কেন তাঁর কাছে এই যুক্তরাষ্ট্র ওপেন খেতাবটা স্পেশ্যাল? কেমন মনোভাব নিয়ে নিজের বয়সের দিকে তাকান
তিনি?
ডাবলস পার্টনার স্টেপানেক কী ভাবে ফ্লাশিং মেডোয় তাঁর কাছে ‘ডক্টর স্টেপানেক’ হয়ে উঠেছিলেন?
চল্লিশেও কী
করে নিজের খেলার উন্নতি ঘটাচ্ছেন? সব কিছু নিয়ে চোদ্দো নম্বর গ্র্যান্ড স্ল্যাম জেতার
পরে ইউএস ওপেন ওয়েবসাইটে দেওয়া সাক্ষাৎকারে অকপট লিয়েন্ডার পেজ। |
প্রশ্ন: চ্যাম্পিয়নশিপ ট্রফি হাতে তোলার মুহূর্তে আপনার কাছে এই খেতাবের কী অর্থ মনে হচ্ছিল?
লিয়েন্ডার: সত্যিই, ভীষণ স্পেশ্যাল এই খেতাব। আমরা গত বছর অস্ট্রেলিয়ান ওপেন জিতেছিলাম। সেটা ডাবলসে আমার কেরিয়ার গ্র্যান্ড স্ল্যাম ছিল। রাদেক আমাকে সেটা দেওয়ার জন্য প্রচুর পরিশ্রম করেছিল। কিন্তু এ বারের ইউএস ওপেন খেতাবের অর্থ আমার কাছে আরও বেশি। কারণ, আমাদের দু’জনকেই এ বছরে পেশাদার ট্যুরে নানান সমস্যা সামলাতে হয়েছে। আমি সব সময় বলে এসেছি, টেনিস আমার কাছে এমন একটা আশীর্বাদ-স্বরূপ পেশা যার মাধ্যমে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। ভ্রাতৃত্ববোধ তৈরি হয়। রাদেকের বছরটা শারীরিক ভাবে যে রকম ভয়ঙ্কর সমস্যার মধ্যে গিয়েছে, তার পর ওর সঙ্গে এই গ্র্যান্ড স্ল্যাম জিততে পারাটা কোনও দিন ভুলব না। আমার সেরা গ্র্যান্ড স্ল্যাম খেতাবগুলোর মধ্যে এটা চিরকাল থাকবে। ডাবলস-মিক্সড ডাবলস মিলিয়ে আমার তিরিশটা গ্র্যান্ড স্ল্যাম ফাইনাল খেলা হয়ে গেল। কিন্তু আমার পাশে পঁয়ত্রিশ বছরের যে তরুণ বসে আছে, সে-ই সম্ভবত আমার সেরা পার্টনার।
কিছুক্ষণ আগেই আমরা একটা গ্র্যান্ড স্ল্যাম জিতেছি। কিন্তু তার পরেও সটান কোর্ট থেকে জিমে গিয়েছিলাম। আমাদের রোজকার রুটিন ট্রেনিং করেছি। ওয়ার্কলোড নিয়েছি। আসলে এই প্র্যাক্টিসগুলোই আমাদের সবচেয়ে বয়স্ক গ্র্যান্ড স্ল্যাম জয়ী করে তুলেছে। বয়সের তুলনায় তরুণ করে রেখেছে। মানসিক ভাবে খুশি রেখেছে। প্রতিদিন আরও ভাল খেলার ক্ষমতা জোগাচ্ছে।
প্র: আপনার বয়স চল্লিশ। ডাবলস টিমের গড় বয়স সাড়ে সাঁইত্রিশের বেশি। কোর্টে অনেকের চেয়ে কম গতি নিয়েও এই জুটির সাফল্যের রহস্য কী?
