অবসরের চার বছর পেরিয়ে গিয়েছে। তারপরেও নিয়মিত চক, ডাস্টার হাতে ক্লাসে যান ‘বড়দি’।
কাটোয়া শহরের সার্কাস ময়দানের হাজরাপুর কলোনীর প্রাথমিক স্কুল। খাতায়-কলমে শিক্ষক ৫ জন। তার বাইরেও রয়েছেন ঝর্ণা রায়চৌধুরি। অবসর নেওয়ার পরেও তাঁর ‘অবসর’ নেই। তিনি এখনও শিক্ষিকা। তবে এর জন্য কোনও পারিশ্রমিক নেন না তিনি। প্রতিদিন মুচিপুকুর পাড় উজিয়ে ৪০ টাকা রিক্সাভাড়া করে স্কুলে আসেন। যদি কোনওদিন আসতে না পারেন তাহলে প্রধান শিক্ষকের থেকে ‘ছুটি’ চেয়ে নেন।
অবসরের পরেও কেন স্কুলে আসেন ঝর্নাদেবী?
ক্লাসের বাইরের একটি চেয়ারে বসে ঝর্নাদেবী জানালেন, তাঁর বাড়ি মুর্শিদাবাদের খড়গ্রাম থানার এড়োয়ালি গ্রামে। ১৯৭৭ সালে তিনি কেতুগ্রাম-২ চক্রের একটি প্রাথমিক স্কুলে চাকরি পান। এরপর বেশ কয়েকটি স্কুলে বদলির পর হাজরাপুর কলোনীর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষিকা হিসেবে যোগ দেন। সালটা ১৯৯৯। |
এই স্কুলেই ৯ বছর টানা চাকরির পর ২০০৯ সালে অবসর নেন ঝর্নাদেবী। সেই সময় স্কুলে বিদায় সংবর্ধনার অনুষ্ঠানও হয়েছিল। তাতে অবশ্য শিক্ষকতায় ইতি পড়েনি। ঝর্নাদেবীর কথায়, “যখন স্কুলে প্রথম চাকরি পাই, তখন অবসরের বয়স ছিল ৬৫। তারপর সেটা ৫ বছর কমে যায়। তখনই ঠিক করে নিয়েছিলাম অবসরের পরেও স্কুলে পড়াব। স্কুল কর্তৃপক্ষকে সেই প্রস্তাব দিলে তাঁরা মেনে নেন।”
ঝর্নাদেবী অবসরের পর যখন প্রথম স্কুলে আসা শুরু করেন তখন স্কুলে পড়ুয়ার সংখ্যা ১৭৫। শিক্ষক মাত্র ২ জন। স্কুলের প্রধান শিক্ষক মানস কান্তি বিশ্বাস বলেন, “এখন শিক্ষক-শিক্ষিকার সমস্যা মিটলেও সেই সময় ঝর্নাদির প্রস্তাবে খুব স্বস্তি পেয়েছিলাম।” ‘বড়দি’র সহকর্মী শমিষ্ঠা নাগ বন্দ্যোপাধ্যায়, সুপ্রিয়া দত্ত মিত্রের কথায়, “যখন স্কুলে কেউ ছিল না তখন তিনি আমাদের পাশে দিদি হিসেবে ছিলেন। এখনও আছেন। তাঁর প্রতি আমরা কৃতজ্ঞ।” শুধু সহকর্মীরাই নন, বড়দির কাছে পড়তে পেরে খুশি পড়ুয়া ও তাদের অভিভাবকেরাও।
বর্তমানে অবশ্য স্কুলে স্কুলে ৬ জন শিক্ষক-শিক্ষিকা। “এ বার তো সত্যি সত্যিই অবসর নিতে পারেন?”-প্রশ্ন শুনে মৃদু হেসে ‘বড়দি’ বলেন, “আমি অবিবাহিত। বাড়ি থেকেই বা কী করব? স্কুলে এসে পড়ালে মনটাও ভাল থাকে। স্কুলই আমার বাড়ি।”
শিক্ষকতা তো শুধু চাকরি নয়। দায়িত্ব। ঝাপসা হতে থাকা এই শব্দবন্ধ হয়ত এই ‘বড়দি’দের জন্যই এখনও বেঁচে আছে। |