পৃথিবী জুড়ে সাইকেলকে সসম্মান ফিরিয়ে আনা হচ্ছে, কলকাতা চলছে উলটো পথে। এটা কি আমাদের
শ্রেণিবোধের খেলা? আমরা হয়তো ভাবি, যিনি সাইকেল চালান তিনি কিছুতেই খুব ভদ্রস্থ হতে পারেন না।
সংগ্রাম মুখোপাধ্যায় |
বাসের দেখা নেই, সরকারি বাস বিরলতর, প্রাইভেট মালিকরাও ব্যবসা বিরতির পথে। ট্যাক্সিতে চাপবেন? যদি বা বরাতজোরে আপনার এবং ট্যাক্সির গন্তব্য এক হয়, তা হলেও প্রথমেই রফা করে নিতে হবে মিটারের ওপর কত দিতে হবে। অটোয় চাপতে হলে চাই অসীম ধৈর্য। যদি বা পেলেন, তার গতি আর আপনার হৃদয়ের গতি সমান তালে বাড়তে থাকবে, মনে হবে বাড়ি পৌঁছনো যাবে তো? কিছু ভাগ্যবান আছেন যাঁরা এখনও ট্রামের রাজকীয় যাত্রা করে বাড়ি ফিরতে পারেন। তবে তারও মতির ঠিক নেই, ঘন ঘন রাস্তা ভুল করে পথে নামে। অন্তত যাত্রী-সংখ্যা দেখে মনে হয় না জনগণ খুব ভরসা করেন তার ওপর। মেট্রোর কথা না হয় না-ই বা বললাম।
রাজকীয় সওয়ারির আর এক উপায় হল একটা গাড়ি কিনে ফেলুন, ধার করেই কিনুন। জানলার কাচ তুলে দিন, এসি চালিয়ে দিন, ইচ্ছে করলে গান শুনুন, তারস্বরে, সিগনাল লাল থাকলেও মাঝেমাঝে হর্ন বাজান, আপনি তো শুনতে পাচ্ছেন না। গ্যারেজ নেই? নো প্রবলেম, বাড়ির সামনের ফুটপাতে তুলে দিন। কলকাতার ফুটপাত বহুদিন পথচারীর অধিকারের বাইরে, রাস্তাতে রাখলেই বা কে বারণ করবে? কেউ বারণ করলে কী করতে হয় আপনার জানা। ব্যস্ত অফিস পাড়ায় গাড়ি রাখার একটা ব্যবস্থা হবেই। রাস্তা বলে আর কিছু দেখা যায় না, গাড়িময় কলকাতা।
কিন্তু জায়গা নেই সবচেয়ে সহজ, কম খরচের বাহন সাইকেলের, কেননা সেটা গরিবের বাহন। ডাক্তারের কথা শুনে বা প্রকৃতির প্রতি সুবিচার করার উদ্দেশ্যে অথবা কলেজ জীবনের নস্টালজিয়ার আতিশয্যে, নিজের বিবেকের দংশনে হঠাৎ সাইকেল চাপার হঠকারী সিদ্ধান্তে উপনীত হবেন না। কারণ আমাদের অতি আপন কলকাতা শহর সম্প্রতি সাইকেল চালানোকে অপরাধ ঘোষণা করেছে। দুশো বছরের পুরনো এই বাহন তিনশো বছরের পুরনো শহরে অবাঞ্ছিত হয়ে পড়েছে। সাইকেলের দোষ? বড়ই শ্লথ তার গতি। |
না-দূষণের অধিকার। নিষেধাজ্ঞার জবাবে।
কলকাতা, রবিবার, ৮ সেপ্টেম্বর। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক। |