লিয়েন্ডার: ট্রফি নিয়ে লকাররুমে ফিরেই আমি আর রাদেক দু’জনেই বাবার সঙ্গে কথা বললাম। আমার বাবা পদকজয়ী হকি অলিম্পিয়ান। তিনি ফোনে প্রথমেই আমাকে বললেন, আমাদের দু’জনকে নাকি আগের চেয়ে ভাল কন্ডিশনে, ভাল ফর্মে, আরও কমবয়সি দেখিয়েছে ফাইনালের লাইভ টেলিকাস্টিংয়ে। আমার বাবা মোটেই পুরনো সাফল্য নিয়ে পড়ে থাকার মানুষ নন। সব সময় আমাকে আরও ভাল করার জন্য ঠ্যালা মারেন। আমাকে গত দু’বছর ধরে বলে চলেছেন, বেসলাইনে রাদেকের ফুটওয়ার্কটা শেখো। ওকে তোমার নেটের সামনে হাত আর চোখের কো-অর্ডিনেশনটা শেখাও। তাতে তোমাদের জুটির লাভ।
আমার কোচ রিক লিচ আর একজন। গ্রেট কোচ। দারুণ মানুষ। আমরা সারা বছর ট্যুরে নানা সুন্দর মুহূর্ত কাটাই। যেগুলো আমাকে ভীষণ ভাবে উদ্দীপিত করে প্রতিদিন আগের চেয়ে ভাল খেলার চেষ্টা করতে। নিজেকে আরও উন্নত করে তুলতে। সে জন্য এই ট্রফিটা ওঁদের দু’জনকে উৎসর্গ করেছি। |
কীর্তি গড়ার পরের দিন। নিউইয়র্কে ফটোশু্যটে ডাবলস
পার্টনার স্টেপানেক আর ট্রফি নিয়ে লিয়েন্ডার। ছবি: এএফপি। |
প্র: কিন্তু বয়সের বাধাকে কাটানোর পিছনে তো নিশ্চয়ই বিজ্ঞানও আছে?
লিয়েন্ডার: পুরোটাই মানসিক। বিজ্ঞান বলতে নিয়মিত জিম, যোগাভ্যাস আর প্রতিদিন নিয়মনিষ্ঠ জীবনযাপন করা। সেটা আমি ধর্মপালনের মতোই প্রত্যেক দিন পালন করি। সে কারণে বয়স আমার কাছে একটা সংখ্যা মাত্র। যার দিকে আমি তাকাই আর মনে মনে হাসি। কারণ জানি, বয়স নিয়ে লোকে আমাকে ঠাট্টা করে। যেটা আমি অবশ্য উপভোগ করি। বরং রাদেককে ধন্যবাদ, টেনিসের ওপেন যুগে আমাকে সবচেয়ে বয়স্ক পুরুষ প্লেয়ার হিসেবে গ্র্যান্ড স্ল্যাম চ্যাম্পিয়ন হতে সাহায্য করার জন্য। তবে তাতেই আমি থামছি না। একচল্লিশ... বিয়াল্লিশ... তেতাল্লিশেও খেলব।
প্র: ফ্লাশিং মেডোয় এ বারের স্মরণীয় অভিযানের কোনও বিশেষ মুহূর্ত?
লিয়েন্ডার: দ্বিতীয় রাউন্ডের ম্যাচের সময় ঝড়ের মতো হাওয়া বইছিল কোর্টে। একটা ব্যাকহ্যান্ড শট নেওয়ার সময় বল শেষ মুহূর্তে হাওয়ায় এমন বাঁক খেল যে, মিসহিট হয়ে নিজের নাকই প্রায় ভাঙতে বসেছিলাম। কোর্টের ভেতরই পাঁচ মিনিট রাদেক আমার শুশ্রূষা করে। যতবার ও ডাক্তার ডাকার কথা আমাকে বলছিল, আমি ওকে বলেছি না, ডক্টর স্টেপানেক। আমি তোমার চিকিৎসাতেই ফিট হয়ে উঠব। আর সেটাই হয়েছিল।
আমাদের সেমিফাইনালে অবশ্য কোর্টে ডাক্তার ডাকতে হয়েছিল। তবে সেটা একজন মেয়ে নিরাপত্তারক্ষীর জন্য। একবার এক মিনিটের সার্ভিস ব্রেকের সময় মেয়েটা আমার সামনেই কোর্টে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল! আমার কোচ তো চেঁচিয়ে অস্থির! আমি পরের সার্ভিস গেমের স্ট্র্যাটেজি ভাবাটাবা ফেলে জলের বোতল নিয়ে মেয়েটার কাছে দৌড়লাম। বেশ কিছুক্ষণ লেগেছিল মেয়েটাকে উঠে দাঁড় করাতে। তবে আমার নাকের মতোই মেয়েটার জ্ঞানেরও শেষমেশ ক্ষতি হয়নি।
প্র: আপনার জীবন দর্শনই কি নিজের সাফল্য সম্পর্কে এতটা আত্মবিশ্বাসী করে তুলেছে আপনাকে?
