|
|
|
|
নির্ভয়ার ধর্ষণ-খুনে অপরাধী
চার জনই
নিজস্ব প্রতিবেদন |
ফ্যাকাসে হয়ে যাওয়া শরীরটায় জ্বলজ্বল করত শুধু চোখ দু’টো। হাত-মুখ নেড়ে কোনও রকমে বলেছিলেন, বাঁচতে চান। আর ইচ্ছে বলতে ছিল একটাই, শাস্তি পাক দোষীরা।
১৬ ডিসেম্বর থেকে ১০ সেপ্টেম্বর। দিল্লি গণধর্ষণের ঘটনার ন’মাসের মাথায় চার অভিযুক্তকেই দোষী সাব্যস্ত করল সাকেতের ফাস্ট ট্র্যাক আদালত। ঐতিহাসিক মামলার ঐতিহাসিক সাজা ঘোষণার অপেক্ষা আর মোটে চব্বিশ ঘণ্টার। দোষী সাব্যস্ত আর এক নাবালকের আগেই তিন বছরের সাজা হয়ে গিয়েছে।
ডিসেম্বরের কনকনে ঠান্ডার রাতে দিল্লির চলন্ত বাসে গণধর্ষণ নাড়িয়ে দিয়েছিল গোটা দেশকে। তার পর থেকে প্রতিবাদ, বিক্ষোভ কম দেখেনি রাজধানী। জলকামান থেকে পুলিশের লাঠি সহ্য করেছে সবই। পায়ে পায়ে পৌঁছেছে রাষ্ট্রপতি ভবনের সামনে। আর্জি একটাই, যেন বন্ধ হয় ধর্ষণ। তার পরে যৌন হেনস্থা রুখতে নয়া আইন এনেছে কেন্দ্র। তবু খবরের শিরোনামে কখনও মুম্বই, কখনও কামদুনি, কখনও বা ফের দিল্লি। তাই আওয়াজ উঠেছিল, এমন শাস্তি হোক যাতে অন্য কেউ একই অপরাধ করার আগে দু’বার ভাবে। সেই দাবি মেনে নজিরবিহীন সাজা দেওয়ার পথে হাঁটবে কি না আদালত, আগামী কালই স্পষ্ট হয়ে যাবে সেটা।
তবে শাস্তি যে কড়া হতে চলেছে, বিশেষ আদালতের বিচারক যোগেশ খন্না সেই ইঙ্গিত দিয়ে রেখেছেন আজ। জানিয়েছেন, ধর্ষিতার বয়ান থেকে শুরু করে ডিএনএ পরীক্ষার রিপোর্ট, আঙুলের ছাপ থেকে মোবাইল ফোনের অবস্থান সব সাক্ষ্যপ্রমাণই বলছে ধর্ষণের সময় সেখানে ছিল মুকেশ সিংহ, বিনয় শর্মা, পবন গুপ্ত ও অক্ষয় ঠাকুর। বিচারকের কথায়, শুধু ধর্ষণ নয়। খুন করার জন্যই অসহায় তরুণীর উপরে সেদিন বীভৎস নির্যাতন চালিয়েছিল ওরা।
সাকেতের একটি মাল্টিপ্লেক্সে বন্ধুর সঙ্গে ‘লাইফ অফ পাই’ দেখে বাড়ি ফিরছিলেন প্যারামেডিক্যাল ছাত্রীটি। হিংস্র পশুর চোখে চোখ রেখেও তাকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়, সাগর পেরিয়ে যাওয়া যায় এক নৌকায় এমনই এক সেলুলয়েড স্বপ্ন হয়তো তখন দু’চোখের পাতায় ভাসছিল তাঁদের। কিন্তু নিজের শহরের চেনা রাস্তায় একটা বাসের মধ্যে কী অপেক্ষা করে থাকতে পারে, ভাবতে পারেননি। পুরুষ সঙ্গীকে মারধর করে বেঁধে রেখে, উপর্যুপরি ধর্ষণ ও নির্যাতন চালিয়ে নগ্ন অচৈতন্য দেহটি রাস্তার ধারে ফেলে পালিয়ে যায় সেই বাস। |
|
ধর্ষকদের ফাঁসিই চাই। মঙ্গলবার দিল্লিতে বিক্ষোভ। ছবি: পি টি আই |
