নারীনির্যাতন মানেই কি নারীর উপর অপরিচিতের আক্রমণ? পরিসংখ্যান কিন্তু দেখাচ্ছে, সারা দেশেই ধর্ষণের
সিংহভাগ বহিরাগত আক্রমণের ফলে ঘটে না। শতকরা মোটামুটি ৯৮টি ক্ষেত্রে ধর্ষণ করে ধর্ষিতার পরিচিত কেউ।
ঋতেন মিত্র, ঈপ্সিতা পালভৌমিক, সৈকত বন্দ্যোপাধ্যায় |
ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো (এন সি আর বি)-র ২০১২ রিপোর্ট বেরোনোর পর থেকেই মিডিয়া ও জনমানসে আলোড়ন তৈরি হয়েছে। আলোড়ন তোলা তথ্যই বটে। রিপোর্ট দেখাচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গ সামগ্রিক ভাবে নারীনির্যাতনে দেশের মধ্যে সবচেয়ে উপরে। এক বছরে ৩০,৯৪২টি অভিযোগ নথিভুক্ত করা হয়েছে। দ্বিতীয় স্থানে অন্ধ্রপ্রদেশ (২৮১৭১), তৃতীয় উত্তরপ্রদেশ (২৩৫৬৯)। বাকিরা অনেক নীচে। কিন্তু শুধু সংখ্যা দিয়ে পুরো চিত্রটা পরিষ্কার হওয়া সম্ভব নয়। নারীনির্যাতনে রাজ্যে রাজ্যে যথার্থ তুলনার জন্য অপরাধের সংখ্যাকে জনসংখ্যা দিয়ে ভাগ করা প্রয়োজন। সেটা করলে দেখতে পাব, নারীনির্যাতনের আনুপাতিক হারের বিচারে পশ্চিমবঙ্গ আর প্রথম নয়, চতুর্থ।
নারীনির্যাতনে প্রথম চারটি রাজ্যের মধ্যে থাকায় কোনও গৌরব নেই। তার উপর রয়েছে এই তথ্য যে, ৭.৫ শতাংশ জনসংখ্যার এ রাজ্যে দেশের ১২.৭ শতাংশ নারীনির্যাতনের অভিযোগ নথিভুক্ত হয়েছে। ২০০৭ থেকেই পশ্চিমবঙ্গের নথিভুক্ত নারীনির্যাতনের ঘটনার হার সর্বভারতীয় হারের তুলনায় লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে, অর্থাৎ এই দুটি হারের মধ্যে ফারাক ক্রমবর্ধমান। ২০০৭ সালে উভয় হারের মধ্যে পার্থক্য ছিল ৫.৯৫, যা পাঁচ বছরের মধ্যে বেড়ে হয়েছে ২৮.৯। |
নারীনির্যাতন মানেই কি নারীর উপর অপরিচিতের আক্রমণ? উপর্যুপরি ধর্ষণের ঘটনা মিডিয়ায় আসায় এ রকম একটি ধারণা তৈরি হয়েছে। পরিসংখ্যান কিন্তু ঠিক উল্টোটা দেখাচ্ছে। শুধু পশ্চিমবঙ্গে নয়, সারা দেশেই ধর্ষণের অপরাধের সিংহভাগ কোনও বহিরাগত আক্রমণের ফলে ঘটে না। বরং শতকরা মোটামুটি ৯৮টি ক্ষেত্রে ধর্ষণ করে ধর্ষিতার পরিচিত কেউ। পশ্চিমবঙ্গের পরিসংখ্যানও বলছে যে, মেয়েদের উপর আক্রমণ আসছে মূলত ঘরের ভিতর থেকে, যাকে আমরা বলি ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স বা গৃহনির্যাতন। জনসংখ্যা পিছু ঘরোয়া নির্যাতনের হিসেবে গোটা দেশে সবার উপরে আছে ত্রিপুরা (৪৭.৮৫), তার পরেই পশ্চিমবঙ্গ (৪৫.১৩)। তৃতীয় ও চতুর্থ স্থানাধিকারী যথাক্রমে রাজস্থান (৪২.৩৬) ও অসম (৪০.২১)।
এন সি আর বি’র তথ্য অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গে সামগ্রিক ভাবে নথিভুক্ত গৃহনির্যাতনের হার অন্য প্রায় সমস্ত রাজ্যের চেয়েই অনেক বেশি। এর দুটি সম্ভাব্য কারণ থাকতে পারে: এক, পশ্চিমবঙ্গে গৃহনির্যাতন অন্য রাজ্যের থেকে বেশি; দুই, পশ্চিমবঙ্গে গৃহনির্যাতনের রিপোর্টিং বা নথিভুক্তি অন্য রাজ্যের চেয়ে বেশি হচ্ছে।
