সুস্মিতা বন্দ্যোপাধ্যায় খুনের পাঁচ দিন পরে এই ঘটনায় দু’জনকে গ্রেফতার করল আফগানিস্তানের পুলিশ। সোমবার সন্ধ্যায় কাবুল থেকে ফোনে আনন্দবাজারকে এ খবর জানিয়েছেন আফগানিস্তানে ভারতের রাষ্ট্রদূত অমর সিন্হা। তিনি বলেন, “গ্রেফতার হওয়া দু’জনকে খুনের কারণ সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ। তাদের পরিচয় জানারও চেষ্টা চলছে।” ধৃতদের সঙ্গে কি তালিবান-যোগ রয়েছে? অমরবাবুর মন্তব্য, “পুলিশই তদন্ত করে এ ব্যাপারে যা বলার বলবে। যেখানে ঘটনাটি ঘটেছে, সেটা কাবুল থেকে অনেক দূরে। পাকিস্তান সীমান্তের কাছে। অত দূর থেকে এখনও পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট আমাদের হাতে আসেনি।”
সুস্মিতার বাপের বাড়ির সদস্যরা এবং পরিচিতরা অবশ্য খুনের পিছনে তালিবান নয়, অন্য কারণই দেখছেন। তাঁদের একাংশের ইঙ্গিত সুস্মিতার শ্বশুরবাড়ির লোকেদের দিকেই। পাশাপাশি সুস্মিতার ঘনিষ্ঠ বন্ধু শালিনী নস্করের সঙ্গে তাঁর ফেসবুকে কথাবার্তা প্রকাশ্যে আসায় জানবাজদের ব্যাপারে রহস্য বেড়েছে। সুস্মিতার স্বামী জানবাজ খান বা তাঁর ভাই জার খানের আচরণ নিয়েও প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। এমনিতে জানবাজের ফোন রবিবার থেকেই বন্ধ। জানবাজের খুড়তুতো ভাই জার খান শনিবারই আফগানিস্তান থেকে ফোনে দীর্ঘক্ষণ আনন্দবাজারের সঙ্গে কথা বললেও রবিবার তাঁকে সারা দিনে ফোনে পাওয়া যায়নি। সোমবার বিকেলের দিকে বহু চেষ্টার পরে অবশেষে ফোন ধরেন জার খান। এ দিনও তিনি নাম এবং কোথা থেকে কথা বলছি, তা ফের জানতে চান। এর পরেই সুস্মিতার ব্যাপারে কথা বলতে চাইলে জার খান সাফ বলেন, “এ নিয়ে আমি কিছু বলতে পারব না। বাড়িতে বেশ কিছু লোকজন এসেছে। পরে ফোন করবেন।” এই বলে ফোন কেটে দেন তিনি। তার পরে বহু চেষ্টা করেও তাঁর ফোন পাওয়া যায়নি।
সুস্মিতার শ্বশুরবাড়ির আচরণে বেশ কিছু অসঙ্গতি রয়েছে বলে দাবি করা হয়েছে তাঁর বাপের বাড়ির তরফেও। সেই কারণেই সুস্মিতার ভাই গোপাল বন্দ্যোপাধ্যায় এই খুনের বিষয়ে কিছু তথ্য জানতে চেয়ে একটি ই-মেল পাঠিয়েছেন আফগানিস্তানে ভারতীয় দূতাবাসে। অমর সিন্হাও এ দিন বলেন, “কলকাতা থেকে সুস্মিতার পরিবার আমাদের ই-মেল করে তাতে ওঁর মৃত্যু সম্পর্কে কিছু তথ্য জানতে চেয়েছে। আমরা উত্তরও দিয়েছি।” আজ সেই জবাব হাতে পাওয়ার পরে তাতে আরও কিছু অসঙ্গতি মিলেছে বলে দাবি সুস্মিতার পরিবারের। সুস্মিতার ভ্রাতৃবধূ দেবলীনা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “আমরা কাবুল দূতাবাসে চিঠি লিখে উনি কী ভাবে খুন হয়েছেন জানতে চেয়েছিলাম। তাঁর দেহ আমাদের এখানে আনার ব্যপারে উদ্যোগী হতেও অনুরোধ করি। সোমবার কাবুল দূতাবাস থেকে যে ই-মেল এসেছে, তাতে কিছু তথ্য আমাদের কাছে সন্দেহজনক মনে হয়েছে।”
কী সেই তথ্য?