ধর্ষিতার মেডিক্যাল রিপোর্টে জানা গিয়েছিল, বছর তেইশের ওই তরুণীর শরীরে এমন ভাবে লোহার রড ঢোকানো হয়েছিল যে ক্ষুদ্রান্ত্রের কিছু অংশ বেরিয়ে এসেছিল দেহের বাইরে। রায়ে সেই প্রসঙ্গ টেনে এনে বিচারক খন্না এ দিন বলেন, শুধু আঘাত করার জন্য এতটা নৃশংস কেউ হয় না। গণধর্ষণ ও খুনের পাশাপাশি মুকেশ-বিনয়-অক্ষয় ও পবনকে অপহরণ-ডাকাতি-চক্রান্ত-প্রমাণ লোপাটের চেষ্টার মতো মোট ১৩টি অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করেছে আদালত।
ঘটনার রাতে ওই বাসে অবশ্য ছিল মোট ছ’জন। শুনানি শুরু হওয়ার পর মার্চ মাসে তিহাড় জেলে আত্মহত্যা করে অন্যতম প্রধান অভিযুক্ত রাম সিংহ। সে-ও এই সব ক’টা অপরাধেই জড়িত ছিল বলে এ দিন জানান বিচারক খন্না। ষষ্ঠ অভিযুক্তের বয়স আঠেরো না পেরোনোয় তার বিচার হয়েছে কিশোর অপরাধীদের জন্য বিশেষ আদালতে। সবে দশ দিন আগেই সংশোধনাগারে তিন বছর কাটানোর শাস্তি হয়েছে তার। যদিও ঘটনার দিন সব চেয়ে নৃশংস আচরণ ছিল ওই নাবালকেরই।
কিশোর অপরাধীর শাস্তির বহর দেখে সে দিন ক্ষোভে ফেটে পড়েছিল নির্ভয়ার পরিবার। আদালত চত্বরেই অপরাধীর দিকে তেড়ে গিয়েছিলেন নির্ভয়ার ভাই। এই ঘটনাও আর পাঁচটা মামলার মতোই হারিয়ে যাচ্ছে, আক্ষেপের সুর ঝরে পড়েছিল অনেকের গলাতেই। দশ দিন পর অবশ্য কিছুটা হলেও বদলাল ছবিটা। পবন, বিনয়রা অপরাধী সাব্যস্ত হওয়ার পর উপযুক্ত শাস্তির আশায় এখন বুক বাঁধছেন তামাম ভারতবাসী।
আজ সকাল দশটা থেকেই আদালত ভবনের চার তলার ৩০৪ নম্বর কক্ষের সামনে দেশি-বিদেশি মিলিয়ে প্রায় ৫০টি সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিরা ভিড় জমিয়েছিলেন। তিহাড় থেকে প্রায় ২০ জন সশস্ত্র পুলিশ নিয়ে আসেন চার অভিযুক্তকে। বেরোনোর সময় ওদের সকলকেই বেশ বিচলিত দেখাচ্ছিল বলে তিহাড় সূত্রের খবর। প্রথমে জানা গিয়েছিল, সাড়ে ১০টায় রায় ঘোষণা হবে। একটু পরে জানানো হয়, সাড়ে ১২টা বাজবে। নির্ভয়ার বাবা-মা-ভাইয়ের সঙ্গেই রায় শুনতে হাজির ছিল অভিযুক্তদের পরিবারও। সাড়ে ১২টার কিছু আগেই সকলের সামনে ২৩৬ পাতার রায়ের নির্যাস পড়ে শোনান বিচারক খন্না। অভিযোগের গুরুত্ব বিচার করে দিল্লি গণধর্ষণকে ‘বিরলের মধ্যে বিরলতম’ আখ্যা দেন তিনি।
