নেপাল পুলিশের সদর দফতরের প্রধান ফটক পেরোনোর পরও আটকে দেওয়া হল উইম কোভারম্যান্সদের টিম বাস। দাঁড় করিয়ে রাখা হল মিনিট পনেরো।
আলি আশফাকদের কোচের কড়া নির্দেশ, তাঁদের অনুশীলন শেষ না হলে যেন টিম ইন্ডিয়াকে মাঠে ঢুকতে না দেওয়া হয়।
‘রেড স্ন্যাপার্স’-দের হাঙ্গেরিয়ান কোচ উরবানি ইস্তাভন টিম বাসে উঠতে যাবেন, মাঠে নেমে পড়লেন মেহতাব-নবি-সুব্রতরা।
উরবানি বা কোভারম্যান্স একে অন্যকে না দেখার ভান করে মুখ ফিরিয়ে থাকলেন। ধুলো উড়িয়ে মলদ্বীপের টিম বাস হোটেলে ফিরে যাওয়ার মুখেই ভারতীয় শিবির থেকে ভেসে এল হুঙ্কার। “অনেকে অনেক কথা বলে। গুরুত্ব দিতে নেই। মাঠেই আশফাকদের জবাব দেব। যা বলার ম্যাচের পর বলব,” শেষ প্রহরী সুব্রত পালের কথায় দেখে নেওয়ার ইঙ্গিত।
এটাই তো ছিল না ভারতের। এই জেদ! এই একাগ্রতা! পরমুহূর্তেই ‘স্পাইডারম্যান’-এর গলায় চূড়ান্ত আত্মবিশ্বাস। “কাল অন্য ম্যাচ। সেমিফাইনাল মানেই টুর্নামেন্টের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচ। কাল অন্য চেহারায় দেখবেন ভারতকে। আমরা তৈরি।”
একটু পিছনে কোচ উইম তখন হাসছেন। “আশফাক আগে খেলুক। আগের দিন তো খেললই না। কাল খেলবে তো?” ডাচ কোচের গলায় তাচ্ছিল্য। “আমরা ট্রফি নিতে এসেছি। গ্রুপ অব ডেথ থেকে সেমিফাইনালে উঠেছি। ওরা দু’ম্যাচে আঠারো গোল করেছে ঠিক। কিন্তু কাদের বিরুদ্ধে?” |
দেখেশুনে কেমন যেন বিভ্রান্তি আসে মনে। হামাগুড়ি দিয়ে সাফ সেমিফাইনালে ওঠা ‘ব্লু টাইগার্স’ কি বদলে ফেলল নিজেদের? ‘বেড়াল’ থেকে সত্যিই কি তারা ‘টাইগার’ হওয়ার অপেক্ষায়? বডি ল্যাঙ্গোয়েজ যদি কোনও ম্যাচের আগমনী শোনায়, তা হলে কিন্তু কাঠমান্ডুর ঝকঝকে রোদে লেনি-অর্ণব-জেজেদের শরীর থেকে চুঁইয়ে পড়তে শুরু করেছে জেদ। যা দেখা গিয়েছিল এক বছর আগের নেহরু কাপে। সবার হাতে যেন অদৃশ্য প্ল্যাকার্ড, “সমালোচনা থামানোর একটাই রাস্তা, ম্যাচ জেতো। ফাইনালে যাও।” এবং এই ‘প্ল্যাকার্ড’ তৈরির পিছনে কাজ করছে মলদ্বীপের ‘উস্তাদোঁ কা উস্তাদ’ আলি আশফাকের মন্তব্য- “এ বারের ভারত সবথেকে দুর্বল।”