দূতাবাসের ওই ই-মেল-এ জানানো হয়েছে, জানবাজ দূতাবাসের কর্মীদের জানিয়েছেন, সুস্মিতাকে সেই রাতে কারা খুন করেছে, সে ব্যাপারে তাঁদের কোনও ধারণা নেই। জানবাজ আরও জানান, গোপালবাবুর মোবাইল নম্বর কাছে না থাকায় তিনি সুস্মিতার মৃত্যুর খবর তাঁদের দিতে পারেননি।
সুস্মিতার পরিবারের অভিযোগ, জানবাজের দেওয়া এই দুই তথ্যই তাঁদের মিথ্যে মনে হয়েছে। কারণ গত শনিবার অনেক চেষ্টার পর যখন তাঁরা জানবাজের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন, তখন জানবাজ ও তাঁর ভাই জার খান তাঁদের ফোনে জানিয়েছিলেন, ৩০-৩৫ জন তালিবান জঙ্গি বুধবার রাতে বাড়িতে ঢুকে সুস্মিতাকে বেঁধে বাড়ির বাইরে নিয়ে গিয়ে গুলি করে খুন করে। একই কথা জার খান শনিবার আনন্দবাজারের প্রতিনিধিকেও জানিয়েছিলেন। এখন কেন খুনের পিছনে কারা রয়েছে, তা বলছেন না জানবাজরা?
গোপালবাবুর কোনও ফোন নম্বর জানা ছিল না বলেই ওই খুনের খবর সঙ্গে সঙ্গে দেওয়া যায়নি বলে জানবাজ যে দাবি করেছেন, তা-ও উড়িয়ে দিয়েছেন দেবলীনা। তিনি বলেন, “জুলাই মাসে সুস্মিতা যখন কলকাতায় আসেন, তখন ওঁর সঙ্গে যোগাযোগের জন্য জানবাজ আমার স্বামীর নম্বরেই ফোন করতেন। তা হলে এখন কেন জানবাজ বলছেন ফোন নম্বর জানা নেই?” দেবলীনা বলেন, “এই দু’টি অসঙ্গতি ও কয়েকটি প্রশ্ন নিয়ে আমরা কাবুল দূতাবাসে ফের একটি মেল পাঠিয়েছি।” একই সঙ্গে বাপের বাড়ির সঙ্গে আলোচনা না করেই সুস্মিতার দেহ কেন তড়িঘড়ি কবর দেওয়া হল, ই-মেল করে সে প্রশ্নও তুলেছেন তাঁরা? সুস্মিতার মৃত্যু সম্পর্কে সেখানকার পুলিশ প্রশাসন কী বলছে, তা-ও জানতে চেয়েছেন তাঁরা।
সুস্মিতার দেহের ময়না তদন্ত নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন তাঁর পরিবারের লোকেরা। এ ব্যাপারে অমরবাবুর জবাব, “আফগানিস্তানে ময়নাতদন্ত তখনই হয়, যখন কোনও অস্বাভাবিক মৃত্যুর কারণ জানা যায় না। এখানে নিশ্চিত হওয়া গিয়েছে যে, আততায়ীর গুলিতেই মৃত্যু হয়েছে সুস্মিতার। তাই ময়নাতদন্তের প্রয়োজন হয়নি।”
এ দিনই দিল্লিতে পশ্চিমবঙ্গের রেসিডেন্ট কমিশনার ভাস্কর খুলবেকে চিঠি দিয়ে বিদেশ মন্ত্রকের আফগানিস্তান ডেস্ক জানিয়েছে, তারা সুস্মিতার মরদেহ আনার বিষয়টি নিয়ে আফগানিস্তান সরকারের সঙ্গে কথা বলছে। কাবুলে ভারতের হাই-কমিশনারকেও বলা হয়েছে, দেহ ফেরানোর ব্যাপারে সুস্মিতাদেবীর স্বামী কী চাইছেন, তাও দেখতে হবে। |