রায় ঘোষণার পর আদালতে সকলের সামনেই কান্নায় ভেঙে পড়ে ১৯ বছরের পবন। বিনয়ের চোখে-মুখেও স্পষ্ট ছিল অবিশ্বাসের ছাপ। হুঁশিয়ারি দেওয়ার মতো মেজাজে ছিল মুকেশই। এই কাজের ফল ভুগতে হবে বলে আদালতে দাঁড়িয়েই শাসায় সে। অভিযুক্ত পক্ষের কৌঁসুলিরাও আজকের রায় মানতে নারাজ। এটি একটি ‘রাজনৈতিক হত্যা’ বলে বর্ণনা করে তাঁদের দাবি, দেশবাসীকে সন্তুষ্ট করতেই ফাঁসানো হয়েছে তাঁদের মক্কেলদের। যাদের কারও কাছেই অর্থবল, বাহুবল বা লোকবল কিছুই ছিল না। এই রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে যাবেন তাঁরা।
১৬ ডিসেম্বরের রাতে চোখের সামনে রক্তাক্ত তরুণীকে পড়ে থাকতে দেখেও ঘটনাটা কোন থানার আওতায় পড়ছে, তা নিয়ে কথা কাটাকাটি করেই প্রথম কয়েক ঘণ্টা পার করে দিয়েছিল টহলদার পুলিশ। শেষে অবশ্য পুলিশই ওই তরুণী এবং তাঁর বন্ধুকে পৌঁছে দেয় সফদরজঙ্গ হাসপাতালে। ঘটনার শুরুতে পুলিশের এই গা-ছাড়া মনোভাব নিয়ে সমালোচনা কম হয়নি। প্রতিবাদী কণ্ঠকে সামলাতে গিয়েও নাজেহাল হয় রাজধানীর পুলিশ। যন্তর মন্তরে জড়ো হওয়া প্রতিবাদীদের ছত্রভঙ্গ করতে জলকামান থেকে লাঠি চালনা, কিছুই বাদ দেয়নি তারা।
ন’মাসের মাথায় শীলা দীক্ষিতের সেই পুলিশ আজ প্রথম প্রশংসা শুনল। তাও আবার খোদ বিচারকের মুখে। “এই মামলায় পুলিশের ভূমিকার আলাদা করে উল্লেখ করতেই হয়। যে ভাবে তারা আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিতে প্রমাণ জোগাড় করেছে, অন্য মামলাতেও যেন এমনটাই হয়” জানিয়েছেন বিচারক খন্না। বিশেষ তদন্তকারী অফিসার অনিল শর্মার কাজেরও আলাদা করে প্রশংসা করেন তিনি। নারী নির্যাতন রুখতে এর পর পুলিশ ধারাবাহিক ভাবে আগের চেয়ে কিছুটা বেশি সক্রিয়তা দেখাবে কি? বেনজির সাজা ঘোষণা হলে কি কমবে ধর্ষণের মতো অপরাধ? দেশবাসীর আলোচনার কেন্দ্রে এখন এই দু’টো প্রশ্নই। বিরোধী নেত্রী সুষমা স্বরাজ থেকে কংগ্রেস নেত্রী অম্বিকা সোনি, সিপিএমের বৃন্দা কারাট থেকে প্রাক্তন আইপিএস কিরণ বেদী সকলেই এ দিনের রায়ে খুশি।
আর নির্ভয়ার পরিবার? খুশি-অখুশির চেয়ে অনেক দূরে তাঁরা। চাইছেন শুধু চরম শাস্তি। নির্ভয়ার মা বলছেন, “ন’মাস ধরে এই দিনটার জন্য অপেক্ষা করছি। ফাঁসি ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারছি না।” |
• যে ভাবে হাত আর রড দিয়ে শরীর থেকে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বার করে আনা হয়েছিল,
তা এই মামলার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আঘাত নয়, খুন করাটাই উদ্দেশ্য ছিল। বিচারক যোগেশ খন্না
• ৯ মাস অপেক্ষা করেছি। ফাঁসি ছাড়া অন্য শাস্তির কথা ভাবতে পারছি না।
নির্ভয়ার মা |
|
ধর্ষণ-খুনের ৬ মুখ |
রাম সিংহ, বয়স ৩৩, বাসচালক।
