একটা চ্যানেলে লিয়েন্ডার পেজ সাংঘাতিক লড়াই করছেন ফ্লাশিং মেডোতে। আর একটা চ্যানেলে ওই রাত্তির দশটা
নাগাদই বাংলা গানের জগতের সাত তারা নিয়ে চলছে দাদাগিরি-র জমজমাট শো। তিনি সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়
কোনটা দেখছিলেন? চ্যানেল সার্ফ করে-করে? একবার এটা, একবার ওটা? উত্তর কোনওটাই নয়। খুব
সকালে ইডেনে ছুটতে যাবেন বলে আগে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। সকালে খবরের কাগজ আসা থেকে অবশ্য
আর সবার মতোই তিনি লিয়েন্ডার নামক মুগ্ধতায় আক্রান্ত। শেয়ার করলেন আনন্দবাজারের সঙ্গে। |
... হ্যাটস অফ। আর বিশেষ কিছু বলার নেই। প্রয়োজনও আছে কি? চল্লিশ বছর বয়সে আবার চ্যাম্পিয়ন হয়ে ও আবার সবার চোখের সামনে প্রমাণ করে দিল বয়সটা কোনও ব্যাপার নয়। তোমার মনোভাবটাই আসল! তোমার খেলাটাই আসল! লিয়েন্ডার আর আমি অনেক ছোটবেলায় পিকেদা’র কাছে একসঙ্গে ট্রেনিং করেছিলাম। তখন থেকে আমাদের বন্ধুত্ব। তখন দু’জনেই বেশ রোগাসোগা। ওই তেরো-চোদ্দো বছর বয়সে মনে হয় না আমরা ভীষণ রকম উচ্চাকাঙ্খী হয়ে উঠেছিলাম বলে। আমি অন্তত ভাবিনি তখন ইন্ডিয়ার হয়ে খেলব। লিয়েন্ডার উইম্বলডন জেতার কথা ভেবেছিল কি না আজ মনে নেই। কিন্তু ওকে প্রথম দিন দেখা থেকে একটা জিনিস আমাকে বরাবর আকৃষ্ট করেছে। সেটা ওর অ্যাটিটিউড। সব সময় ও ভীষণ জেগে রয়েছে! সব সময় রেডি! আমি লিয়েন্ডারের সঙ্গে এত সময় কাটিয়েছি। কখনও দেখিনি ওকে হাই তুলতে। ঘুমোতে যাওয়ার কথা তো ছেড়েই দিলাম। কী হতে পারে না সেটা নিয়ে কখনও ভাবে না। বরং ওর অ্যাটিটিউড যেন সব সময় পুশ করে যে, না হওয়ার কোনও কারণ নেই। ভেস আঙ্কলকেও আমি কনগ্র্যাচুলেট করতে চাই। উনি একজন দুর্ধর্ষ মানুষ। আমি আর লিয়েন্ডার দু’জনেই যে লম্বা কেরিয়ার করতে পেরেছি তার পিছনে একটা বড় কারণ আমাদের পরিবার। আমাদের বাবারা। ভেস আঙ্কল প্রচুর খেটেছেন লিয়েন্ডারের পিছনে। লি-র এমনিতেও প্রচুর স্কিল ছিল। আর তার সঙ্গে বাবার ট্রেনিং আর নিজস্ব অ্যাটিটিউড। এর ফলটাই আমরা আজও দেখছি। সকালে এক বন্ধু জিজ্ঞেস করছিল, দক্ষিণ আফ্রিকায় যদি সত্যিই সচিন যায়, লিয়েন্ডারের ইউএস ওপেন জয় থেকে ও বাড়তি প্রেরণা পেতে পারে কি না? আমি বলব হ্যাঁ এবং না দুটোই। লিয়েন্ডারের চল্লিশে সাফল্য যে কোনও পেশারই সমবয়সিদের হয়তো উদ্দীপ্ত করবে। বিশেষ করে স্কিল আর ফিটনেস-ভিত্তিক পারফরম্যান্স নিয়ে যাদের কারবার। |
