মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং সসম্মান বিতর্ক একটি কার্যকর গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। অর্থনীতি ও দর্শনের বিশিষ্ট তাত্ত্বিক অমর্ত্য সেনকে ব্যক্তিগত আক্রমণ করে অর্থনীতিবিদ জগদীশ ভগবতীর যে সব মন্তব্য সাম্প্রতিক কালে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে, সেগুলি এই পরিপ্রেক্ষিতেই উদ্বেগজনক। চিন্তা ও বুদ্ধিচর্চার জগতে আলোচনার মান কোথায় পৌঁছচ্ছে? তদুপরি, ভগবতীর আক্রমণ কেবল আপত্তিকর নয়, তথ্যের দিক থেকেও ভ্রান্ত।
ভগবতীর অভিযোগ অমর্ত্য সেন নিজেকে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য পদে নিয়োগ করেছেন। আমরা এই অভিযোগ শুনে স্তম্ভিত। এটি সর্বৈব মিথ্যা। নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় একটি যৌথ উদ্যোগ। এশিয়ার কয়েকটি দেশের সরকার সমবেত ভাবে এই প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তুলছেন। ভারতের ভূতপূর্ব রাষ্ট্রপতি প্রতিভা পাটিল এই বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য হিসাবে অমর্ত্য সেনকে উপাচার্যের দায়িত্ব গ্রহণের জন্য অনুরোধ করেন। নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ভারতের তথা গোটা পৃথিবীর এক অমূল্য সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। সেই ঐতিহ্যের প্রতি অমর্ত্য সেন বিশেষ শ্রদ্ধা পোষণ করেন। সেই কারণেই তিনি এই দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন।
এই পদের জন্য তিনি কোনও বেতন নেন না।
ভগবতী বলেছেন, তিনি ভারতীয় জনতা পার্টির কাছে কখনও এক টাকাও চাননি, পানওনি, আর অমর্ত্য সেন ওই দলের নেতৃত্বে চালিত সরকারের অর্থমন্ত্রী যশবন্ত সিন্হার কাছে তাঁর নতুন এন জি ও’র জন্য দশ লক্ষ ডলার অনুদান চেয়েছিলেন ও পেয়েছিলেন। এই কথাটিও সম্পূর্ণ বিভ্রান্তিকর। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য বিষয়ে গবেষণার জন্য অমর্ত্য সেন যখন তাঁর নোবেল পুরস্কারের অর্থ দিয়ে প্রতীচী ট্রাস্ট তৈরি করেন (বাংলাদেশেও তিনি অনুরূপ একটি ট্রাস্ট তৈরি করেন), তখন কেন্দ্রীয় সরকার স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে এই ট্রাস্টের জন্য অনুদান দেন, অধ্যাপক সেন দশ লক্ষ ডলার চানওনি, পানওনি। নিজের দেশের (অমর্ত্য সেন এক জন ভারতীয় নাগরিক) সরকারের কাছ থেকে একটি জনকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠানের জন্য অনুদান গ্রহণ করা আর একটি রাজনৈতিক দলের কাছে টাকা চাওয়া এক নয় নিশ্চয়ই। শিশুদের স্বাস্থ্য ও শিক্ষার প্রসারে তাঁর দায়বদ্ধতা অবিচল। জঁ দ্রেজ-এর সঙ্গে যৌথ ভাবে লেখা তাঁর যে নতুন বইটি ভগবতীর আক্রমণের নিশানা হয়েছে, সেই আনসার্ট্ন গ্লোরি: ইন্ডিয়া অ্যান্ড ইটস কন্ট্রাডিকশনস বিক্রয় থেকে প্রাপ্ত রয়ালটি পুরোটাই ওই একই ট্রাস্টের জন্য বরাদ্দ হয়েছে।
জগদীশ ভগবতী বলেছেন, অমর্ত্য সেন গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে ‘অনর্থক’ আক্রমণ করেছেন। এটাও ঠিক নয়। একটি টেলিভিশন চ্যানেলের সাক্ষাৎকারে নির্দিষ্ট প্রশ্নের উত্তরে তিনি মোদী সম্পর্কে মন্তব্য করেন। একটি গণতান্ত্রিক দেশে নিজের মত প্রকাশের অধিকার নিশ্চয়ই তাঁর আছে, অধিকার আছে সংবাদমাধ্যমে প্রশ্নের উত্তরে নিজের বক্তব্য স্পষ্ট ভাবে জানানোর।
‘খাদ্য, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য’ যাঁদের কাছে পৌঁছয় না, তাঁদের সেগুলি সরবরাহ করার জন্য বেসরকারি উদ্যোগের প্রচেষ্টাকে অমর্ত্য সেন কখনও নাকচ করেননি। তিনি কখনও বলেননি যে, এই মৌল পরিষেবাগুলি একমাত্র সরকারই সরবরাহ করবে, এতে অন্য কারও কোনও ভূমিকা থাকবে না। অথচ ভগবতীর বক্তব্য, তিনি নাকি এমনটাই জোর দিয়ে বলেছেন।
ভারতের সচেতন নাগরিক হিসেবে আমরা এই ভুলগুলি সংশোধন করতে চাই। এগুলি যে মিথ্য অভিযোগ, সে কথা বৃহত্তর সমাজের জানা দরকার। তার সঙ্গে সঙ্গে আমরা আবেদন জানাই, যাঁরা জনপরিসরে যে কোনও বিষয়ে বিতর্কে অবতীর্ণ হন, তাঁরা যেন সত্যের প্রতি দায়বদ্ধ থাকেন, তথ্যকে প্রাপ্য মর্যাদা দেন এবং সংযত ভাষা ব্যবহার করেন।
মিথ্যা অভিযোগের সমর্থনে ভ্রান্ত বক্তব্য পেশ করলে গণতন্ত্রের অনুশীলন ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়, এন রাম, সুধীর আনন্দ, এ কে শিবকুমার। |