ডেঙ্গিতে আক্রান্ত হয়ে আরও এক কিশোরের মৃত্যু হয়েছে। সোমবার রাতে শিলিগুড়ির প্রধাননগরে একটি নার্সিংহোমে সাদ্দাম হুসেন (১৬) নামে ওই যুবকের মৃত্যু হয়। তাঁর বাড়ি শিলিগুড়ি পুরসভার ৪৩ নম্বর ওয়ার্ডে গাঁধীনগরে। সোনাদা হাই স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্র। সম্প্রতি পাহাড়ে বন্ধের জেরে শিলিগুড়ির বাড়িতে এসেছিল। গত ২৯ অগস্ট ডেঙ্গিতে আক্রান্ত হয়ে ৪২ নম্বর ওয়ার্ডে রশ্মি মাঝি (১৭) মৃত্যু হয়। এর পর জ্বরে আক্রান্ত হয়ে রেখা সাহানি নামে এক কিশোরী মারা যায়। তবে পরীক্ষা না হওয়ায় তাঁর ডেঙ্গি হয়েছিল কি না তা নিশ্চিত হতে পারেনি স্বাস্থ্য দফতর। এর পরে সাদ্দামের মৃত্যুতে ডেঙ্গি প্রতিরোধের কাজ কতটা হচ্ছে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাদ্দামের পরিবার সূত্রে জানা গিয়েছে, গত ৪ সেপ্টেম্বর জ্বরে আক্রান্ত ওই কিশোরকে প্রধাননগরের একটি নার্সিংহোমে ভর্তি করানো হয়েছিল। পরীক্ষায় ডেঙ্গি ধরা পড়তেই তার রক্তে অনুচক্রিকার সংখ্যা জানা হয়। তাতে ধরাও পরে রক্তে অণুচক্রিকা কমে যাওয়ার বিষয়টি। যা ডেঙ্গি রোগীর ক্ষেত্রে হয়েথাকে। অথচ তার পরেও অনুচক্রিকার সংখ্যা ঠিক রাখতে বাইরে থেকে শরীরে তা দেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ। তাঁর বাবা সানুয়ার হুসেনের অভিযোগ, “সোমবার পরীক্ষায় দেখা যায় অনুচক্রিকা কমে ৭০ হাজার হয়েছে। এর পর ছেলের শরীরে অনুচক্রিকা দেওয়ার কথা জানায় চিকিৎসক। অথচ আগে থেকে ব্যবস্থা নিলে এ ভাবে ওকে মরতে হত না।” |
ডেঙ্গিতে মৃত কিশোরের শোকার্ত পরিজনেরা। |
নার্সিংহোমের চিকিৎসক আসিফ হুসেন বলেন, “ওই রোগী ডেঙ্গি ‘শক সিনড্রোম’-এ আক্রান্ত হয়েছিলেন। তার জেরে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছে। ভর্তির পর থেকে সাদ্দামের রক্তে ১ লক্ষ থেকে ১ লক্ষ ৩০ হাজার অনুচক্রিকা ছিল। সোমবার তা কমে ৬০ হাজারে চলে আসে। এর পরেই অনুচক্রিকা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। নার্সিংহোমের তরফে ঠিক ভাবেই চিকিৎসা হয়েছে।” ডেঙ্গিতে আক্রান্ত হয়ে একই নার্সিংহোমে ভর্তি রয়েছে মৃত কিশোরের আত্মীয় সম্পর্কে মামা ১৭ বছরের আর এক কিশোর। এলাকায়া জ্বরে আক্রান্ত কয়েকশো রোগী রয়েছেন বলে কাউন্সিলর রাগিণী সিংহ দাবি করেছেন। তাদের অনেকেই ডেঙ্গি আক্রান্ত। অথচ এলাকায় মশা মারতে তেল ছড়ানো বা সচেতনতার কাজ সেভাবে করা হচ্ছে না বলে অভিযোগ তুলেছেন তিনি। বাসিন্দাদের অভিযোগ, ডেঙ্গি প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না নিয়ে নেতা-মন্ত্রীরা ব্লিচিং পাউডার ছড়াচ্ছেন। অথচ যা করণীয় সেটা হচ্ছে কি না সে দিকে