কাঠগড়ায় ডলার
পড়ার মাঝে খরচ বাড়লে তৈরি তো?
ত্যন্ত নীরস দু’টি সমীকরণ।
১ ডলার= ৫৫ টাকা। যা মাস তিন-সাড়ে তিন আগে ছিল। আর
১ ডলার= ৬৪ থেকে ৬৮ টাকা। যা হালে হয়েছে (বুধবার অবশ্য ডলার ৬৩.৩৮ টাকা)।
আর এদের সৌজন্যেই মাত্র কয়েক মাসের এই ব্যবধানে ঝাপসা হয়েছে বিদেশে পড়তে যাওয়া অসংখ্য পড়ুয়ার স্বপ্ন। কারণ ডলারে টাকার দাম এই হারে কমায় তাঁদের পড়াশোনা চালানোর খরচ এক লাফে বিপুল বেড়ে গিয়েছে। এতটাই যে, খরচ কুলিয়ে পড়াশোনা আদৌ শেষ করা যাবে কি না, সেটা ঘিরেই তৈরি হয়েছে অনিশ্চয়তা।
যে বাবা-মায়েরা সন্তানকে বিদেশে পড়তে পাঠিয়ে দিয়েছেন, তাঁরা নিরুপায়। হয় মাঝপথে পড়াশোনা থামিয়ে দেওয়া, নয়তো কোনওক্রমে টেনেটুনে, অতি কষ্টে অর্থের সঙ্কুলান করা দুইয়ের মধ্যে একটিকে বেছে নিতে হবে তাঁদের। কিন্তু যাঁরা আগামী দিনে পড়াশোনার জন্য বিদেশে পাড়ি দেওয়ার স্বপ্ন বুনছেন? যে-অভিভাবকেরা সেই স্বপ্ন সত্যি করার পথ খুঁজে দেবেন? কী করবেন তাঁরা? চলুন এই বিষয়গুলিই একটু কাঁটাছেঁড়া করে দেখে নিই আজ। দেখে নিই এই সমস্যা থেকে বেরোনোর কোনও পথ আছে কি না।

ঋণ আর কতটুকু?
মধ্যবিত্ত পরিবারের পড়ুয়াদের বিদেশে পড়ার জন্য শিক্ষাঋণই বড় ভরসা। ব্যাঙ্ক থেকে সর্বোচ্চ ২০ লক্ষ টাকা ঋণ পাওয়া যায়। এর মধ্যে ৭.৫ লক্ষের বেশি ঋণ নিলে ব্যাঙ্কের স্থায়ী আমানত অথবা কোনও সম্পত্তি বন্ধক রাখা বাধ্যতামূলক। অবশ্য কোনও নামী প্রতিষ্ঠানে পড়ার সুযোগ পেলে অনেক ব্যাঙ্ক এই শর্ত শিথিল করে।
কেউ ২০ লক্ষ টাকার কম ঋণ নিলে এবং পরে খরচ বাড়ছে দেখলে ‘টপ আপ’ করে ঋণের পরিমাণ বাড়াতে পারেন। কিন্তু সে ক্ষেত্রেও ২০ লক্ষের সীমা টপকানো যায় না। বাড়তি ঋণের জন্যও কিন্তু সমানুপাতিক হারে বন্ধকীর ব্যবস্থা করতে হয়।

আগুন খরচে হাত পুড়ছে
স্কলারশিপ নিয়ে বিদেশে পড়তে গেলে পড়াশোনার খরচ হয়তো লাগে না, কিন্তু দৈনন্দিন জীবনযাপনের খরচ? ডলারের দাম বাড়ায় সেটুকু সামলাতেও তো নাভিশ্বাস ওঠার জোগাড়। তবে এই মুহূর্তে সব থেকে বেশি সঙ্কটে সেই সব অভিভাবক, যাঁরা ছেলেমেয়েকে বিদেশে পড়তে পাঠিয়েছেন সম্পূর্ণ নিজেদের খরচায়। অনেক ক্ষেত্রে এর মধ্যে এক বছরের পড়ার খরচই বেড়ে গিয়েছে ৮-১০ লক্ষ টাকা। ওই বাড়তি চাপ সামলানোর চিন্তা এখন তাঁদের রাতের ঘুম কেড়েছে।
মধ্যবিত্ত ঘরে ছেলে-মেয়েকে বিদেশে পড়তে পাঠালে বাজেট করতেই হয়। ঋণ যত বেশি, তা শোধের চাপও ততই বাড়বে। তাই কত খরচ হবে, তার কতটা নিজেরা মেটানো যাবে, ঋণই বা কতটা নিলে ভাল হয় এ সব ছকে নেওয়া হয়। ডলারের দাম বাড়তে থাকায় এই মুহূর্তে বেশির ভাগেরই পুরো বাজেট গরমিল হয়ে গিয়েছে।
যাঁদের ঋণ ২০ লক্ষ টাকার কম, তাঁদের অনেকে ইতিমধ্যেই টপ আপের আবেদন করেছেন ব্যাঙ্কে। কিন্তু যাঁদের সে সুযোগ নেই, তাঁরা কোথায় যাবেন? ডলারে টাকার দাম নামার অপেক্ষা করা ছাড়া আর কীই বা করার আছে তাঁদের!