কলকাতার সাধারণ যান চলাচলের গতির চেয়েও কম? না, এ সব যুক্তি-তর্কের ধার ধারে না কলকাতা পুলিশ, ধরা পড়লেই ১০০ টাকার জরিমানা। তা হলে কি কোনও উপায় নেই আপনার অতি প্রয়োজনীয় এই বাহনটি ব্যবহার করার? আছে, তবে তার আগে আপনাকে জানতে হবে আমাদের শহরে সাইকেল চালানোর যোগ আছে একটি বিশেষ আর্থ-সামাজিক শ্রেণির, যাঁদের সঙ্গে কথা বলার সময় আমাদের বীর পুলিশ বাহিনী আকছার তুইতোকারি করেন। তাই রাজপ্রহরীদের ‘সম্মান’ জানিয়ে সাইকেল থেকে নেমে আপনাকে পার হতে হবে রাস্তাগুলো। সে সব রাস্তায় সাইকেল চালানো বারণ। তাই এমন ভাব করতে হবে, আপনি জানেন আপনি অন্যায় করছেন কিন্তু নিতান্তই নিরুপায়। সে সময় আপনার সামনেই নিয়মরক্ষকরা বেআইনি ভাবে ঢুকে পড়া ট্রাক ড্রাইভারের দিকে হাত বাড়িয়ে দেবেন লজ্জা, ঘেন্না, ভয়, তিন থাকতে নয়। নিয়মরক্ষকদের সর্দাররা অবলীলায় সিগনালের তোয়াক্কা না করে, তাদের চকচকে লাল মোটর সাইকেল হাঁকিয়ে চলে যাবেন রাস্তার ডান ধার ধরে, উলটো পথে, আপনার সামনেই। উলটো পথে চলার অধিকার শুধু নিয়মরক্ষক ও তার সৃষ্টিকর্তাদেরই আছে।
সারা পৃথিবী জুড়ে যখন সাধারণ মানুষ এবং সরকারি ব্যবস্থা সাইকেলের পুনঃপ্রচলনকে গুরুত্ব দিচ্ছেন, কলকাতা শহর এবং তার নিয়ম রচয়িতারা চলছেন ঠিক উলটো পথে। কলকাতাকে লন্ডন বানাবার উদ্যোগে হয়তো লন্ডনের ঐতিহাসিক নির্মাণটাই শাসকদের মাথায় আছে উপনিবেশগুলোকে শোষণ করে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের রাজধানীটাকে গড়ে তোলা। হয়তো বা কলকাতার নবনির্মাণের প্রয়াসে রাজ্যের ঘর্মজীবী প্রজাকুলের উপর শোষণের মাত্রা বৃদ্ধি একটি আবশ্যিক শর্ত। তা না হলে, নতুন লন্ডনের, বিশ্বপৃথিবীরও, উলটো পথে গিয়ে গাড়িমালিকদের প্রতি এত সহানুভূতি কেন? কেন এত অত্যাচার সাইকেলজীবী ছোট ব্যবসায়ী, ক্ষুদ্র কর্মচারী, শ্রমিক বা ছাত্রদের উপর?
লন্ডনে গত এক দশকে সাইকেলারোহীর সংখ্যা বেড়ে হয়েছে তিন গুণ। তাই ২০১৩ সালে গ্রেটার লন্ডন অথরিটি শুধু লন্ডন শহরকে সাইকেল চালানোর যোগ্য করে তোলার জন্য আগামী তিন বছরে ৪০ কোটি পাউন্ড খরচ করার পরিকল্পনা করছে, যা আগের খরচের আড়াই গুণ বেশি। শুধু লন্ডন নয়, ইউরোপের অনেক শহরেই সাইকেলই হল সবার প্রিয় বাহন। নেদারল্যান্ডস-এর শহরগুলিতে ২৭ শতাংশ যাত্রা হয় সাইকেলে। সেখানকার সাইকেল-রাস্তা শহর ছাড়িয়ে গ্রাম, গ্রাম ছাড়িয়ে চলে যায় প্রতিবেশী দেশে। সেখানে গাড়ি থাকলেও সবার কাছেই আছে একটি সাইকেল, এবং সেটি চালাবার স্বাধীনতা ও উপযুক্ত ব্যবস্থা।