তাঁরা গুরুত্ব দিচ্ছেন না। এ দিন গাঁধীনগরের বাসিন্দা নিরাজ কুরেশি, সাহেরা খাতুন, রাবিয়া খাতুনরা জানান, এলাকায় মশা মারার তেল স্প্রে করা হয়নি। সচেতনতা প্রচারেও অভাব রয়েছে। কাউন্সিলর বলেন, “সম্প্রতি রেখা সাহানি বলে এক কিশোরী মারা গিয়েছিলেন। উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী ওয়ার্ডে গিয়ে জ্বরে আক্রান্তদের অ্যাম্বুল্যান্সে করে মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠান। তাঁদের অধিকাংশকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। সেখান থেকে তাঁরা অনেকে হেঁটে, অটোতে ফিরেছে।” তাঁর দাবি, তেল পর্যাপ্ত মিলছে না। তাই এলাকায় অনেক জায়গাতেই স্প্রে করা যায়নি।
স্বাস্থ্য দফতরের একটি সূত্রই জানিয়েছে, পুর এলাকা ছাড়াও মাটিগাড়া ব্লকে ডেঙ্গি মারাত্মক আকার নিয়েছে। প্রমোদনগর, মাটিগাড়া বাজার এলাকা থেকে প্রচুর জ্বরে আক্রান্ত রোগী আসছেন। প্রমোদনগরের বাসিন্দা অরুণ সাহানির পরিবারের ৮ জন ডেঙ্গিতে আক্রান্ত। উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে তাঁর চিকিৎসা চলছে। শিলিগুড়ি জেলা হাসপাতাল এবং উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ডেঙ্গিতে আক্রান্তদের চিকিৎসা পরিষেবা ঠিক মতো মিলছে না বলে অভিযোগ উঠেছে। অনেকে মশারি পাচ্ছেন না। অনেককে বাইরে থেকে ওষুধ কিনতে হচ্ছে। ডেঙ্গি ওয়ার্ডে জায়গার অভাবে সাধারণ বিভাগের অন্যান্য রোগীদের সঙ্গেও তাঁদের রাখা হয়েছে। ডেঙ্গি আক্রান্তদের অনেকে মশারি না পাওয়ায় অন্য রোগীদের মধ্যেও মশার কামড়ে ডেঙ্গি সংক্রমণ ছড়াতে পারে বলে আতঙ্ক ছড়িয়েছে।
উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী তথা উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের রোগী কল্যাণ সমিতির চেয়ারম্যান গৌতম দেব মৃত সাদ্দামের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছেন। তিনি বলেন, “ডেঙ্গি প্রতিরোধে পুরসভার তরফে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। স্বাস্থ্য দফতরকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। তারা ইতিমধ্যেই সে কাজ শুরু করেছেন। কলকাতায় রয়েছি। বুধবার শহরে ফিরেই পরিস্থিতি নিয়ে বৈঠক ডাকা হবে।” মন্ত্রী জানান, প্রকাশনগর এলাকা থেকে অ্যাম্বুল্যান্স দিয়ে ৩০ জন জ্বরে আক্রান্ত রোগীকে মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছিল। তার মধ্যে ২৬ জনকে ভর্তি করানো হয়েছে। বাকিরা হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে চাননি। তাঁরা ফিরে এসেছেন। |
ডেঙ্গি প্রতিরোধে পুরসভার ১১ নম্বর ওয়ার্ডে লার্ভা মারার তেল ছড়াতে
