|
|
|
|
পূজারীর চোখে জল, দরজা খুলল কেদারনাথের
গৌতম চক্রবর্তী • কলকাতা |
মেঘ ভাঙা বৃষ্টিই ভেঙে-গুঁড়িয়ে ধুয়ে দিয়েছিল সব। ধ্বংসের মধ্য থেকে নতুন করে দরজা খোলার দিনেও কেদারনাথের পিছু ছাড়ল না বৃষ্টি।
৮৭ দিন পর, বুধবার সকাল ৭টায় কেদারনাথ মন্দিরের দরজা খুলল। সন্ধ্যারতির আগে ফের ঝেঁপে বৃষ্টি। “সকাল থেকেই কুয়াশা। আকাশের মুখ ভার,” জানালেন বদ্রী-কেদার মন্দির সমিতির সভাপতি গণেশপ্রসাদ গোদিয়াল। সেই খারাপ আবহাওয়ার কারণেই আজ ইচ্ছা সত্ত্বেও কেদারে যেতে পারেননি উত্তরাখণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী বিজয় বহুগুণা। দেহরাদূন থেকে তাঁর কপ্টার উড়তে পারেনি। আবহাওয়ার কারণেই গুপ্তকাশীতেও আটকে গিয়েছে সংবাদমাধ্যমের একটি দল।
গৌরীকুণ্ডের আগে ফাটা চটিতে বেসরকারি হেলিপ্যাড বন্ধ। গুপ্তকাশী থেকে আজ মোট দশ বার উড়েছে হেলিকপ্টার। কপ্টারে মাত্র পাঁচ-ছয় জনের বসার জায়গা। অতএব ফল যা হওয়ার তাই। “৭০/৮০ জনের বেশি লোক আসতে পারেননি। মন্দির ঠিক আছে। কিন্তু টাউন পুরা ডেস্ট্রয় হো গ্যয়া,” জানালেন বদ্রী-কেদার মন্দির সমিতির সিইও বি ডি সিংহ। সরকারি মন্দির সমিতির কর্তা, প্রধান পূজারী আর গুপ্তকাশী এলাকার বাছাই কিছু পুরোহিতের উপস্থিতিতেই এ দিন নতুন করে খুলেছে কেদার মন্দির। ঘণ্টা বেজেছে চারদিকে ছড়িয়ে থাকা ধ্বংসকে সাক্ষী রেখেই। |
পুজো করছেন মন্দিরের প্রধান পুরোহিত ভীমশঙ্কর লিঙ্গ (বাঁ দিকে)। বুধবার। ছবি: পিটিআই। |
শুধু গঢ়বাল নয়, শুধু ভারতও নয়। তামাম দুনিয়ার নৃতত্ত্ববিদ ও সংস্কৃতিবিদরা এই দরজা খোলার দিকে তাকিয়ে ছিলেন। আমেরিকার উইসকনসিন বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনশাস্ত্রের অধ্যাপক লিউক হোয়াইটমোর গত সাত বছরে তিন বার কেদার এসেছেন। কেদারনাথ ও সেখানকার জনসম্প্রদায় নিয়ে আগামী বছরেই বেরোতে চলেছে তাঁর গবেষণাগ্রন্থ। “এ দিনও যাওয়ার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু শুনলাম, শুধু স্থানীয়দেরই নিয়ে যাওয়া হবে,” আমেরিকা থেকে জানালেন তিনি। আম-দেশবাসীর কাছে গঢ়বাল পাহাড়ের কেদারনাথ থেকে শুরু করে বারাণসীর বিশ্বনাথ বা দেওঘরের বৈদ্যনাথ সকলেই শিবের প্রতিরূপ। লিউক-এর আসন্ন বই জানাচ্ছে, ‘কেদার’ শব্দের অর্থ জলে-ভেজা জায়গা। ঝর্না এবং গলে যাওয়া বরফের জলে ভেজা তৃণভূমিতে যিনি অধিষ্ঠান করেন, তিনিই কেদার।