কলকাতায় সাইকেল চালানোর সঙ্গে যুক্ত এক রকম তাচ্ছিল্য ভাব। যিনি সাইকেল চালান তিনি কিছুতেই খুব ভদ্রস্থ মানুষ হতে পারেন না, এমনটাই আমাদের বিশ্বাস। সরকারি আমলাদের প্রশিক্ষণ দিতে গিয়ে বেশ বেকায়দায় পড়েছিলেন আমাদের পরিচিত এক বিদ্যাজীবী। দারোয়ান তাঁকে ঢুকতে দেননি, কারণ তিনি সাইকেল চেপে এসেছিলেন। দারোয়ান ভাবতে পারেননি, এক জন সাইকেল আরোহী তাঁর লালবাতি চেপে আসা মনিবদের কিছু শেখাতে পারেন। বিশ্বের নানা প্রসিদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র এবং অধ্যাপকদের সাইকেলে চাপার যে রেওয়াজ, তা আমাদের শ্রেণিবোধে আচ্ছন্ন সমাজে প্রায় নেই বললেই চলে। শুনেছি, সামাজিক চয়ন তত্ত্বের পথপ্রবর্তক কেনেথ অ্যারো এক বার সাইকেল চালিয়ে দেখা করতে আসছিলেন তাঁর ছাত্র ও পরে সহকর্মী অমর্ত্য সেনের সঙ্গে। হাওয়া উল্টো দিকে থাকায় তাঁর পৌঁছতে কয়েক মিনিট দেরি হয়ে গিয়েছিল। দেরির জন্য মার্জনা চেয়েছিলেন। অমর্ত্য সেনের নিজের সাইকেল-নির্ভরতাও অজানা নয়। কিন্তু শাসকবর্গীয় বাঙালি তাঁর ছোঁয়া পাওয়ার জন্য, তাঁর হাত দিয়ে সন্তানের হাতে খড়ির জন্য যতটা উদ্গ্রীব, তার বিন্দুমাত্রও তাঁর জীবনচর্যা থেকে শিখতে আগ্রহী নয়।
তাই বলছিলাম, কলকাতায় সাইকেল কি শুধুই বাচ্চাদের খেলনা আর গরিব মানুষের বাহন হিসেবেই গণ্য হবে? না কি প্রকৃত শিক্ষিত, পরিবেশ ও স্বাস্থ্য সচেতন মানুষ একে আদর্শ বাহন হিসেবেই গ্রহণ করবে? বিত্তবানদের আপাত-স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য সাইকেলারোহীদের উপর যে অনাচার, তার ফল তো সমগ্র সমাজকেই ভোগ করতে হবে। পরিবেশের ভয়াবহ ক্ষয়ের যে আশঙ্কা থেকে বিশ্বসভ্যতা আজ একই সঙ্গে দূষণমুক্ত এবং দৈহিক সুস্থতাদায়ী সাইকেলের উপর জোর দিচ্ছে, সে শঙ্কা তো কলকাতা শহরে প্রতি মুহূর্তের বাস্তব। গতির কথা যদি বলেন, গাড়ির চাপে ট্র্যাফিক জ্যামে যে সময়টা অপচয় হয়, সেটা হিসেব করলে সাইকেল অনেক বেগবান। বহু লোকের উপকারে লাগে, এমন একটা গণতান্ত্রিক বোধের কথা যদি কেউ ছেড়েও দেয়, প্রতি ব্যক্তির ‘আত্মমর্যাদা’ চরিতার্থ করতেও তার জুড়ি নেই।
কড়াকড়িটা সাইকেল নয়, গাড়ির উপর জারি হওয়াটাই সভ্যতার দাবি। আর, সভ্যতা না হয় শিকেয় তোলাই থাকুক, মহার্ঘ পেট্রল-ডিজেল এবং ততোধিক মহার্ঘ ডলারের ঘাটতি কমানোর জন্য অন্তত একটু সাইকেল চড়লে মন্দ হয় না। আর, শরীরচর্চার পক্ষেও কিন্তু সাইকেলের তুল্য বাহন নেই। স্বাস্থ্যসচেতন মহা-নাগরিকরা জিমে গিয়ে না চড়ে ও জিনিস রাস্তাঘাটে চড়ে দেখতে পারেন, একই ফল পাবেন।
|
প্রতীচী ইনস্টিটিউটে কর্মরত।
মতামত নিজস্ব। |