তদারকি করছেন মেয়র। মঙ্গলবার বিশ্বরূপ বসাকের তোলা ছবি। |
শিলিগুড়ি পুর এলাকা নতুন করে আরও অন্তত ২৫ জনের রক্তে ডেঙ্গির জীবানু মিলেছে। পুর এলাকা এবং শহরের আশেপাশে মিলিয়ে ডেঙ্গি আক্রান্তের সংখ্যা ৩০০ ছাড়িয়ে গিয়েছে। এ দিন মহকুমা প্রশাসনের তরফে সমস্ত দফতরের আধিকারিকদের নিয়ে মাসিক বৈঠকেও ডেঙ্গি পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। পূর্ত বিভাগের মতো দফতরের কাছে স্বাস্থ্য দফতরের তরফে নির্মাণ কাজের জায়গাগুলিতে যাতে কোথাও জল জমে না থাকে তা দেখতে বলা হয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন এলাকায় মশার লার্ভানাশক তেল স্প্রে করতে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সদস্যদের নিয়ে এ দিন দল তৈরি করেন রাজ্যের স্বাস্থ্য বিষয়ক স্ট্যান্ডিং কমিটির চেয়ারম্যান রুদ্রনাথ ভট্টাচায। তিনি জানান, আগামী বৃহস্পতিবার থেকে এক একটি দলে ৪ জন করে ৪০ টি দল স্প্রে করার কাজে নামবে। তাঁর বিধায়ক এলাকা তহবিল থেকে স্প্রে করার ৪০ টি যন্ত্র কেনা হচ্ছে। যে সমস্ত এলাকায় রোগের প্রকোপ ছড়িয়েছে এমন ১০ টি ওয়ার্ডে প্রথম দিন স্প্রে করা হবে।
বাম কাউন্সিলরদের অভিযোগ, পরিস্থিতি মোকবিলার যে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত তার কোনটাই হয়নি। পুরসভার স্বাস্থ্য বিভাগের প্রাক্তন মেয়র পারিষদ শালিনী ডালমিয়া বলেন,“সচেতনতা প্রচারে হোর্ডিং, পোস্টার, লিফলেট বিলি করতে হবে। তা হচ্ছে না। বিভিন্ন এলাকায় জমা জল দ্রুত পরিষ্কার করতে হবে।” পুরসভা এবং স্বাস্থ্যদফতর মধ্যে সমন্বয় থাকা উচিত বলে জানান তিনি। পর্যাপ্ত মশা মারার তেল মিলছে না বলে অভিযোগ তোলেন তৃণমূলের কাউন্সিলররা। প্রতিটি ওয়ার্ডের জন্য গত ১০ দিনে ৫ লিটার করে মশার লার্ভা মারার তেল দেওয়া হয়েছে বলে দাবি করেন সাফাই বিভাগের মেয়র পারিষদ স্বপন চন্দ। ৩৫ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল কাউন্সলির জয়দীপ নন্দী বলেন, “আমার ওয়ার্ডে ১ লিটার তেল পেয়েছি। প্রয়োজনের তুলনায় তা নাম মাত্র।” একই কথা বলেন ৩৮ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল কাউন্সিলর দুলাল দত্ত। স্বাস্থ্য বিভাগের মেয়র পারিষদ শিখা রায় বলেন, “আমরা বিভিন্ন ওয়ার্ডে ক্যাম্প করছি, বাড়িতে গিয়েও সচেতনতা করা হচ্ছে। যাঁরা অসুস্থ তাঁদেরকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। প্রতিটি ওয়ার্ডে প্রয়োজন অনুযায়ী তেল, ব্লিচিং দেওয়া হয়েছে।” মেয়র গঙ্গোত্রী দত্ত জানান, ৫ টি ফগিং মেশিন, ১০০ টি স্প্রে মেশিন, মশা মারার তেলের মতো বিভিন্ন জিনিস কিনতে সুজার কাছে ৪০ লক্ষ টাকা চাওয়া হয়েছে।
|