা অনেকটা আমাদের নিজস্ব কাশ্মীরি সুফিয়ানার মতো।’ কাশ্মীরি উপত্যকা যে গানবাজনার পীঠস্থান, সেই খবর দুনিয়ার কাছে যাওয়ায় মুসলিম মৌলবাদীদের একাংশ অবশ্য অস্বস্তিতে পড়তে পারেন।
সংস্কৃতির ওপর এই আগ্রাসন কাশ্মীরে নতুন নয়। তিন কাশ্মীরি মেয়ের তৈরি ব্যান্ড বন্ধ হয়ে গিয়েছিল শ্রীনগরের গ্র্যান্ড মুফতির ফতোয়ায়। শ্রীনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে জার্মান ভাষা পড়ানোর দায়ে উপাচার্যের গায়ে পড়েছে ‘ভারতপন্থী’ স্ট্যাম্প। আসল লড়াই অনেক কঠিন। তাই টি-টোয়েন্টি ম্যাচই আসল ক্রিকেট। পাল্টা গান, পাল্টা সিনেমা, পাল্টা সাহিত্য দূরের কথা, প্রতিপক্ষের সামনে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতেই যেখানে তীব্র অনীহা। দেওয়াল তোলো, বর্ম বানাও। প্রতিপক্ষকে স্ট্যাম্প মারো। টেনে-হিঁচড়ে নামিয়ে দাও মঞ্চ থেকে। দরকার হলে ফতোয়া জারি করো। ‘কাশ্মীর সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান অনেক বেশি জরুরি।’ এমন একটা আওয়াজ উঠেছে পশ্চিমবঙ্গ থেকেও। মানসিক ভাবে অতিবিপ্লবী আর জীবনে হরিপদ কেরানিদের মাথায় জেগে উঠেছে কাশ্মীরি সত্তা, রাষ্ট্রের শোষণ আর মানবাধিকার। ফেসবুকে আছড়ে পড়ছে সেই ভণ্ড আন্দোলনের ঢেউ। সোপিয়ানে মৃত্যুর খবর ভেসে আসতেই সেখানে চাপা উল্লাস: ‘দেখলেন তো!’ যেন উপত্যকায় রক্তপাত খুব ব্যতিক্রমী ঘটনা! তা হলে কি রাজনৈতিক সমাধান না আসা পর্যন্ত সমস্ত গানবাজনা বন্ধ রাখা হবে কাশ্মীর উপত্যকায়? কাশ্মীরের রাজনৈতিক পরিস্থিতি জুবিন মেটার কনসার্টের জন্য উপযুক্ত না হলে এমন জায়গা খুঁজে বের করা হোক যেখানে বিদ্যমান স্বর্গরাজ্য। পাওয়া না গেলে সারা পৃথিবীর শিল্পীদের পাঠিয়ে দেওয়া হোক মঙ্গলগ্রহে।
জানি, পাল্টা যুক্তি দেওয়া হবে: রাজনৈতিক কারণেই বয়কট করা উচিত জুবিন মেটার কনসার্ট। উনি নিজে যা-ই বলুন, আসলে উনি ইজরায়েলের চামচা। কিন্তু জুবিন মেটা যদি ইজরায়েলের শাসকশ্রেণির প্রতিভূ হন, তা হলে আইনস্টাইনকেও হিরোশিমা-নাগাসাকির জন্য দোষী সাব্যস্ত করতে হবে।
কাশ্মীরে গণকবরে শুয়ে থাকা অসংখ্য জেহাদির জুবিন মেটার কনসার্ট শুনতে ভাল লাগবে কি লাগবে না, সেটা বিচার্য নয়। করাচির মানুষের সচিন তেন্ডুলকরের খেলা ভাল লাগে কি? ইনজামামকে কতটা ভালবাসে কলকাতার মানুষ? ভারতে গুলাম আলির বাজার কেমন? সে সব প্রশ্ন বরাবরই থেকে গিয়েছে পিছনের সারিতে। সামনে আসে শুধু রাজনীতি। শিল্পের রাজনীতি, সংগীতের রাজনীতি, ক্রিকেট রাজনীতি, জন্ম হয় শুধু নতুন শব্দের। সভাসমিতিতে যে সব শব্দ ব্যবহার করা যায়। এই আন্দোলনে যদি ভবিষ্যতের কাশ্মীরের কোনও বীজ লুকিয়ে থাকে, তা হলে সেই অনাগতের চরিত্র কেমন হবে, সেটা এখন থেকেই বেশ স্পষ্ট।
তবে ইতিহাস মনে রাখবে ওয়াহিদ জিলানি, অভয় সোপোরিদের। ‘এহসান-ই-কাশ্মীর’-এর পাশাপাশি ইতিহাস মনে রাখবে ‘হকিকত-ই-কাশ্মীর’কেও। শ্রীনগরের মাটিতেই নাগরিক সমাজের তরফে কিছু মানুষ একই দিনে করেছেন এই অনুষ্ঠান। তাঁরাও জুবিন মেটার কনসার্টের প্রতিবাদ করেছেন। এই কনসার্ট ঘিরে রাজনৈতিক মুনাফা তোলার বিরুদ্ধেও তাঁরা একমত। তবে জুবিন মেটার শো বাতিল করাই তাঁদের একমাত্র দাবি নয়। সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে তাঁরা লড়াই করেছেন সাংস্কৃতিক অস্ত্র ব্যবহার করেই। সেই অস্ত্রের নামই ‘হকিকত-ই-কাশ্মীর’। বিশ্বের সংবাদমাধ্যমের সামনে একই দিনে তাঁরা তুলে ধরেছেন কাশ্মীরের আনন্দ, দুঃখ, কান্না, গান। কয়েক দশক ধরে চলে আসা অত্যাচারের ফটোগ্রাফ নিয়ে হয়েছে প্রদর্শনী। ফতোয়া, খুন আর সংগীতের নিষিদ্ধভূমি, এই পরিচয় ছাপিয়ে তাঁরা তুলে ধরতে চেয়েছেন আসল কাশ্মীরকে।
শালিমার বাগের অনুষ্ঠান শেষে আবার কাশ্মীরে আসার ইচ্ছা জানিয়ে গিয়েছেন জুবিন মেটা। আমরা-ওরা’র প্রাচীর ভেঙে সবাই মিলে একসঙ্গে গান গাওয়ার কথাও বলেছেন। কাশ্মীরের মানুষ এই ডাকে সাড়া দেবেন কি না, তা তাঁদেরি বিচার্য। কিন্তু তা থেকেই মিলবে ভবিষ্যৎ কাশ্মীরের সংকেত। জানা যাবে, যার অধীনেই যাক কাশ্মীর, কেমন হবে তার চরিত্র, তৈরি হবে তার রূপরেখা। |