বিচারাধীন অবস্থায় জেলে মৃত পাওয়া যায়।
মার্চ মাসে।
পুলিশের দাবি,
গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করেছে।
বছর কুড়ি আগে রাজস্থান
থেকে এসেছিল। থাকত রবিদাস বস্তিতে।
মাতাল হয়ে ঝগড়াঝাঁটি করত প্রায়ই।
ছিল মনের জোর।
২০০৯-এ হাতে রড ঢুকে যাওয়ার পরেও বাস চালিয়ে ফিরেছিল। |
|
মুকেশ সিংহ,
বয়স ২৬,বাসের ক্লিনার, চালাতও।
রাম সিংহের ভাই। থাকত রবিদাস বস্তিতে দাদার দুই কামরার বাড়িতে। ঘটনার রাতে সে বাস চালাচ্ছিল বলে দাবি করেছিল। তা মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। নির্ভয়া ও তাঁর বন্ধুকে রড দিয়ে পিটিয়েছিল, বীভৎস নির্যাতন করেছিল, হাত লাগিয়েছিল নির্ভয়ার ক্ষুদ্রান্ত্রের অংশ বার করে আনার কাজে। |
|
বিনয় শর্মা,
বয়স ২০, জিমের ফিটনেস ট্রেনার
থাকত রবিদাস বস্তিতে, রাম সিংহের বাড়ির কাছে। ঘটনার সময় বাসে ছিল না বলে দাবি করেছিল। আদালতে তা মিথ্যা প্রমাণ হয়েছে। দলে একমাত্র স্কুল পাশ। ইংরেজি বলতে পারে। কলেজের পরীক্ষা দেবে বলে জামিন চেয়েছিল। আর্জি খারিজ হয়। আদালত জেলেই পরীক্ষার ব্যবস্থা করার নির্দেশ দেয়। |
|
পবন গুপ্ত, বয়স ১৯, ফল বিক্রেতা
সংবাদমাধ্যমে খবর, বিচারের প্রথম পর্বে আদালতে বলেছিল, “ভয়ঙ্কর কাজ করেছি। আমার ফাঁসি হওয়া উচিত।” পরে পবন ও তার উকিল দাবি করে, ঘটনার সময় বাসে ছিল না, জলসা দেখতে গিয়েছিল। তার বাবার দাবি, বিকেলে দোকান বন্ধ করে বাড়ি ফিরে জলসা দেখতে গিয়েছিল। |
|
অক্ষয় সিংহ ঠাকুর,
বয়স ২৮, বাসের হেল্পার
ঘটনার পাঁচ দিন পর বিহার থেকে গ্রেফতার হয়। ঘটনার আগের দিন দেশে ফিরেছে বলে দাবি করেছিল। তা মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। অপহরণ, ধর্ষণ, খুন ও প্রমাণ লোপাটের অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। পড়াশোনা নামমাত্র। বছরখানেক আগে দিল্লিতে এসেছিল। বৌ ও একটি ছেলে আছে। তারা থাকে বিহারে। |
|
নাবালক,
ঘটনার সময় বয়স ছিল ১৭ বছর ৬ মাস।
জুভেনাইল বোর্ডের রায়ে তিন বছর সংশোধনাগারে কাটাবে। বাবা মানসিক ভাবে অসুস্থ। উত্তরপ্রদেশের গ্রাম থেকে ১১ বছর বয়সে ছেলেকে কাজের জন্য দিল্লিতে পাঠান মা। ছোটখাটো কাজ জুটিয়ে একাই থাকত দিল্লিতে। মা ধরে নিয়েছিলেন, ছেলে মারা গিয়েছে। ডিসেম্বরে শোনেন, গণধর্ষণে অভিযুক্ত সে। |
|
|
পুরনো খবর:
• চলন্ত বাসে গণধর্ষণ, বন্ধু-সহ তরুণীকে ছুড়ে ফেলা হল পথে
• নাবালক ধর্ষকের সাজা ৩ বছর, বিতর্ক |
|
|
|
|
|