আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সঙ্গীতজ্ঞ জুবিন মেটা শনিবার জম্মু-কাশ্মীরের রাজধানী শ্রীনগরের শালিমার বাগের মুঘল উদ্যানে তিনশো বছরের প্রাচীন চিনার গাছের ছায়ায় তাঁহার অর্কেস্ট্রা লইয়া যে সংগীত পরিবেশন করিয়াছেন, তাহাতে পশ্চিমি ধ্রুপদী সুরের পাশাপাশি কাশ্মীরি লোকগানের অনন্য শিল্পী অভয় সোপোরির দলের বৃন্দগানও গ্রথিত হইয়াছিল। এই চমকপ্রদ উপস্থাপনার পিছনে উদ্যোগ ছিল প্রধানত জার্মানির সরকারের। লক্ষ্য: ভূস্বর্গ কাশ্মীরের বাতাসে সুরের সাম্পান ভাসাইয়া দেওয়া। কাশ্মীরে অনুষ্ঠান করার জুবিন মেটার বহু কালের আকাঙ্ক্ষাও সক্রিয় ছিল। আর সমগ্র অনুষ্ঠানটিতে বাদ সাধিতে তৎপর হইয়াছিল হুরিয়ত সহ বিবিধ বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন। তৎপরতার কারণ সহজবোধ্য। শ্রীনগরে এমন একটি আন্তর্জাতিক অনুষ্ঠান সুষ্ঠু ভাবে সম্পন্ন হইলে এই প্রদেশের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে দেশেবিদেশে যে বার্তা যাইবে, সেটা তাহাদের ‘স্বাধীনতা-সংগ্রাম’-এর অনুকূল নয়। সুতরাং হুমকি ছিল। উপত্যকায় বন্ধ ডাকিয়া জনজীবন স্তব্ধ করা হইয়াছিল। তবু জুবিন মেটার অনুষ্ঠান বানচাল করা যায় নাই।
অনুষ্ঠান সফল করিতে, বিশেষত অনুষ্ঠানটিকে নিরাপদ ও নির্বিঘ্ন করিতে সরকারের তরফে ব্যাপক প্রস্তুতি লওয়া হয়। শালিমার বাগের আশপাশই কেবল নয়, সমগ্র শ্রীনগরকেই নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা বলয়ে মুড়িয়া দেওয়া হয়। সত্য, এই সঙ্গীতানুষ্ঠান আমজনতার জন্য উন্মুক্ত ছিল না। জুবিন নিজেও সে জন্য খেদ প্রকাশ করিয়া ভবিষ্যতে খোলা স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠান আয়োজনের আশ্বাস দেন। কিন্তু বিদেশি অতিথিদের নিরাপত্তার বিষয়টি উপেক্ষা করাও সরকারের পক্ষে সম্ভব ছিল না। অনুষ্ঠান সম্পন্ন করিতে পারাটাই ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লার সরকার সেই চ্যালেঞ্জ উত্তরণে সফল। লক্ষণীয়, প্রায় সমসময়ে, শালিমার বাগের অদূরে নাগরিক সমাজের প্রতিবাদী সংগীত-মেলাও সুষ্ঠু ভাবে সম্পন্ন হইয়াছে। সরকারের বিরুদ্ধবাদীরা ওই পাল্টা জলসার আয়োজন করিয়াছে বলিয়া ওমর আবদুল্লা তাহা বন্ধ করার কোনও চেষ্টা করেন নাই। তিনি সম্যক জানিতেন, জুবিন মেটার ‘এহসাস-ই-কাশ্মীর’-এর পাল্টা ‘হকিকত-ই-কাশ্মীর’ অনুষ্ঠানে গানে-কবিতায় কেবল সরকারকে তুলোধোনা করা হইবে না, মুজাহিদ তথা জেহাদি জঙ্গিদেরও বন্দনা গাওয়া হইবে। ইচ্ছা করিলেই তিনি একই দিনে, একই সময়ে এমন প্রতিস্পর্ধী অনুষ্ঠানের অনুমোদন না দিতে পারিতেন।
কিন্তু ওমর আবদুল্লা সম্ভবত দেখাইতে চাহিয়াছিলেন, হুরিয়ত নেতা সৈয়দ আলি শাহ গিলানিরা কাশ্মীরে ক্ষমতাসীন হইলে যাহা কোনও মতেই করিতে দিতেন না, রাজ্যের নির্বাচিত ও প্রতিনিধিত্বমূলক গণতান্ত্রিক সরকার কিন্তু তাহা অনুমোদন করার ঝুঁকি লইতে পারে। কারণ গণতন্ত্রের মূল কথাই হইল বহুত্ববাদবহু মত ও পথের সুস্থ, তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতা, একটিকে বন্ধ করিয়া অন্যটির পৃষ্ঠপোষণা নয়। গণতন্ত্রেরই সাহস আছে হুরিয়তের কট্টরপন্থীদের সহিত, এমনকী বিচ্ছিন্নতাবাদী জঙ্গিদের সহিতও আলোচনায় বসার, দর কষাকষি করার। কারণ তাহার লক্ষ্য জনকল্যাণ, কোনও গোষ্ঠীর বা গোষ্ঠীপতির কায়েমি স্বার্থের সংরক্ষণ নয়। গিলানি জুবিনের কনসার্ট বানচাল করিতে উপত্যকায় বন্ধ ডাকিলেন। ওমর গিলানি-সমর্থকদের বিকল্প কাশ্মীরের ছবি তুলিয়া ধরার অনুমতি দিতে পারিলেন। পার্থক্য এখানেই। |