লিয়েন্ডার: আমি কলকাতার খুব বিনম্র আর আদর্শবাদী পরিবার থেকে এসেছি। মনে পড়ছে, এ বছর রোমে আমি আর রাদেক একটা লম্বা মিটিং করেছিলাম। যেটা সাধারণত মরসুম শেষে হয়ে থাকে। কিন্তু মাঝপথে হওয়ার কারণ, তার আগে আমাদের এ মরসুমে সাফল্য ছিল না। সে দিনই আমরা ঠিক করেছিলাম, মার্কিন হার্ডকোর্ট মরসুমে পিক-এ পৌঁছনোর চেষ্টা করব আর ইউএস ওপেন জেতার জন্য প্রাণপণ দেব। তার পর ইস্টবোর্নে সে দিনটা আমার জন্মদিন ছিল। রাদেক ছাড়া হোটেলে আমার সঙ্গে কেউ ছিল না। আমার মেয়েও না। বৃষ্টিভেজা দিনটায় ভীষণ মন খারাপ লাগছিল। কিন্তু রাদেক আমার ঘুম ভাঙিয়ে আমাকে বিচে নিয়ে গিয়ে চাঙ্গা করে তুলেছিল। একেই বলে আদর্শ ডাবলস পার্টনার। আমার বয়স যতই হোক না কেন, এ রকম সঙ্গী পেলে কোর্টে ম্যাজিকও থাকবে! |
সেরা পাঁচ |
১. ডাবলসে কেরিয়ার গ্র্যান্ড স্ল্যাম: ২০১২-এ রাদেক স্টেপানেককে নিয়ে অস্ট্রেলীয় ওপেন জিতে ডাবলসে কেরিয়ার গ্র্যান্ড স্ল্যাম পূর্ণ করা।
২. অলিম্পিক ব্রোঞ্জ পদক: ’৯৬-এ আটলান্টায় ওয়াইল্ড কার্ড নিয়ে নেমে সিঙ্গলস সেমিফাইনালে আগাসির কাছে হার। পরে ব্রোঞ্জ পদকের ম্যাচে মেলিজিনিকে হারান। তার পরেই আত্মজীবনীতে আগাসি লেখেন, ‘কোর্টে লিয়েন্ডার যেন উড়ন্ত ফড়িং!
৩. পরপর ফরাসি ওপেন ও উইম্বলডন ডাবলস খেতাব: ’৯৯-এ লি-হেশের ‘ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসে’র পাঁচ সপ্তাহের মধ্যে ফরাসি ওপেন আর উইম্বলডন ডাবলস চ্যাম্পিয়ন হয়ে বিশ্বের এক নম্বর জুটি হয়ে ওঠা।
৪. সাম্প্রাসকে হারানো: ’৯৮-এ পাইলট পেন টুর্নামেন্টে সেই সময়ে বিশ্বের এক নম্বর পিট সাম্প্রাসকে স্ট্রেট সেটে হারান। লিয়েন্ডারের মতে তাঁর জীবনের সেরা জয়।
৫. একই বছরে জুনিয়র উইম্বলডন ও যুক্তরাষ্ট্র ওপেন জয়: ’৯০-এ পরপর জুনিয়র উইম্বলডন আর ইউএসওপেন সিঙ্গলস চ্যাম্পিয়ন হয়ে টেনিস দুনিয়ার চোখে প্রথম পড়া। |
|