তাঁদের ‘জাদুকর’-ই যে থালায় করে মোটিভেশন-ট্যাবলেট তুলে দিয়েছেন বিপক্ষের হাতে, সেই খবর পৌঁছেছে মলদ্বীপ শিবিরেও। এবং সেটা সামাল দিতে কোচ উরবানি বলে দিয়েছেন, “আশফাকের মত ওর নিজস্ব। ভারত যথেষ্ট শক্তিশালী। তবে আমরাও খেলার স্টাইল বদলেছি। ওদের মতো দুমদাম উঁচু বল খেলি না এখন।” পরে অবশ্য সামান্য মলমও লাগিয়েছেন তিনি। “কপালজোরে ভারত শেষ চারে গিয়েছে এটা মনে করি না। শেষ মিনিটে যে দল দু’টো গোল করে, তাদের সমীহ করতেই হবে।” আসলে এই টুর্নামেন্টের সবথেকে অভিজ্ঞ কোচ উরবানির দ্বিমুখী তত্ত্ব দেওয়া ছাড়া উপায়ও নেই। কারণ তাঁকে এক দিকে যেমন চিন্তায় রেখেছে ভারতের বিরুদ্ধে দলের বিশ্রী ট্র্যাক রেকর্ড। অন্য দিকে নেপালে এসে নিজের টিমের দুর্ধর্ষ ফর্মকেও তিনি ফেলে দিতে পারছেন না।
ভারত-মলদ্বীপ লড়াই মানেই দক্ষিণ এশিয়ায় একটা ধুন্ধুমার যুদ্ধের আবহাওয়া। এতটাই যে, টুর্নামেন্ট চলতে চলতেই মলদ্বীপ ফুটবলাররা নানা রকম পণ করে বসেছেন। কেউ বলছেন চ্যাম্পিয়ন হলে লম্বা চুল কেটে ফেলবেন মাঠেই। কেউ আবার ন্যাড়া হবেন বা হেয়ারস্টাইল বদলে ফেলবেন।
কিন্তু ভারতের খেলার স্টাইল কি কাল বদলাবে? ভারত কি ডাচ ঘরানার ৪-৫-১ ফর্মেশন নিয়েই নামবে, নাকি ফিরে যাবে ভারতের সাবেকি ৪-৪-২-তে? অনুশীলনে বুঝতে দেননি কোভারম্যান্স। “দু’টো ফর্মেশনেই আমরা সাবলীল। প্রয়োজন অনুযায়ী ঠিক করব কোনটায় খেলব।” খোঁচা খাওয়া প্রশ্নে এর চেয়ে বেশি কিছু বলতে চাননি টিমকে চাঙ্গা করার চেষ্টায় বিরামহীন ভারতীয় কোচ।
আজ সোমবার দশরথ স্টেডিয়ামে খেলতে নামার তিরিশ ঘণ্টা আগে অবশ্য মিডিয়াকে দূরেই রাখলেন দুই কোচ। ক্লোজড ডোর অনুশীলন হয়েছে দু’দলেই। দুই কোচই পেনাল্টি কিক মারিয়েছেন, সম্ভাব্য টাইব্রেকারের প্রস্তুতি হিসাবে। সেট পিস অনুশীলন হয়েছে দীর্ঘক্ষণ। |
|
ভারত |
বনাম |
মলদ্বীপ |
|
|
• দুই দলের প্রথম সাক্ষাৎ ১৯৮৭ সাফ গেমসে। ভারত ৫-০ জিতেছিল।
• সাফের ইতিহাসে মোট ৯ বার সেমিফাইনালে উঠেছে ভারত। মলদ্বীপ ৫ বার।
• দুই দলের মুখোমুখি সাক্ষাৎ ১৮। ভারতের জয় ১১, মলদ্বীপ ৪, ড্র ৩।
• শেষ সাক্ষাৎ ২০১২ নেহরু কাপ। ভারত ৩-০ জেতে। |
|