প্রমাদ গুনছে ব্যাঙ্কগুলি
বিদেশি মুদ্রার দামের ওঠা-পড়া নতুন ঘটনা নয়। তবে তার সাম্প্রতিক পরিমাণ দেখে চিন্তিত ব্যাঙ্ককর্তারাও। কারণ তাঁরা শিক্ষাঋণ দেওয়ার সময়ে ধরে নেন যে, চাকরি পাওয়ার পর সেই আয় থেকেই তা শোধ করা হবে। তাই খরচ বাড়ায় মাঝপথে কারও পড়াশোনা থেমে গেলে ব্যাঙ্কের টাকা ফেরতের সম্ভাবনাও অন্ধকারে তলিয়ে যাবে। অনুৎপাদক সম্পদে পরিণত হবে ঋণের টাকা। অর্থাৎ ডলার-পাউন্ডের দাম বাড়ায় বিদেশে পড়ার শিক্ষাঋণের ক্ষেত্রেও ঝুঁকি বেড়েছে কয়েক গুণ।

সুরাহা কোন পথে?
এই সব সাত-পাঁচ ভেবেই ব্যাঙ্কগুলি এ বার তা থেকে বেরোনোর উপায় খুঁজতে শুরু করেছে। এর মধ্যে রয়েছে—
ঋণের ঊর্ধ্বসীমা বাড়ানো। ব্যাঙ্কিং মহলের একটা বড় অংশের মতে, ২০ লক্ষ টাকার বেশি ঋণ পাওয়ার সুযোগ থাকলে, খরচ কুলোতে না-পারার জেরে পড়াশোনা বন্ধের সম্ভাবনা কমবে। সে ক্ষেত্রে বিদেশি মুদ্রার দামের ওঠা-পড়ার ভিত্তিতে সর্বোচ্চ ঋণের অঙ্ক অন্তত ১০-১৫% বাড়ানোর পক্ষে সওয়াল করছে তাঁরা।
ডলারে শিক্ষাঋণ প্রদান। একাংশের মতে, ভারতের ব্যাঙ্কগুলি বিদেশি মুদ্রায় (ডলার বা পাউন্ডে) শিক্ষাঋণ মঞ্জুর করলেও পড়াশোনা মাঝপথে বন্ধ হওয়ার ঝুঁকি অনেকটা কাটবে। কারণ ডলারের সাপেক্ষে টাকার দাম কমে যাওয়ার (ডলারের দাম বাড়া) অর্থ আগে নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা দিয়ে যত ডলার কেনা যেত, এ বার সেই পরিমাণ ডলার পেতেই বেশি টাকা খরচ করতে হবে। বিদেশে পড়ার ফি, থাকা-খাওয়া-সহ নানা খরচ ডলারেই মেটাতে হয়। ফলে পড়ুয়া যত ডলার খরচের হিসাব করে ঋণ নিয়েছিলেন, টাকার দাম কমলে আর ওই ঋণের অর্থে কুলিয়ে ওঠা যাবে না। কিন্তু ডলারে ঋণ পেলে হাতে একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত খরচ চালানোর অর্থ মজুত থাকবে। ব্যাঙ্কের খাতায় কিন্তু ডলারে নেওয়া ঋণের পরিমাণ টাকার অঙ্কেই লেখা থাকবে। তা শোধও করতে হবে টাকায়।
উদাহরণ: ধরুন, কারও বিদেশে পড়তে খরচ হবে ৬০ হাজার ডলার। ব্যাঙ্ক ৪০ হাজার ডলার ঋণ মঞ্জুর করল। এ বার প্রথম কিস্তিতে পড়ুয়া ঋণ নিল ১০ হাজার ডলার। ব্যাঙ্কের খাতায় হিসাব লেখা থাকবে ওই ঋণ নেওয়ার দিনে ১০ হাজার ডলারের দাম ভারতীয় টাকায় যা ছিল, সেই অঙ্ক। আর এ ভাবেই পড়ুয়া ঋণের পুরো ৪০ হাজার ডলার পাবে। ফলে ৬০ হাজার ডলারের মধ্যে ৪০ হাজার খরচের ক্ষেত্রে তার কোনও অনিশ্চয়তা তৈরি হবে না।

বিদেশ পাড়ির আগে
এত ঝুঁকি, এত অনিশ্চয়তা, তবু বিদেশে গিয়ে পড়াশোনার স্বপ্ন এর পরেও দেখবেন বহু পড়ুয়া। উন্নত দুনিয়ার উৎকৃষ্ট শিক্ষা পরিকাঠামো ও তার মানের বিচারে সেটা অস্বাভাবিক বা অনুচিত বলা যায় না। তবে যে-হারে বিদেশি মুদ্রার দাম বাড়ছে, তাতে বিদেশে সন্তানকে পড়ানো সত্যি কতটা লাভজনক হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছেন অনেকেই। তাঁদের মতে, ছেলে-মেয়েকে সেরা শিক্ষার জন্য কষ্ট করে বিদেশে পাঠানো না-হয় ঠিক আছে। কিন্তু তা বলে শুধু বিদেশে পড়ানোর জন্যই পড়ানো কতটা যুক্তিযুক্ত, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন তাঁরা।
