তিন মাসের মাথায় কামদুনি মামলার চার্জ গঠন করল পুলিশ। কিন্তু আট অভিযুক্তের বিরুদ্ধেই ধর্ষণ ও খুনের অভিযোগ আনা হয়েছে কি না, তাই নিয়ে চাপান-উতোরে মঙ্গলবার দফায় দফায় উত্তেজনা ছড়ায়। প্রথমে আদালত চত্বরে এবং পরে বি বা দী বাগ এলাকায় বিক্ষোভ দেখান কামদুনির বাসিন্দারা। পুলিশের সঙ্গে তাঁদের ধস্তাধস্তির মধ্যে পড়ে জখম হন নির্যাতিতার ভাইও।
এ দিন দুপুরে কলকাতার জেলা ও দায়রা আদালতে কামদুনি মামলায় পুলিশ যে চার্জশিট পেশ করে, তাতে অভিযুক্তদের সকলের বিরুদ্ধেই ধর্ষণ-গণধর্ষণ-খুন-সহ মোট সাতটি ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে বলে সরকারি আইনজীবী দীপকরঞ্জন ঘোষ এবং অনিন্দ্য রাউত দাবি করেন। কিন্তু নির্যাতিতার পরিবারের আইনজীবী জয়ন্তনারায়ণ চট্টোপাধ্যায় আদালতের বাইরে পাল্টা দাবি করেন, অভিযুক্তদের সকলের বিরুদ্ধে খুন ও ধর্ষণের মামলা দায়ের হয়নি। |
জয়ন্তবাবুর অভিযোগ যে ভাবে চার্জ গঠন হয়েছে, তাতে এক জন ছাড়া বাকিদের ছাড় পেয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এই অভিযোগের জেরে কামদুনির বাসিন্দাদের একাংশ ক্ষিপ্ত হয়ে এ দিন বিকেলে বি বা দী বাগ এলাকায় অবস্থান বিক্ষোভ করেন। ওই চত্বরে ১৪৪ ধারা থাকায় পুলিশ অবরোধ তুলতে গিয়েছিল। পুলিশের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের ধস্তাধস্তি হয়।
এ দিন বেলা একটা থেকেই কলকাতা জেলা ও দায়রা আদালতের (বিচার ভবন) বাইরে কামদুনির জনা চল্লিশ বাসিন্দা ‘কামদুনি প্রতিবাদী মঞ্চে’র নেত্রী মৌসুমী কয়াল এবং স্থানীয় প্রাথমিক স্কুলের প্রধান শিক্ষক প্রদীপ মুখোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে স্লোগান দিয়ে বিক্ষোভ দেখাচ্ছিলেন। তাঁদের দাবি ছিল, কামদুনির ঘটনার সিবিআই তদন্ত করতে হবে। নির্যাতিতার পরিবারের ব্যক্তিগত আইনজীবীকে মামলায় সক্রিয় অংশগ্রহণ করতে দিতে হবে। বেলা আড়াইটে নাগাদ চার্জ গঠন শুরুর পরেও বিক্ষোভ চলছিল। সেই আওয়াজ পৌঁছয় আদালতের মধ্যে। অভিযুক্তদের আইনজীবী ফিরোজ এডুলজি এবং সঞ্জীব দাঁ বিচারকের কাছে আবেদন করেন, আদালত চত্বরে ১৪৪ ধারা বজায় রয়েছে। অথচ বিক্ষোভকারীরা তা না-মেনে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছেন। আদালতের কাজে বিঘ্ন ঘটাচ্ছেন। কিন্তু হেয়ার স্ট্রিট থানার পুলিশ তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে না। বিচারক (দু’নম্বর বেঞ্চ) সঞ্চিতা সরকার জানান, তিনি এ ব্যাপারে প্রয়োজনীর নির্দেশ জারি করবেন। |
বিক্ষোভ দেখাতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন ধর্ষিত ও নিহত কলেজছাত্রীর ভাই।
তাঁকে ঘটনাস্থল থেকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। মঙ্গলবার বি বা দী বাগে।— নিজস্ব চিত্র। |
এ দিন এজলাসে কামদুনির মামলার আট অভিযুক্তের প্রত্যেককেই হাজির করানো হয়েছিল। বিচারকের নির্দেশে সরকারি আইনজীবী দীপকবাবু সইফুল আলি-আনসার আলি-শেখ এমানুল ইসলাম-আমিনুর ইসলাম-ভোলা নস্কর-গোপাল নস্কর-আমিন আলি এবং নুর আলিকে জানান, কী কী চার্জ তাঁদের বিরুদ্ধে গঠন করা হয়েছে। পরে সরকারি আইনজীবীরা সাংবাদিকদের জানান, অভিযুক্তদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধেই ধর্ষণ-গণধর্ষণ-খুন-তথ্যপ্রমাণ লোপাট-অপরাধে মদত-ষড়যন্ত্র এবং জোর করে আটকে রাখার অভিযোগ আনা হয়েছে। অভিযুক্তরা যদিও প্রত্যেকেই দাবি করে, তারা নির্দোষ। সইফুল আলি জানায়, ঘটনার সময় সে এলাকায় ছিল না। তবে অভিযুক্তদের আইনজীবীরা চার্জ গঠনের বিরোধিতা করেননি।
