কাজে দিচ্ছে নরমগরম চাপ, বলছে কেন্দ্র
দার্জিলিং সমস্যা সমাধানে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে নরমগরম রণকৌশল নিয়ে চলছেন, তাতেই পাহাড়ে বরফ গলার সম্ভাবনা দেখছে কেন্দ্র। প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয় সূত্রে বলা হচ্ছে, চাপের মুখে পড়ে বিমল গুরঙ্গ যদি ধর্মঘট ও জঙ্গি আন্দোলনের পথ ছাড়েন, তা হলে ত্রিপাক্ষিক বৈঠক ডেকে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করা হবে। রাজ্য ভাগের বিরোধিতা করলেও, পাহাড়ে শান্তি ফেরাতে মুখ্যমন্ত্রী আলোচনায় বসতে আপত্তি করবেন না বলেই মনে করছে কেন্দ্র।
পাহাড় নিয়ে ইতিমধ্যেই প্রধানমন্ত্রী ও কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে রিপোর্ট দিয়েছেন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা। বলা হয়েছে, মমতা যে গোর্খাদের থেকে লেপচা সম্প্রদায়কে আলাদা করার রণকৌশল নিয়েছেন, তাতে আর যা-ই হোক না কেন, পশ্চিমবঙ্গ ভাগের সম্ভাবনা কার্যত অসম্ভব হয়ে গিয়েছে। মমতা লেপচাদের জন্য আলাদা পার্বত্য পরিষদের কথা ঘোষণা করেছেন, তাদের অনুষ্ঠানেও যোগ দিয়েছেন। এই ঘটনা তাদের চাঙ্গা করেছে। ফলে গোর্খার ডাকা বন্ধের বিরোধিতায় পথেও নেমেছেন লেপচারা।
ছন্দে ফিরছে পাহাড়। বন্ধ শিথিল হতেই জোরকদমে শুরু হয়েছে কেনাবেচা।
সোমবার দার্জিলিঙের চকবাজারে। ছবি: রবিন রাই।
মমতার এই কৌশলকে অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের একটি উদ্ধৃতি দিয়ে ব্যাখ্যা করেছেন প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ের এক শীর্ষ অফিসার। ‘সত্যের কাছে পৌঁছতে গেলে ভাল দর্জি হতে হয়। আসল কাজটা হলো সঠিক পরিমাপ করা।’ ওই অফিসার বলেছেন, “মমতা এ ক্ষেত্রে সেই সঠিক পরিমাপটাই করেছেন। ফলে দার্জিলিং নিয়ে তাঁর নরমগরম কৌশল এখন সুফল দিচ্ছে।”
শুধু একটাই আশঙ্কা রয়েছে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের: এর ফলে লেপচা এবং গোর্খাদের মধ্যে সংঘর্ষের পরিস্থিতি না তৈরি হয়! তা হলে আইনশৃঙ্খলার অবনতি হতে পারে।
ইতিহাস বলছে, ১৮৩৫ সালে সিকিমের রাজার কাছ থেকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দার্জিলিঙের ইজারা পেয়েছিল। এ জন্য কোম্পানি সিকিমের রাজাকে প্রতি বছর ৬ হাজার টাকা করে দিত। তৎকালীন ব্রিটিশ প্রশাসক ডব্লিউ ডব্লিউ হান্টার লিখেছেন, দার্জিলিঙে বসবাসকারীরা মূলত লেপচা সম্প্রদায়ভুক্ত। পরে এখানে অনেক চা-বাগান গড়ে উঠলে নেপাল থেকে অনেক গোর্খা আসেন কাজের খোঁজে।
