আইনসভার প্রধান কাজ যে আইন প্রণয়ন, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের অনেকেরই বোধহয় তাহা মনে থাকে না। থাকিলেও তাঁহারা তদনুযায়ী কাজ করিতে পারেন না, সংকীর্ণ দলীয় স্বার্থের দ্বারাই চালিত হন। সংসদে যখন কোনও আইন-প্রস্তাব পেশ হয়, তাহার সমর্থন বা বিরোধিতা নির্ভর করে দলীয় সিদ্ধান্তের উপর, সেই সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় দলের কীসে আশু সুবিধা হইবে, কীসে অসুবিধা, তাহার ভিত্তিতে। প্রায়শ আবার শাসকের অহমিকা ও বিরোধীদের আহত মর্যাদা ব্যক্তিত্বের সংঘাত ঘটাইয়া সংসদকে অচল করে, ফলে কোনও বিল লইয়া আলোচনা বা বিতর্কের অবকাশ থাকে না। চতুর্দশ লোকসভা ও রাজ্যসভার একের পর এক অধিবেশন এই ভাবেই, কার্যত কোনও কাজ না করিয়াই, ভণ্ডুল হইয়া গিয়াছে। বর্ষাকালীন অধিবেশনকে তাহার ব্যতিক্রম মনে হইতে পারে। অধিবেশনটি শুরু হইয়াছিল যথাপূর্ব হট্টগোল, ওয়েলে নামিয়া চিৎকার, ওয়াক-আউট, পরস্পরের দিকে তাড়া করিয়া যাওয়া ও পরিণামে সভা-পরিচালকের দ্বারা অধিবেশন মুলতুবি ঘোষণার ধারাবাহিকতায়। কিন্তু তাহার পর অন্য দৃশ্য দেখা গিয়াছে। সরকার ও বিরোধী পক্ষের সম্মিলিত ইতিবাচক তৎপরতায় বেশ কিছু বিল পাশ হইয়াছে। এমনকী একাধিক ক্ষেত্রে যথার্থ বিতর্কও হইয়াছে!
খাদ্য সুরক্ষা বিল, জমি অধিগ্রহণ বিল, পেনশন বিল ইত্যাদির আইনে পরিণত হওয়া আগের অধিবেশনগুলিতে সম্ভব হয় নাই সরকার ও বিরোধী পক্ষের সমন্বয়ের অভাবে। আইনসভায় সরকার পক্ষের এমন গরিষ্ঠতা নাই যে জাতীয় বিরোধী দল বিজেপির সক্রিয় সহযোগিতা ব্যতীত সব বিল পাশ করানো যায়। সংবিধান সংশোধনের মতো বিলে তো বিরোধী পক্ষের সমর্থন অত্যাবশ্যকও। জনস্বার্থে বিরোধী দল বিজেপি খুঁটিনাটি আপত্তি ও পদ্ধতিগত ত্রুটি উপেক্ষা করিয়া বিল পাশে সহযোগিতা করিয়াছে,আবার সরকারও বিরোধীদের আনীত বিভিন্ন সংশোধন মানিয়া লইয়াছে। লক্ষণীয়, অনেক বিলেই বিরোধীদের মৌলিক আপত্তি নাই। কিন্তু প্রধান শাসক কংগ্রেসের নেতৃত্ব অতীতে অসহিষ্ণু আচরণ করায় তাঁহারা প্রতিবাদ জানাইয়াছিলেন। গণতন্ত্রে শাসক দল নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠতার অধিকারী হইলেও বিরোধীদের সহিত পরামর্শ করিয়া চলিতে দায়বদ্ধ। যে সরকারে প্রধান শাসক দলকে, শরিক ছাড়াও, জোটের বাহিরের দলেরও সমর্থন লইয়া ক্ষমতায় টিকিতে হয়, তাহার পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ বিলের অনুমোদনে বিরোধীদের আগাম পরামর্শ না লওয়া এবং একতরফা ভাবে আইনসভার ঘাড়ে বিল চাপাইয়া দেওয়া অনুচিত।
সুখের কথা, প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ এবং অবশ্যই তাঁহার অর্থমন্ত্রী পালানিয়াপ্পন চিদম্বরম সম্প্রতি বিরোধীদের সহিত আলাদা আলাদা ভাবে বৈঠক করিয়া বিল পাশে তাঁহাদের সহায়তা যাচ্ঞা করিয়াছেন। শাসনপ্রণালীতে এই পদ্ধতিই দস্তুর হওয়া উচিত। দেশের অর্থনীতির বর্তমান বেহাল দশায় কাঠামোগত সংস্কার অতিশয় আবশ্যক হইয়া পড়িয়াছে, যে জন্য নূতন আইন প্রণয়ন এবং সংবিধান সংশোধনও জরুরি হইবে। দেশের দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের তাই সংকীর্ণ স্বার্থচিন্তা ছাড়িয়া জনস্বার্থে দ্রুত বকেয়া কাজ মিটাইতে উদ্যোগী হওয়া উচিত। উন্নয়নের গতিকে রুদ্ধ হইতে দেওয়া যায় না, খুঁটিনাটি মতপার্থক্যের দোহাই পাড়িয়া বৃহত্তর স্বার্থ অগ্রাহ্য করাও যায় না। দুই দলের মধ্যে মৌলিক বিষয়গুলিতে কোনও বিরাট মতপার্থক্যও নাই। বিদেশ নীতির প্রশ্নেও উভয় দলই প্রতিবেশীদের সহিত সুসম্পর্কে আগ্রহী। অথচ শাসক দলের একতরফা মনোভাবের ঔদ্ধত্য এবং বিরোধী দলের বঞ্চিত ও প্রতারিত বোধ করার অভিমান পাকিস্তান ও বাংলাদেশের সহিত দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের উন্নতির ক্ষেত্রে অকারণ প্রতিবন্ধক রচনা করিতেছে। এই বাধা চরিত্রে অগণতান্ত্রিক। তাহা দূর হইলে ভারতীয় গণতন্ত্রের মঙ্গল। |