এই দুটি সম্ভাবনার মধ্যে কোনটি কতটা ঠিক, তার হদিশ এন সি আর বি’র তথ্য থেকে মিলবে না। মনে রাখতে হবে, এগুলি শুধুই নথিভুক্ত অভিযোগের হিসেব। কাজেই অপরাধ নথিভুক্তির হার এই তথ্য থেকে জানা সম্ভব নয়। রিপোর্টিং-এর হার কেমন, সেটা খতিয়ে দেখতে গেলে দ্বিতীয় একটি প্রামাণ্য সূত্র থেকে তথ্য নেওয়া যেতে পারে। এই নিবন্ধে আমরা এ জন্য ব্যবহার করব, গৃহনির্যাতন নিয়ে জাতীয় পরিবার সমীক্ষার (এন এফ এস) তথ্য। এই সমীক্ষার তথ্য যেহেতু প্রশ্নোত্তর আকারে, তাই এর একটি সুবিধা আছে। এখানে থানার আন্ডাররিপোর্টিং-এর সমস্যা থাকবে না। আবার একটি অসুবিধাও আছে। এখনও পর্যন্ত আমাদের হাতে সমীক্ষার ২০১২ সালের তথ্য নেই। তার পরিবর্তে আমরা ব্যবহার করেছি সমীক্ষার ২০০৬ সালের বিবাহিত মহিলাদের গৃহনির্যাতন নিয়ে তথ্য এবং তার সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে ওই একই বছরের এন সি আর বি’র তথ্যের।
কিছু কারণে, সমীক্ষা থেকে প্রাপ্ত বিবাহিত মহিলাদের নির্যাতনের সংখ্যা এখানে কিছু কমিয়ে ধরা হয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও দেখা যাচ্ছে, সমীক্ষা থেকে প্রাপ্ত অপরাধের হার এন সি আর বি থেকে প্রাপ্ত হারের চেয়ে অনেক গুণ বেশি। এবং এটা হয়েছে কমবেশি সব রাজ্যেই। সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, বিবাহিত মহিলাদের গৃহনির্যাতনে বিহারের স্থান সবার উপরে (৬০.৮ শতাংশ)। পশ্চিমবঙ্গে বিহারের চেয়ে বেশ কম (৪১.৮ শতাংশ)। বিহার বা উত্তরপ্রদেশের মতো রাজ্যগুলি, যারা সমীক্ষাতে উপরের দিকে আছে, তারা সকলেই এন সি আর বি’র তথ্য অনুযায়ী গৃহনির্যাতনে একেবারে নীচের সারিতে। সমীক্ষার পরিসংখ্যানের উপরে আস্থা রাখলে এ থেকে এই সিদ্ধান্তেই পৌঁছনো সম্ভব যে,
ক) গৃহনির্যাতনের বিশ্লেষণে এন সি আর বি রিপোর্টের তথ্য উপযুক্ত সূচক নয়। পাশাপাশি, এই রিপোর্টে পণজনিত কারণে মৃত্যুর তথ্য দেখলে দেখা যাবে, বিহার, উত্তরপ্রদেশের মতো রাজ্য সেখানে উপরে। পণজনিত কারণে মৃত্যুর তথ্য আন্ডাররিপোর্টেড হবার সম্ভাবনা কম। তাই এই রাজ্যগুলি যখন এন সি আর বি’র তথ্যে গৃহনির্যাতনে পিছনের সারিতে থাকে, তখন খুবই সন্দেহ হয়, বহু ঘটনাই সেখানে নথিভুক্ত হয় না।
খ) গৃহনির্যাতনের আন্ডাররিপোর্টিং বিহার বা উত্তরপ্রদেশের মতো রাজ্যে অনেক বেশি। পশ্চিমবঙ্গে তুলনায় কম। পশ্চিমবঙ্গে মহিলারা যেগুলি রিপোর্ট করার মতো অপরাধ বলে ভাবেন, বিহার ও উত্তরপ্রদেশের তুলনায় তার একটা বেশি শতাংশই রিপোর্ট করা হয় না।
পশ্চিমবঙ্গের চিত্র কি সত্যিই এতটা কুসুমাস্তীর্ণ? না। প্রথমত, নারীনির্যাতনের নিরিখে সমীক্ষায় পশ্চিমবঙ্গের স্থান প্রথম না হলেও খুব গৌরবজনক কিছু নয়। ২০০৩-১২ পশ্চিমবঙ্গে নথিভুক্ত গৃহনির্যাতনের হার অনেক বেড়েছে, এই বৃদ্ধি আন্ডাররিপোর্টিং কমার কারণে হতে পারে, গৃহনির্যাতন বৃদ্ধির কারণেও হতে পারে।