আবার কলকাতা থেকে চিকিৎসক, হাকিম, পেশাদার বাঙালি-অবাঙালিরাও এসে বাস শুরু করেন। স্বাধীনতার পর সিকিমের এই এলাকা পশ্চিমবঙ্গেই থেকে যায়। চিনের সম্ভাব্য বিপদের কথা মাথায় রেখেই ১৯৫২ সালে জওহরলাল নেহরু নেপালের সঙ্গে চুক্তি করেন। ব্রিটিশদের লিখিত ইতিহাস বলছে, দার্জিলিংবাসীরা আদিতে লেপচা। তার সঙ্গে মিলেছে নেপাল থেকে আসা গোর্খারা। কিন্তু অতীতে সুবাস ঘিসিং এবং আজ বিমল গুরুঙ্গ, দু’পক্ষই বলছেন “এটা লিখিত ইতিহাস। ব্রিটিশরা স্যানিটোরিয়াম বানানোর আগে থেকেই এখানে গোর্খারা বসবাস করত। আমরা এই এলাকার গোর্খা। তাই গোর্খাল্যান্ড চাই।”
এই কথা বলে আন্দোলন করলেও দার্জিলিং পার্বত্য পরিষদ চুক্তি সইয়ের সময় গোর্খাল্যান্ডের দাবি থেকে সরে আসেন ঘিসিং। জিটিএ চুক্তির সময় গুরুঙ্গ কিন্তু আলাদা গোর্খাল্যান্ড রাজ্য গঠনের দাবি ছাড়ার কথা বলেননি। বরং চুক্তিতে গোর্খাল্যান্ড শব্দটি যুক্ত করা হয়েছে। মমতা বলেছেন, গোর্খা সত্তাকে সম্মান জানাতেই এই শব্দটি রাখা হয়েছে। কিন্তু পৃথক রাজ্য কখনওই মেনে নেওয়া হবে না।
চুক্তি হওয়ার পরপরই আন্দোলন থেকে সাময়িক ভাবে সরে আসেন গুরুঙ্গ। দার্জিলিঙে পর্যটক উপচে পড়ে। জিটিএ গঠনের পরে বিভিন্ন ক্ষেত্রে উন্নয়নের কাজ শুরু করার তাগিদও তৈরি হয়। যার ভিত্তিতে মমতা বলেন, “পাহাড় হাসছে।”
সমতলের পড়ুয়াদের নিয়ে যেতে বাস পাঠিয়েছে পাহাড়ের আবাসিক স্কুলগুলি।
সোমবার শিলিগুড়িতে বিশ্বরূপ বসাকের তোলা ছবি।
কিন্তু এতেই কি সমস্যা মিটে গিয়েছিল? পাহাড়ের রাজনীতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল লোকজন বলছেন, না। পরের ঘটনাপ্রবাহ দেখলেই সেটা স্পষ্ট হয়ে যাবে। তাঁদের বক্তব্য, চুক্তি রূপায়ণ নিয়ে সমস্ত জটিলতা এখনও কাটেনি। চুক্তিতে বলা হয়েছিল, শিলিগুড়ি ও তরাই-ডুয়ার্সের অতিরিক্ত এলাকা অন্তর্ভুক্তিকরণের যে দাবি, তার জন্য একটি কমিটি গঠন করা হবে। ঠিক ছিল, সেই কমিটির সুপারিশ দু’পক্ষই মেনে নেবে। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা যায়, কমিটির সুপারিশ গুরুঙ্গরা মানেননি। রাজ্য সরকারের অভিযোগ ছিল, চুক্তি ভঙ্গ হয়েছে। আবার এ বারের আন্দোলন শুরু হলে পুরনো মামলায় যে ভাবে মোর্চার নেতা-কর্মীদের ধরপাকড় করা হয়েছে, তাতেও চুক্তি ভঙ্গের অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগ করেছেন গুরুঙ্গরা।
গুরুঙ্গের দলের মধ্যে অন্তর্কলহও তীব্র। মমতার সঙ্গে কথা বলে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বিষয়টির নিষ্পত্তি করতে চেয়েছিলেন হরকাবাহাদুর ছেত্রী। মোর্চা সূত্রের খবর, গুরুঙ্গ কিন্তু মনে করছেন, আন্দোলন মাঝপথে থামিয়ে আলোচনায় গেলে পাহাড়ে তাঁর জনপ্রিয়তা কমবে। কর্তৃত্ব দুর্বল হবে। এর মধ্যেই জিটিএ-র দুর্নীতি নিয়ে অনেকে সরব হয়েছেন। অভিযোগ উঠেছে, পাহাড়ে সে ভাবে উন্নয়নের কাজ হচ্ছে না। এই অবস্থায় তাই ভাবমূর্তি ও কর্তৃত্ব ধরে রাখতে মরিয়া গুরুঙ্গের সামনে আন্দোলন ছাড়া পথও ছিল না।
