প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ যখন বলেন, পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হিসাবে রাহুল গাঁধীই আদর্শ ব্যক্তি, তাহা এক কথা। আর তিনি যখন বলেন, রাহুল গাঁধীর নেতৃত্বে কাজ করিতে তিনি সুখী বোধ করিবেন, তাহা সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি বক্তব্য। প্রথম বাক্যটি কংগ্রেস নেতাদের স্বভাবসিদ্ধ ‘পরিবার’-ভজনা হিসাবে গণ্য হইলেও পরবর্তী বাক্যটি কিন্তু সর্বার্থেই ভারতীয় রাজনীতির প্রেক্ষিতে দুর্লভ উচ্চারণ। কোনও ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী হাস্যমুখে এবং অম্লান-মনে দলের কোনও তরুণ নেতার অধীনে কাজ করিবার ইচ্ছা প্রকাশ করিতেছেন, এমনটা সচরাচর দেখা যায় না। এ বিষয়ে সন্দেহ নাই যে, তাঁহার মুখে রাহুল গাঁধী বিষয়ে চরম আশাময়তা ভিন্ন অন্য কিছু প্রত্যাশা করা মুশকিল। নেহরু-গাঁধী পরিবারের এই সদস্যকে গত দশ বৎসরে রাজনীতির রাজপথে যত কমই দেখা যাক, বিভিন্ন সামাজিক রাজনৈতিক অর্থনৈতিক সংকটে তাঁহার অনুপস্থিতি এবং নীরবতা যতই নিশ্ছিদ্র হউক, তাঁহার ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রিত্ব লইয়া কংগ্রেসের নেতা ও কর্মীদের মধ্যে প্রবল অবরুদ্ধ আবেগের কমতি নাই। এই আবেগের ব্যত্যয় মনমোহন সিংহের মধ্যেও ঘটিবার কারণ নাই। তাঁহার প্রথম বাক্যটি তাই প্রত্যাশিত।
কিন্তু যত সহজে ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রীর নামটি উচ্চারণ করা যায়, তরুণ সহকর্মীর সম্ভাব্য নেতৃত্বে কাজ করিবার ঘোষণাটি তত সহজ নহে। বিশেষত ভারতীয় সমাজে। যিনি নেতা, তিনি যে কেবল বর্তমানে ঊর্ধ্বে আসীন তাহাই নহে, চিরকালের জন্যই সকলের উপরে তাঁহার স্থান, এমনই এই সমাজের দস্তুর। তাই নেতা আজীবন নেতা থাকিয়া যান, অন্তত বকলমে। আজীবন কথাটি প্রণিধানযোগ্য। দেশে গণতন্ত্রের ধ্বজাটি যতই শোভাবর্ধন করুক, কী রাজনীতিতে কী সমাজের অন্যান্য কর্মমঞ্চে, নেতার দেহাবসান না হইলে তিনি সাধারণত তাঁহার উচ্চাসন হইতে স্থানান্তরিত হন না। মহাভারতের কুরুক্ষেত্রপর্ব স্মরণীয়। ভীষ্ম যদি যুদ্ধক্ষেত্র হইতে না সরিতেন, দ্রোণাচার্য কি কৌরব সেনাপতি-রূপে বৃত হইতেন? দ্রোণের প্রাণহানি না ঘটিলে কি কর্ণ কখনও প্রথম স্থানটি অধিকার করিতে পারিতেন? এ কালের রাজনীতিতেও চিরপুরাতন মুখগুলিরই রমরমা। গণতন্ত্রের অনিবার্য দাবিতে যদি-বা কোনও নূতন মুখ নেতৃত্বে অভিষিক্ত হন, পুরাতন নেতারা তাঁহাদের অধীন হন না, সহকর্মীও হন না, বরং জ্যেষ্ঠতাতসুলভ ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। তাই শরশয্যাশায়ী ভীষ্ম ‘পরামর্শ’ দিয়াই চলেন, নূতন নেতার নীতি কী, তাহা জানিতে ব্যগ্র হন না।
আধুনিকতার আড়ালে ঐতিহ্য, গণতন্ত্রের আড়ালে সামন্ততন্ত্র লালন করিবার যে অভিযোগ ভারতীয় সমাজ বিষয়ে, সম্ভবত সেখানেই এই নেতৃ-রীতির কারণটি নিহিত। একমাত্র ক্রীড়াঙ্গনে ইহার ব্যতিক্রম কখনও কখনও পরিলক্ষিত হয়, সচিন তেণ্ডুলকর অধিনায়কত্ব ছাড়িয়া অনায়াসে মহেন্দ্র সিংহ ধোনির অধিনায়কত্ব বরণ করিয়া লন, বস্তুত নিজেই অধিনায়ক হিসাবে ধোনির নাম প্রস্তাব করেন। এই গণতান্ত্রিক আচারটি জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রেও পালন করা অত্যন্ত জরুরি। সত্যকারের সামাজিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করিতে হইলে নেতৃত্ব-স্তর হইতেই তাহার চেষ্টা শুরু করা প্রয়োজন। সে জন্য চাই মানসিকতার পরিবর্তন। মনমোহন সিংহের তাই একটি অভিনন্দন প্রাপ্য। তবে অভিনন্দনের গোলাপে সংশয়ের কাঁটাটি কিন্তু থাকিয়াই যায়: রাহুল গাঁধী না হইয়া যে কোনও তরুণ রাম-শ্যাম-রহিম-হাসিমের নেতৃত্বও তিনি একই প্রসন্নতায় স্বীকার করিতেন তো? |