সত্তর টাকা দরে পেঁয়াজ কিনছিলেন ক্রেতারা। কিন্তু পুলিশ এসে দাঁড়াতেই পাল্টে গেল দামটা। খাকি উর্দি দেখেই এক ধাক্কায় দর নেমে দাঁড়াল পঞ্চাশে।
সোমবার সকাল সাড়ে দশটা, ল্যান্সডাউন বাজার। দর ওঠানামার এই বিচিত্র কাণ্ড দেখে হতবাক বাজারে আসা লোকজন।
একই ছবি যদুবাবুর বাজারেও। পুলিশ যখন পৌঁছল, তখন কেনাকাটা করে দোকানদারকে দাম মেটাতে যাচ্ছেন প্রীতি শর্মা নামে এক গৃহবধূ। পুলিশকে তিনি জানালেন, বারো টাকা কেজি দরে পাঁচ কিলো আলু কিনেছেন। পুলিশ দেখে দোকানদার অবশ্য প্রীতিদেবীকে কম দামেই আলু বেচলেন। কারণ, সরকারি ভাবে জ্যোতি আলুর জন্য কেজি প্রতি দশ টাকার বেশি নেওয়া যায় না।
শহরের অন্য বাজারগুলির ছবিটাও কিছুমাত্র আলাদা নয়। কোলে মার্কেটে পাইকারি দরে এক কিলো আদার দাম ১০০ টাকা। মানিকতলা বাজারে সেটাই বিক্রি করা হচ্ছে ২০ টাকা প্রতি ১০০ গ্রাম দরে। অর্থাৎ, কিলোগ্রাম প্রতি ২০০ টাকা। পোস্তায় সাদা পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে কিলোগ্রাম প্রতি ৩৮-৪০ টাকায়। অথচ গড়িয়াহাটে ক্রেতারা তা কিনছেন ৫৫ টাকায়। |
উর্দিধারী পুলিশ নিয়ে ঘুরছেন এনফোর্সমেন্ট-কর্তারা। সোমবার, ল্যান্সডাউন বাজারে। ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী। |
সাধারণ মানুষকে ঠকিয়ে যে জিনিসপত্রের দাম নেওয়া হচ্ছে, বাজার ঘুরে এ দিন তারই অভিজ্ঞতা হল পুলিশের ডিসি (এনফোর্সমেন্ট) রবীন্দ্রনাথ সরকারের। তবে এই অভিযানে কাজের কাজ কী হল, তা নিয়ে অবশ্য প্রশ্ন তুলেছেন অনেকেই। যদুবাবুর বাজারের এক বৃদ্ধ ক্রেতা বললেন, “পুলিশ-পাহারা নিয়ে এ ধরনের অভিযানে আদৌ কোনও লাভ হয় কি? উনি চলে গেলেই তো ফের দাম বেড়ে যাবে।”
সাধারণ ক্রেতাদের মতো বাজারে না ঘুরে উর্দি পরেই বাজারে হানা দেওয়ার এই ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে পুলিশকর্তাদেরও। রবীন্দ্রনাথবাবু অবশ্য বললেন, “যাঁরা বাজারে আসেন, আমাদের পরিদর্শনের ফলে তাঁরা অনেকটাই সচেতন হন। আধিকারিকেরা বাজারে ঘুরলে দোকানদারেরা কিছুটা হলেও সতর্ক হন।”
ক্রেতাদের সজাগ করতে অগত্যা এ বার খুচরো বাজারে পাইকারি দরের ডিসপ্লে বোর্ড ঝুলিয়ে দিতে চলেছে কলকাতা পুরসভা-কর্তৃপক্ষ। পুরসভার কর্তাদের মতে, পাইকারি দর দেখে খুচরো বাজার থেকে মাল কিনতে সুবিধা হবে ক্রেতাদের। একই সঙ্গে দামে বেশি ফারাক হলে ক্রেতারাই প্রতিবাদ করতে পারবেন। কী ভাবে ডিসপ্লে বোর্ড কাজ করবে, তা আজ, মঙ্গলবার হাতেকলমে দেখানো হবে পুরসভায়। হাজির থাকবেন পুলিশ ও টাস্কফোর্সের সদস্যেরা।