তাতেও কি গুরুঙ্গের আসন এখন নিষ্কণ্টক? সিকিমের কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য এবং বর্তমানে দিল্লিতে ইন্দিরা গাঁধী জাতীয় মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় ইগনু-র সহ-উপাচার্য দার্জিলিংবাসী মহেন্দ্র লামা এখন দার্জিলিঙে গিয়েই গুরুঙ্গ-বিরোধী প্রচারে নেমে পড়েছেন। এমনকী, তিনি ঘোষণা করেছেন, লোকসভা ভোটে নির্দল প্রার্থী হবেন। মজার ব্যাপার হল, মহেন্দ্র এক সময় গুরুঙ্গের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। পাহাড়ে দল ও সংগঠন, দুই ক্ষেত্রেই মহেন্দ্রর থেকে গুরুঙ্গের নিয়ন্ত্রণ অনেক বেশি। তবু সিঁদুরে মেঘ দেখছেন গুরুঙ্গ। তাঁর ঘনিষ্ঠ মহলের সন্দেহ, মহেন্দ্রকে কেন্দ্র ও রাজ্য দু’পক্ষই ইন্ধন দিতে শুরু করেছে। আতঙ্কিত গুরুঙ্গ-বাহিনী তাই কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুশীলকুমার শিন্দের সঙ্গে দেখা করেন। আসলে গুরুঙ্গ চাপের মুখে পড়ে এখন মীমাংসার রাস্তা খুঁজছেন। কেন্দ্রের কাছে তাঁর দাবি এক, বন্দি মুক্তি। দুই, সিআরপিএফ প্রত্যাহার। তিন, আবার ত্রিপাক্ষিক আলোচনা শুরু করা। তিনি চাইছিলেন, কেন্দ্র যেন সেই পরিস্থিতি তৈরি করতে উদ্যোগী হয়। কিন্তু শিন্দের সঙ্গে রোশন গিরিদের সেই বৈঠকে মমতা প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ। কেন্দ্রকে তিনি জানান, স্নায়ুযুদ্ধে যখন তিনি গুরুঙ্গকে পরাস্ত করছেন, ধর্মঘট উঠিয়ে আলোচনার পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে চাইছেন, তখন এ ভাবে তাদের নতুন করে উস্কে তৃণমূলকে চাপে রাখার কৌশল যেন নেওয়া না হয়। কেন্দ্র বোঝানোর চেষ্টা করে, তারা আসলে মমতাকেই সাহায্য করার চেষ্টা করছে। কিন্তু তৃণমূল সাংসদদের দিয়ে সংসদের ভিতরে-বাইরে চাপ বাড়িয়ে কেন্দ্রকে নিষ্ক্রিয় করে দিয়েছেন মমতা।
তবে তাঁর মোক্ষম চাল অবশ্যই গুরুঙ্গের ইস্তফা গ্রহণ। এবং সাফ জানিয়ে দেওয়া, গুরুঙ্গ যদি মীমাংসার পথে না আসেন, তা হলে প্রশাসন বসিয়ে রাজ্য সরকার জিটিএ-র নির্বাচন করাতে পারে। আবার এই কড়া মনোভাবের মধ্যেই ঘটনাচক্রে জেলাশাসক সৌমিত্র মোহনকে বদলি করান মমতা। তাতে স্বস্তি আসে গুরুঙ্গ-শিবিরে। দ্বিতীয়ত, উন্নয়নের কাজ চালিয়ে যেতে জিটিএ-র জন্য আর্থিক সাহায্য বন্ধ করা হবে না বলেও জানিয়েছে রাজ্য। এর পাশাপাশি, গুরুঙ্গ-বাহিনীর সঙ্গে মমতা একটা ‘ট্র্যাক-টু’ আলোচনার রাস্তা খোলা রেখেছেন। কেন্দ্র মনে করছে, মমতার এই নরমগরম নীতিই দার্জিলিং সমস্যার সমাধানে পথ দেখাবে।





First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.