মাঝে দু’মাসের ব্যবধান। ফের পরপর শিশুমৃত্যুর ঘটনা পুরুলিয়া দেবেন মাহাতো সদর হাসপাতালে। এ বার ৪৮ ঘণ্টায় ন’টি শিশুর মৃত্যু হয়েছে সেখানে। সোমবার ৫টি ও মঙ্গলবার ৪টি শিশুর মারা যায়।
মৃত্যুর এই হার খুব অস্বাভাবিক নয় জানিয়েও সদর হাসপাতাল হলেও পরিকাঠামোগত দুর্বলতার কারণেই যে এমন ঘটনা, তা আড়ালে মেনে নিচ্ছেন পুরুলিয়া জেলা স্বাস্থ্য দফতরের কর্তারা। এমনকী, সদ্যোজাতদের জন্য তৈরি হওয়া এসএনসিইউ-তে (সিক নিউ বর্ন কেয়ার ইউনিট) বাইরে থেকে আসা ওই মুমূর্ষু শিশুদের ভর্তি নেওয়াও সম্ভব হয়নি। চলতি জুন মাসেও এই হাসপাতালে তিন দিনে ১৩টি শিশুর মৃত্যুর পরেও পরিকাঠামোর এই দুর্বলতার কথা সামনে এসেছিল। জেলার মন্ত্রী শান্তিরাম মাহাতো বলেন, “সত্যিই পরিকাঠামোর অভাবে মৃত্যু হয়েছে, না কি অন্য কোনও কারণে, তা জানতে আমি রিপোর্ট চাইব। স্বাস্থ্য দফতরের সঙ্গেও বৈঠকে বসব।”
তবে, শিশুমৃত্যুর ঘটনাকে ছাপিয়ে মঙ্গলবার হাসপাতালে হইচই পড়ে যায় কুকুরের মুখে একটি মৃত শিশুর মুন্ডু থাকার দৃশ্যকে কেন্দ্র করে। হাসপাতাল চত্বরের ঠিক পিছনে অর্থাৎ, মর্গের পিছনের দিকে এ দিন সকালের দিকে ওই দৃশ্য দেখে অনেকেই শিউরে ওঠেন। হাসপাতাল চত্বরে ঘুরে বেড়াতে দেখা যায় যে সব নেড়ি কুকুরকে, সেগুলির একটির মুখে নবজাতকের মুন্ডু কী করে এল, সে প্রশ্ন তোলেন এলাকার মানুষজন। নবজাতকদের মৃতদেহ সুরক্ষিত রাখা হয় কি না, এই প্রশ্নও ওঠে। সাত সকালে অনেকেই এই ভয়ঙ্কর দৃশ্যের সাক্ষী থাকলেও ঘটনাটি উড়িয়ে দিয়েছেন হাসপাতালের সুপার নীলাঞ্জনা সেন। তাঁর দাবি, “মৃতদেহ যথেষ্ট সুরক্ষিতই রাখা হয় মৃতদেহ। এ রকম ঘটনার খবর নেই।” |
হাসপাতাল সুপার জানিয়েছেন, মৃত ৯টি শিশুর মধ্যে সবাই নবজাতক না হলেও বেশির ভাগেরই বয়স এক মাসের মধ্যে। মৃতদের মধ্যে এই হাসপাতালেই জন্ম নেওয়া তিনটি শিশু রয়েছে। পাড়া, হুড়া, পুঞ্চা, পুরুলিয়া ২-সহ দূরের কয়েকটি ব্লক থেকে সদর হাসপাতালে আসা এই শিশুগুলির বেশির ভাগই অপরিণত (প্রিম্যাচিওর বেবি) এবং ওজন স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক কম ছিল বলেও সুপারের দাবি। এদের বেশির ভাগকেই মারাত্মক সঙ্কটাপন্ন অবস্থা সদর হাসপাতালে আনা হয়েছিল। হাসপাতালের শিশুরোগ বিভাগের এক চিকিৎসকের কথায়, “প্রাথমিক ভাবে মনে হচ্ছে, বেশিরভাগ শিশুই শ্বাসকষ্টের শিকার হয়ে মারা গিয়েছে। জন্মের সময় কম ওজন হলে এ ধরনের শ্বাসকষ্টের শিকার হয় নবজাতকেরা।” আর এক চিকিৎসক বলেন, “ইচ্ছা থাকলেও বাইরে থেকে আসা মুমূর্ষু নবজাতকদের সব সময় এসএনসিইউ-তে ভর্তি করানো আমাদের পক্ষে সম্ভব হয় না। কারণ এখন মাত্র ১৮টি শয্যা। তা সব সময় ভর্তি থাকে। ঝাড়খণ্ড থেকেও শিশুদের এখানে নিয়ে আসা হয়।”
জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক মানবেন্দ্র ঘোষও বলেন, “প্রাথমিক রিপোর্ট অনুসারে, পরিকাঠামোর অভাবেই কম ওজনের এই শিশুদের মৃত্যু হয়েছে। এসএনসিইউ বিভাগে শয্যার অভাবে মুমূর্ষু ওই শিশুদের ভর্তি নেওয়া যায়নি। তবে, মৃত্যুর কারণ ঠিক কী, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।” পরিকাঠামোর অভাব দূর করতে আগামী অক্টোবরে তাঁরা অতিরিক্ত ৩২ শয্যার একটি নতুন এসএনসিইউ চালু করছেন বলে তিনি জানিয়েছেন। ঘটনার গুরুত্ব বুঝে সন্ধ্যায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ নিজেদের মধ্যে বৈঠকে বসেন। মানবেন্দ্রবাবু জানান, জেলার ১৮টি ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে এসএনএসইউ (সিক নিউ বর্ন স্টেবিলাইজেশন ইউনিট) চালু করা হবে। তাতে কিছুটা হলেও সদর হাসপাতালের উপরে চাপ কমবে বলে স্বাস্থ্যকর্তাদের আশা। বিভিন্ন মহল প্রশ্ন তুলেছে, রঘুনাথপুর মহকুমা হাসপাতালে কেন এমন কোনও কেন্দ্র এখনও চালু করা গেল না।
রাজ্য স্বাস্থ্য দফতরের টাস্ক ফোর্সের চেয়ারম্যান ত্রিদিব বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন, এই শিশুমৃত্যুর হার খুব একটা অস্বাভাবিক নয়। পরিকাঠামোগত দুর্বলতা প্রসঙ্গে তাঁর বক্তব্য, “বাম আমলে এই হাসপাতালের মানোন্নয়নের জন্য কিছুই করা হয়নি। আমরা ধাপে ধাপে এর উন্নতির চেষ্টা করছি। খুব শীঘ্রই ওই হাসপাতালে ৬৪ শয্যার এসএনসিইউ হবে।” তবে, মৃত এক নবজাতকের মুন্ডু কুকুরে খাওয়া নিয়ে তিনি কোনও মন্তব্য করতে চাননি। |