কিন্তু ডিসপ্লে বোর্ড যতক্ষণ না চালু হবে, ততক্ষণ পুলিশের ‘নজর’ই ভরসা। আর পুলিশ সরে গেলে কী হতে পারে, তার নমুনা অবশ্য সোমবারই হাতেনাতে পেয়ে গিয়েছেন ক্রেতারা। পুলিশ চলে যাওয়ার পরেই ল্যান্সডাউন মার্কেটে পেঁয়াজের দাম ফের সত্তর টাকা। যদুবাবুর বাজারেও ফের বারো টাকা দিয়েই আলু কিনতে হয়েছে ক্রেতাদের।
পুরসভা সূত্রের খবর, কলকাতাতেই পাইকারি এবং খুচরো বাজারে দামের এই ফারাক চলছে দীর্ঘদিন। তা নিয়ে উদ্বিগ্ন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিষয়টি নিয়ন্ত্রণে গত বছর টাস্কফোর্সও গঠন করেছেন। গত কয়েক মাসে বেশ কয়েক বার ওই টাস্কফোর্সের বৈঠকেও বারবার সতর্ক করেছেন সংশ্লিষ্ট দফতরের মন্ত্রী-আমলাদের। কিন্তু তাতে তেমন কাজের কাজ হচ্ছে না। বরং সব্জির পাইকারি ও খুচরো দরে বেশ ফারাক রয়ে যাচ্ছে।
তা নিয়ন্ত্রেণ আনতেই এ বার এই ডিসপ্লে বোর্ডের ব্যবস্থা। পুরসভার বাজার দফতর ঠিক করেছে, আপাতত পুরসভার নিজস্ব ৪৬টি বাজারে সব্জির পাইকারি দর বৈদ্যুতিন ডিসপ্লে বোর্ডে ফুটে উঠবে। যখন যা দাম, তা ক্রমাগত দেখানো হবে ওই বোর্ডে। যা দেখে বাজারে সব্জির দাম যাচাই করতে পারবেন ক্রেতারা।
মেয়র পারিষদ (বাজার) তারক সিংহ জানান, মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে কয়েক মাস ধরে শহরের প্রতিটি বাজারে সব্জি থেকে শুরু করে মাছ-মাংস কত দামে বিক্রি হচ্ছে, তার রিপোর্ট নেওয়ার কাজ চলছে। সেই রিপোর্ট যাচাই করে দেখা গিয়েছে, কোলে মার্কেট ও পোস্তা মার্কেটে জ্যোতি আলুর দর কেজি প্রতি ৮ টাকা। অথচ মানিকতলা, হাতিবাগান বা বেহালায় কেজি প্রতি ১২ টাকা দরে তা কিনতে হয় ক্রেতাকে। একই অবস্থা নৈনিতাল আলুর ক্ষেত্রেও। প্রতি কিলোয় প্রায় চার টাকা বেশি। পোস্তা থেকে পেঁয়াজ কিনে তা যে কোনও খুচরো বাজারে বিক্রি হয় কিলো প্রতি ১৫-২০ টাকা বেশি দরে। কোলে মার্কেটের এক ব্যবসায়ীর কথায়, “পাইকারি বাজার থেকে খুচরো বাজারে মাল পরিবহণের খরচ ধরলেও দামের এত তফাত হওয়ার কোনও কারণ নেই। তা সত্ত্বেও কেন এত দাম, তা দেখা উচিত প্রশাসনের।” পুরসভার এক পদস্থ আধিকারিক জানান, সব্জি বাজারের দর নিয়ন্ত্রণের এই বিষয়টি মুখ্যমন্ত্রীকে ইতিমধ্যেই জানানো হয়েছে। তিনি এই পরিকল্পনায় সম্মতি দিয়েছেন। তাঁর নির্দেশ, খুব শীঘ্রই শহরে শাকসব্জির দর নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। পুর সূত্রের খবর, কিছু দিনের মধ্যেই পুরসভার বাজারগুলোয় ওই ডিসপ্লে বোর্ড বসবে। |