সরকারি আইনজীবী দীপকবাবু বিচারককে জানান, কামদুনিতে কলেজছাত্রীকে গণধর্ষণ করা হয়েছিল। রাজ্য ও কেন্দ্রীয় ফরেন্সিক রিপোর্ট উল্লেখ করে তিনি বলেন, ছাত্রীর শরীরে একাধিক অভিযুক্তের নখের আঁচড় মিলেছে। ছাত্রীর হাতের আঙুলেও একাধিক অভিযুক্তের রক্তের দাগ মিলেছে। ১৮ তারিখ থেকে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হবে। সরকারি আইনজীবীরা বিচারকের কাছে আবেদন জানান, বিচারপর্ব গোপনে (ইন ক্যামেরা) করা হোক। কারণ, নির্যাতিতার মৃত্যু হলেও তাঁর এবং তাঁর পরিবারের মানমর্যাদার প্রশ্ন এখানে জড়িত। তা ছাড়া ধর্ষণ বা গণধর্ষণের মামলার বিচার গোপনে হওয়াই বাধ্যতামূলক। বিচারক জানান, তিনি পরে এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানাবেন।
অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে খুনের মামলা দায়ের করা হয়নি বলে যে অভিযোগ উঠেছে, সেই প্রসঙ্গে সরকারি আইনজীবী অনিন্দ্য রাউত পরে বলেন, “খুনের মামলা দায়ের করা হয়েছে কি না, তা বিচারকই বলবেন।” অনিন্দ্যবাবুর অভিযোগ, গোড়া থেকেই মামলাটি দুর্বল করে দেওয়ার চেষ্টা করছেন নির্যাতিতার পরিবারের আইনজীবী। ওই আইনজীবী নির্যাতিতার পরিবারকে সুবিচার দিতে চান না বলে তাঁর দাবি। চার্জ গঠন শেষে বিকেল সওয়া তিনটে নাগাদ কামদুনির বাসিন্দাদের একাংশ মিছিল করে কাউন্সিল হাউস স্ট্রিট এবং হেয়ার স্ট্রিটের সংযোগস্থলে জড়ো হন। রাস্তার উপর বসে মোমবাতি জ্বালিয়ে তাঁরা বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করেন। তার জেরে ওই রাস্তায় যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। মহাকরণ থেকে ঢিল ছোড়া দূরত্বে এই অবরোধ তুলতে গিয়ে সমস্যায় পড়ে পুলিশ। পুলিশের উদ্দেশে গালিগালাজ করতে থাকেন বিক্ষোভকারীরা। কামদুনির বাসিন্দাদের সঙ্গে পুলিশের ধস্তাধস্তি হয়। অসুস্থ হয়ে পড়েন নিহত ছাত্রীর ছোট ভাই। পুলিশ তাঁকে প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। তাঁর মাথার স্ক্যান করানো হয়। পরে তাঁকে ছেড়েও দেওয়া হয়। পুলিশ জানায়, বেআইনি ভাবে জড়ো হয়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির জন্য আট জন পুরুষ ও তিন মহিলাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। পরে তাঁদের ব্যক্তিগত জামিনে ছেড়ে দেওয়া হয়। মৌসুমী কয়ালকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, কী কারণে ১৪৪ ধারা ভেঙে তাঁরা রাস্তায় বিক্ষোভ করছেন। তিনি বলেন, “সরকারি আইনজীবী অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে খুনের মামলা দেননি। সেই কারণেই আমরা বিক্ষোভ দেখিয়েছি।” পুলিশের সঙ্গে তাঁদের ধস্তাধস্তির প্রতিবাদে রাতে নতুন করে বারাসতের স্থানীয় বাসিন্দা, মহিলা ও পড়ুয়ারা রাস্তা অবরোধ করেন।
|