কিন্তু ক্রিকেট আর টেনিস দুটো এত ভিন্ন দু’রকমের স্পোর্ট যে, উদ্দীপ্ত হয়েও তা থেকে লাভ পাওয়া যাবে কি না আমার সন্দেহ আছে। টেনিস অবশ্যই বিশ্ব পর্যায়ের অসম্ভব রুক্ষ স্পোর্ট। যা দেড়শোর ওপর দেশ খেলে। ফিটনেসে সামান্য চুলচেরা তফাত সেখানে ফেডেরারকেও ফার্স্ট রাউন্ডে হারিয়ে দিতে পারে। কিন্তু ক্রিকেট যে এক বলের খেলা। সেখানে ডেল স্টেইন ছুটে আসে ঘণ্টায় নব্বই মাইল স্পিডে। একটা ভুল করেছ কী শেষ। দ্বিতীয় কোনও সুযোগ নেই। আরও একটা বড় তফাত, ওটা টিম স্পোর্ট। নির্বাচিত হতে হয় অন্য লোকের অনুমানের ভিত্তিতে। এই যে লিয়েন্ডার অসাধারণ একটা কীর্তি গড়ল। ইউএস ওপেন ডাবলস ব্যাপারটা ইন্ডিয়ান ক্রিকেট টিমের মতো টিম স্পোর্ট হলে লোকে আগেই কত সব গল্প বলত। বলত বুড়ো হয়ে গেছে। ওকে নিয়ে কী হবে? নেগেটিভ স্টোরি শুরু হয়ে যেত। নির্বাচকরা চাইছেন না। বোর্ড চাইছে না। তবু খেলতে চায় কেন? লিয়েন্ডারদের খেলায় একটা বড় তফাত, ওরা নিজেরাই হতে পারে নিজেদের নির্বাচক। ও চল্লিশে খেলা ছাড়বে, না তেতাল্লিশেও খেলবে সেটা ঠিক করার স্বাধীন ক্ষমতা ওর আছে। অথচ টিম স্পোর্টে লি-র মতোই একটা জমাটি ছেলে যখন ঢুকতে গেছে এই মাত্র ক’মাস আগেও, ওকে নিয়ে কত কাহিনি লেখা হয়েছে। আবার একই ছেলে যখন ডেভিস কাপ বা অলিম্পিকের মতো টিম টুর্নামেন্ট থেকে বেরিয়ে ব্যক্তিগত স্পোর্টে চলে এল, সব কথাবার্তা বন্ধ। ও-ও সুযোগ পেল খোলা মনে নিজেকে উজাড় করে দেওয়ার। প্লিজ, ভাববেন না ওর কালকের রাত্তিরের কৃতিত্বকে আমি কোথাও ছোট করছি। সকাল থেকেই লিয়েন্ডারের পারফরম্যান্স ভেবে আমি অভিভূত। মনে করার চেষ্টা করছিলাম লিয়েন্ডারের মধ্যে একটা বিশেষ গুণ ছোটবেলাতেও ছিল কি না? সেটা হল, কম্পিটিশন দেখলেই প্রচণ্ড চার্জড হয়ে ওঠা। এটা ওর বিশাল অ্যাসেট। আমি যখন ইন্ডিয়ান টিমের ক্যাপ্টেন ছিলাম, লিয়েন্ডার বেশ কয়েক বার বিদেশে খেলা দেখতে বা আড্ডা মারতে এসেছে। দু’হাজার তিনে আমার যখন অপারেশন হল, বেলভিউতে প্রায় প্রতিদিন রাত্তিরে লিয়েন্ডার আমাকে দেখতে আসত। সেটা আবার আসত রাত্তির বারোটা নাগাদ। আমি বহু বার বলেছি, বাবা একটু তাড়াতাড়ি আয় না। কিন্তু লিয়েন্ডার হল লিয়েন্ডার। অফুরন্ত এনার্জি। রাত আর দিন কোনও তফাত নেই। ও মুম্বইয়ে থাকতে শুরু করার পর দেখাসাক্ষাৎ অনেক কমে গেছে। প্রায়ই মনে হয়, লিয়েন্ডার কেন একটু বেশি সময় কলকাতায় থাকে না? ও যদি লোকাল প্লেয়ারদের পাশে দাঁড়িয়ে থেকে নিজের অভিজ্ঞতা শেয়ার করে, সেটাও তো কী ভীষণ ইন্সপায়ারিং হবে। শুধু টেনিস কেন, ক্রিকেটেও লিয়েন্ডারকে কাজে লাগানো উচিত। মোটিভেশন বক্তৃতা তো দেওয়ানোই যায়, আমি ভাবছি আরও বড় কিছু। সিএবি যদি লিয়েন্ডারকে রাজি করাতে পারে বেঙ্গল টিমকে অন্তত দু’দিন ফিটনেস ট্রেনিং দেখিয়ে দিতে, সেটা আমার মনে হয় দারুণ উপকারী হবে। জানি না, লিয়েন্ডার সময় বার করতে পারবে কি না। কিন্তু যদি করা যায় দারুণ এক্সসাইটিং হয়। আপাতত আমি কনগ্র্যাচুলেট করার জন্য লিয়েন্ডারের আমেরিকার নম্বর জোগাড় করার চেষ্টা করছি। না পেলে অগত্যা মুম্বইয়ের নম্বরটাতেই এসএমএস ছাড়ব...
|