দ্বিতীয়ত, প্রকৃত চিত্র পেতে গেলে আমাদের যেতে হবে বিচার প্রক্রিয়ার শেষ ধাপ পর্যন্ত কত জন অভিযুক্ত শাস্তি পাচ্ছেন, তার হিসেবে। গৃহনির্যাতনের নথিভুক্ত ঘটনার মধ্যে কতগুলিতে অভিযুক্ত শাস্তি পেয়েছেন (একে আমরা শাস্তির হার বলতে পারি) তা দেখতে গিয়ে আমরা এক চমকপ্রদ পরিসংখ্যানের মুখোমুখি হই। গৃহনির্যাতনে শাস্তির হারে সারা ভারতে পশ্চিমবঙ্গ রয়েছে একদম শেষ সারিতে। এখানে হার মাত্র ৪.৪ শতাংশ। বিহার, ঝাড়খণ্ড, উত্তরপ্রদেশও ওই বিচারে পশ্চিমবঙ্গের চেয়ে অনেক এগিয়ে।
এর দুটি কারণ থাকতে পারে। এক, বেশি রিপোর্টিং আসলে মিথ্যে বা ভুল রিপোর্টিং। দুই, অভিযোগগুলি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মিথ্যে বা ভুল নয়, কিন্তু প্রশাসনের বা পুলিশি ব্যবস্থার অপব্যবহার বা গাফিলতির কারণে অভিযুক্তদের শাস্তি হচ্ছে না। দ্বিতীয় কারণটিই এখানে অধিক সুপ্রযুক্ত, কারণ আইনের অপব্যবহার হলেও সেটা শহুরে উচ্চ বা মধ্যবিত্তদের মধ্যেই হওয়ার সম্ভাবনা বেশি, যাদের সংখ্যা খুব বেশি নয়।
এই দ্বিতীয় কারণটিতে যদি আমরা যদি বেশি জোর দিই, তা হলে আমড়াতলার মোড়ে এসেই হাজির হয়ে বলব যে, গৃহনির্যাতনের নিরিখে এ রাজ্যের অবস্থা খুব খারাপ। আন্ডাররিপোর্টিং-এর হার এখানে অন্য রাজ্যের তুলনায় কম। কিন্তু সুবিচারের হার অত্যন্ত কম। ধর্ষণের ক্ষেত্রেও আলাদা করে দেখলে আমরা একই সিদ্ধান্তে পৌঁছব। পশ্চিমবঙ্গে ধর্ষণের শাস্তির হার ক্রমে কমেছে, এবং শুধু তাই নয়, এই হার দেশের গড় হারের চেয়েও অনেক কম। সারা দেশের মধ্যে সবচেয়ে কম শাস্তির হার যে রাজ্যগুলিতে, তার মধ্যে অন্যতম। আইনের অপব্যবহারের প্রশ্ন এ ক্ষেত্রে সে ভাবে তোলা যায় না, কারণ ধর্ষণ এখনও সামাজিক ট্যাবু। খুব কম ক্ষেত্রেই তা নিয়ে মিথ্যা কেস সাজানো হয়। এ ছাড়াও আমরা দেখেছি, যে রাজ্যগুলিতে গৃহহিংসায় শাস্তির হারও কম, সেখানে ধর্ষণের শাস্তির হারও কম এবং উল্টোটা। অর্থাৎ বলাই যায় যে, শাস্তির হার কম বা বেশি হওয়া বিচারব্যবস্থার সামগ্রিক অবস্থাকেই সূচিত করে।
সুতরাং নারীর উপর বহিরাগতের ‘আক্রমণ’ বাড়ছে, বা পাড়ায় পাড়ায় এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে, এই জাতীয় জনপ্রিয় ধারণাগুলি আমাদের খুব বেশি দূর এগিয়ে দিতে পারবে না বটে, কিন্তু নারীনির্যাতন সংক্রান্ত উদ্বেগ একেবারেই অযৌক্তিক নয়। পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে মূল সমস্যা হল, এখানে অভিযোগের সুরাহা হয় না, যা একটি অদক্ষ ও জরদ্গব প্রশাসনের চিত্রকেই চোখের সামনে তুলে ধরে। ‘কিছুতেই কিছু হয় না’ চিত্রটি বস্তুত মানুষের চোখে ‘নারীনির্যাতন বাড়ছে’ হিসেবেই প্রতিভাত হয়। আসলে যে চিত্রটি ভয়াবহ, তা হল, অপরাধীদের সাজা হচ্ছে না। এ ছবি বদলাতে হলে প্রশাসনিক অদক্ষতাকে সবার আগে চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। প্রয়োজন দক্ষতর প্রশাসনের জন্য নাগরিক সমাজের ক্রমাগত চাপেরও। |