মন্দিরের প্রধান পূজারী, কর্নাটকের রাওয়াল ব্রাহ্মণ ভীমশঙ্কর লিঙ্গ অবশ্য এই সব শব্দার্থ, ব্যুৎপত্তি নিয়ে বিন্দুমাত্র ভাবিত নন। “দরজা খুলতে খুলতে চোখে জল এসে গিয়েছিল,” বললেন তিনি। সকাল থেকেই এ দিন শুরু হয়ে গিয়েছে রাওয়ালজি’র ব্যস্ততা। ৭টায় মন্দিরের দরজা খুলে প্রথমেই হবন (যজ্ঞ) এবং মন্ত্রোচ্চারণের মাধ্যমে মন্দির শুদ্ধিকরণ। প্রায় এক ঘণ্টা লেগেছে। ৮টায় মহাভিষেক। চলেছে সকাল ৯টা অবধি। অতঃপর গর্ভগৃহের বাইরে মন্দিরপ্রাঙ্গণে যে নন্দীমূর্তি, সেখানে বিশ্বকল্যাণযজ্ঞ। দুপুরে দেবতাকে ভোগ নিবেদন। সন্ধ্যা ৭টা ১৫য় শিবলিঙ্গকে রাজবেশে সাজিয়ে আরতি। ৮টায় দরজা বন্ধ।
শুদ্ধিকরণ, বিশ্বকল্যাণযজ্ঞ আর হবে না। কিন্তু আগামী ৪ নভেম্বর, শীতের মরসুমে মন্দিরের দরজা বন্ধ হওয়া ইস্তক অভিষেক ও অন্যান্য নিত্যনৈমিত্তিক পুজো চলবে। নিজেদের ঝুঁকিতে কিছু তীর্থযাত্রী যেতেও পারবেন। পূর্ণাঙ্গ কেদারযাত্রা কবে শুরু হবে, সেটা ঠিক হবে ৩০ সেপ্টেম্বর। সন্ধ্যায় রাজছত্র, মখমলশোভিত ‘রাজবেশ’ আর সকালে নিরাভরণ নির্বাণবেশ...এই দুই রূপই কেদারের বৈশিষ্ট্য। সকালে ঘি এবং চানা ডাল নিয়ে ভক্তেরা পুজো দিতে মন্দিরে ঢোকেন। তখন জাতি-বর্ণ নির্বিশেষে সকলে শিবলিঙ্গকে স্পর্শ করে ঘি মালিশ করার সুযোগ পায়।
শিবপুরাণের কেদারখণ্ডে এ নিয়ে গল্পও আছে। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের পর আত্মীয়বধের প্রায়শ্চিত্ত করতে পাণ্ডবরা ঘুরে বেড়াচ্ছেন। ব্যাসদেব বলে দিয়েছেন, স্বয়ং শিব ছাড়া আর কেউ তোমাদের পাপমুক্ত করতে পারবে না। কেদারের রাস্তায় এসে শিবকে দেখা গেল। কিন্তু পঞ্চপাপীকে দেখেই দেবাদিদেব ষাঁড়ের রূপ ধরে পালাতে লাগলেন। মহাবল ভীম সেই পলায়নোদ্যত ষাঁড়কে গদা মেরে জাপ্টে ধরলেন। ষণ্ডরূপী শিবের কুঁজটি পড়ল কেদারে, বাহু তুঙ্গনাথে। নাভি ও পেট চৌখাম্বা পাহাড়ের নীচে, মধুগঙ্গা নদীর ধারে মদমহেশ্বরে। মুখ রুদ্রনাথে। আর জটা কল্পেশ্বরে। এই ভাবেই সৃষ্টি হল পঞ্চকেদার। গদার আঘাতে শিব
আহত বলেই তাঁকে ঘি মালিশ করতে হয়। চানা ডাল তো গবাদি পশুরই অন্যতম খাদ্য।
গৌরীকুণ্ড থেকে চড়াইপথে শয়ে শয়ে তীর্থযাত্রীর ‘জয় বাবা কেদারনাথ বরফানি’ ধ্বনি আজও কানে বাজে ডায়না এক-এর। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘কম্পারেটিভ রিলিজিয়ন’-এর অধ্যাপক ডায়না। “কেদারে পঞ্চপাণ্ডব মিথ আছে। উপরন্তু মন্দিরের শিবলিঙ্গ বারোটা জ্যোতির্লিঙ্গের অন্যতম।” এক ঈশ্বর-এক সম্প্রদায়-এক গোষ্ঠী নয়। হিন্দুধর্ম যে বহুত্ববাদে বিশ্বাসী, সেটাই মনে করিয়ে দেন ডায়না।
গত তিন মাস ধরে দুনিয়া সেই বহুত্ববাদী তীর্থের কপাট খোলার অপেক্ষাতেই ছিল!
|
|
পুরনো খবর: বদলাচ্ছে পথ, প্রথা ভেঙে খুলছে মন্দির |
|
|
|
|
|