এ ব্যাপারে অনেকের মত, মোটা মাইনের চাকরি নিশ্চিত করাই সন্তানকে বিদেশে পড়তে পাঠানোর প্রধান উদ্দেশ্য অধিকাংশ অভিভাবকের। কিন্তু বর্তমানে আমেরিকা, ইউরোপের চাকরির বাজারে আগের তুলনায় প্রতিযোগিতা বেড়েছে। ফলে কোনও কারণে পড়া শেষ করেই চাকরির নিয়োগপত্র হাতে না-পেলে, তা সমস্যার কারণ হতে পারে। অতএব সব থেকে ভাল হবে, এই সমস্ত বিড়ম্বনা এড়ানোর জন্য যদি আগে থেকেই কতকগুলি বিষয় মাথায় রেখে এগোন:
বাজেট করুন ভেবে-চিন্তে। বিদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে এক একটি কোর্স করার খরচ এক এক রকম। যেমন, মাঝারি মানের বিশ্ববিদ্যালয়ে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতকোত্তর পাঠ্যক্রমে টাকার অঙ্কে দু’বছরের জন্য খরচ প্রায় ৪০ লক্ষ। কাজেই আপনার যা আর্থিক ক্ষমতা, প্রথমেই তার শেষ বিন্দু পর্যন্ত নিঃশেষ করে খরচের হিসাব করবেন না। মনে রাখবেন, ডলারে টাকার দামের ওঠা-পড়া চলবেই। ফলে যে-কোনও মুহূর্তে খরচ এক লাফে অনেকটা বেড়ে যেতে পারে। খরচ হিসাবের সময়ে সব থেকে খারাপ পরিস্থিতির কথা ভেবে এগোন। ভেবে দেখুন, সেই পরিস্থিতিটা সামলানোর ক্ষমতা আপনার আছে তো?
শুধু পড়ার খরচ চালানো নয়, পরে ঋণ শোধের বিষয়টিও মাথায় রাখবেন। শিক্ষা ঋণ পরিশোধের সময় সাধারণত সাত বছর। কোর্স শেষের পর ৬ মাস পর্যন্ত কোনও টাকা না-মেটালেও চলে। এটা ‘মোরেটোরিয়াম পিরিয়ড’। তবে এর মধ্যে চাকরি পেয়ে গেলে, কিস্তি দেওয়া শুরু হবে। মোরেটোরিয়াম পিরিয়ড-এ ঋণ শোধ করতে না-হলেও, ওই সময়ের জন্য সুদ গোনা হবে। সেই সুদ না-মেটানো হলে, তা মূল ঋণের সঙ্গে যুক্ত হবে। ঋণ পরিশোধের সাত বছর ধরা হবে প্রথম কিস্তি চালুর পর থেকে। জেনে রাখুন, ঋণের পরিমাণ ২০ লক্ষ টাকা হলে সাত বছর ধরে মাসে ব্যাঙ্কের কিস্তি (ইএমআই) বাবদ দিতে হবে ৪৭ হাজার টাকা।
আমেরিকা ও ইউরোপের দেশগুলিও গত বেশ ক’বছর ধরে আর্থিক সঙ্কটের মধ্যে দিয়ে হাঁটছে। ফলে বেকারত্ব বেড়েছে সেখানেও। তাই বিদেশের চাকরির বাজারে কিন্তু এখন প্রতিযোগিতা তুঙ্গে।
কোর্স পছন্দ করার আগে ভাবুন, তা শেষ করে কত বেতনের কী চাকরি পেতে পারেন আপনি। এমন নয় তো যে, তুলনায় কম খরচে দেশের মাটিতে অন্য কোনও কোর্স করলে কেরিয়ার বেশি ভাল হতে পারে?
বেছে নেওয়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি কোন শহরে অবস্থিত, তা খেয়াল রাখুন। খবর নিন সেই শহরে বাস করা কতটা খরচসাপেক্ষ। পারলে খরচ কম হবে এমন শহরে অবস্থিত প্রতিষ্ঠান বাছুন।
বিদেশের মাটিতে ব্যক্তিগত খরচ কম ডলারে বেঁধে রাখার জন্য মানসিক ভাবে প্রস্তুত থাকুন।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.