কার্ডের জন্য এই ম্যাচে নেই ভারত অধিনায়ক সুনীল ছেত্রী। এটা তাদের বাড়তি সুবিধা, মানছেন মলদ্বীপ কোচ। “সুনীল বড় ফুটবলার। ওর না থাকা ভারতের ক্ষতি। আমাদের লাভ,” বলে দিয়েছেন উরবানি। কিন্তু সুনীলের না থাকাটাকে আবার আশীর্বাদ হিসেবে দেখছেন ভারতীয় টিমের অনেকেই। তাঁদের ধারণা, সুনীল থাকলেই এক স্ট্রাইকারে খেলার দিকে ঝুঁকতেন কোচ। এখন ৪-৪-২ ছাড়া পথ নেই। সেখানে হয়তো জেজে আর ফ্রান্সিসই শুরু করবেন। রহিম নবিও কি আসতে পারেন জেজে-র সঙ্গে? না কি জুয়েল রাজা? নানা রকম কথাও শোনা যাচ্ছে ভারতীয় শিবির থেকে। “সুনীল ভাই না থাকাটা ক্ষতি। কিন্তু যারা আছে তারা জেতার জন্য মরিয়া,” সরকারি সাংবাদিক সম্মেলনে বলছিলেন সুব্রত। মিডিয়ার সামনে এসে টিমে অনিয়মিত অলউইন জর্জও শুনিয়েছেন জেতার জন্য তৈরি।
“আগে কী হয়েছে ভুলে যান। আমরা আর একটা ফাইনাল খেলতে নামছি। ছেলেরা তৈরি,” প্রতি দিনের মতো এ দিনও সুব্রতদের কোচ ভাঙা রেকর্ড বাজিয়েছেন। কোভারম্যান্সকে পাল্টা প্রশ্ন করা হয়, শেষ তিনটি ‘ফাইনাল’-এর একটায় মাত্র জিতেছেন। মনে আছে? দু’টো বুড়ো আঙুল তুলে পিছনে অনুশীলন করতে থাকা নির্মল-মোহনরাজ-গৌরমাঙ্গীদের দেখিয়ে ডাচ কোচ বলেছেন, “আমার ছেলেদের দেখুন। কেমন লাগছে?”
কিন্তু মুখের কথা, বডি ল্যাঙ্গোয়েজ এক জিনিস। আর মাঠে নেমে খেলা অন্য ব্যাপার। যে টিমটা নেপালের মতো ফিফা র্যাঙ্কিংয়ে অনেক নীচে থাকা দলের বিরুদ্ধে একটা পাঁচ গজের পাস ঠিকঠাক করতে পারেনি, এক বারও মাঝমাঠের দখল নিতে পারেনি, প্রথম কর্নার পেয়েছে দ্বিতীয়ার্ধের মাঝামাঝি, সেই ভারত হারিয়ে দেবে তিন ম্যাচে আঠারো গোল করা মলদ্বীপকে?
ফুটবল-বোধ বলছে, মলদ্বীপকে হারানো সম্ভব নয়। চোখে এখনও যে লেগে আছে দু’ম্যাচে আলি আশফাকের হ্যাটট্রিক, হ্যাটট্রিক এবং হ্যাটট্রিক। রেকর্ড গড়ে একারই অতিমানবীয় হয়ে ওঠা দশ গোল করার উচ্ছ্বাসের ছবি।
কিন্তু যুক্তি বলছে, আন্ডারডগ হিসেবে এ রকম ম্যাচ তো বহু বার জিতেছেন নবি-নির্মলরা। দিল্লির গত সাফ কাপেই তো ছারখার হয়েছিল মলদ্বীপ। এক বছর আগের নেহরু কাপেও বিধ্বস্ত হয়েছিলেন আশফাক, আরিফ গনিরা।
তা হলে এ বারই বা কেন হবে না? |
আজ টিভিতে
সাফ কাপের সেমিফাইনালে মুখোমুখি ভারত ও মলদ্বীপ (স্টার স্পোর্টস ২, সন্ধ্যা ৬-১৫) |