বাড়তি কর্মীদের বদলি করা হয়েছিল পাঁচ কিলোমিটার দূরের খনিতে। পরিণামে টানা প্রায় দু’দিন ঘেরাও আধিকারিকেরা। বেতন ও বোনাস নগদে দেওয়া হয়নি। লাঠি, রডের ঘায়ে প্রাণ ওষ্ঠাগত অফিসারের।
কিছু গ্রামবাসীর দাবি মতো কয়লা দেননি আধিকারিক। তুলে নিয়ে গিয়ে তাঁকে আটকে রাখা হয় গ্রামে।
আসানসোল-রানিগঞ্জ খনি অঞ্চলে ছোট-বড় দাবি না মিটলেই আধিকারিকদের উপরে হামলার ঘটনার এই তালিকা বেশ লম্বা। শ্রমিক সংগঠন নির্বিশেষে, ছুতো পেলেই খনিকর্তাদের গায়ে হাত তোলার সুযোগ পেলে পিছিয়ে থাকেনি কেউই। রাজ্যে বামফ্রন্ট আমলে এমন ঘটনা ঘটেছে একের পর এক। তৃণমূল সরকার ক্ষমতায় আসার পরেও ছেদ পড়েনি পরম্পরায়। প্রশাসনের হস্তক্ষেপ, খনি বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত, আধিকারিকদের কর্মবিরতিকোনও কিছুই একেবারে বন্ধ করতে পারেনি এই ধরনের ঘটনা।
১৯৯৩-এ পাণ্ডবেশ্বরে শোনপুর বাজারি প্রকল্পে একটি বড় ডাম্পারের চাকা খুলে ফের লাগানো হচ্ছিল। হঠাৎ ফস্কে পড়ে যায় সেটি। চাপা পড়ে মৃত্যু হয় পাশে দাঁড়িয়ে থাকা এক খনিকর্মীর। খনিকর্মীদের সঙ্গে বিক্ষোভে সামিল হওয়ার নামে এক ইঞ্জিনিয়ারকে বেধড়ক মারে কিছু গ্রামবাসী। ১৯৯৮ সালে রানিগঞ্জে ঘনশ্যাম কোলিয়ারির অতিরিক্ত কর্মীদের বদলির বিজ্ঞপ্তি জারি করেন খনি কর্তৃপক্ষ। প্রতিবাদে সিটুর নেতৃত্বে এজেন্ট-সহ আট আধিকারিককে ৪২ ঘণ্টা ঘেরাও করে বিক্ষোভ চলে। ১৫ ঘণ্টা কোনও খাবার মেলেনি, শৌচালয়েও যেতে দেওয়া হয়নি তাঁদের। শেষে এক ম্যাজিস্ট্রেট গিয়ে ঘোষণা করেন, বিক্ষোভ না তুললে লাঠি, প্রয়োজনে গুলি চালানো হবে। ঘেরাও ওঠে। |
২০০২-এর অগস্টে পাণ্ডবেশ্বরে শ্যামলা কোলিয়ারিতে ক্ষতির কারণে ডিজিএমএসের নির্দেশ মতো খনি বন্ধের বিজ্ঞপ্তি জারি করে কর্তৃপক্ষ। প্রতিবাদে সিটুর নেতৃত্বে কোলিয়ারির পার্সোনেল ম্যানেজার ও এরিয়ার জেনারেল ম্যানেজারকে প্রায় দেড় মাস খনি কার্যালয়ে ঢুকতে দেননি কিছু খনিকর্মী। ২০০৬ সালে পুজোর আগে ব্যাঙ্কের মাধ্যমে বেতন দেওয়ার সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে অন্ডালে সিঁদুলি কোলিয়ারির পার্সোনেল ম্যানেজারকে কিছু এআইটিইউসি কর্মী-সমর্থকেরা কার্যালয় থেকে লাঠি, রড দিয়ে মারতে মারতে সিপিআই অফিসে নিয়ে যায়। ২০০৭-এ ঝাঁঝরা প্রজেক্টে নয় আধিকারিককে গাড়ি থেকে নামিয়ে বেধড়ক মারা হয়। অভিযোগের আঙুল ছিল সিপিএমের দিকে। ২০০৮-এ ইসিএলের সদর দফতরে এস্টেট ম্যানেজারের চেম্বারে ঢুকে নাকে ঘুষি মারার অভিযোগ ওঠে ফরওয়ার্ড ব্লক যুব লিগের নেতা বীরেশ্বর আচার্যের বিরুদ্ধে। তাঁর দাবি ছিল, তাঁর অনুগামীদের গাড়িই ভাড়া নিতে হবে। যা ভাড়া হাঁকা হবে, তা-ই দিতে হবে।
২০১১-এর মার্চে পরাশিয়া কোলিয়ারিতে মৃতদেহ দাহ করার জন্য জ্বালানির দাবি জানাতে যান ধান্ডাডিহির কয়েক জন। নেতৃত্বে ছিলেন কুনস্তরিয়া ও কেন্দা এরিয়ার চার কর্মী। তাঁদের দাবি মতো ছোট এক লরি ভর্তি কয়লা দিতে অস্বীকার করলে আধিকারিকদের মারধর করা হয়। পরে কার্যালয় থেকে এক আধিকারিককে গ্রামে তুলে নিয়ে গিয়ে আটকে রাখা হয়। পুলিশ এবং সিআইএসএফ তাঁকে উদ্ধার করে।
শেষ ঘটনা গত ৩০ অগস্টের। পাণ্ডবেশ্বেরের কুমারডি-বি কোলিয়ারিতে হাজিরা খাতায় অসঙ্গতি দেখে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মী তথা তৃণমূলের শ্রমিক নেতা বাপ্পাদিত্য মুখোপাধ্যায়ের কাছে বিষয়টি জানতে চান এক অফিসার। অভিযোগ, বাপ্পাদিত্যবাবু ওই অফিসারের মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে হুমকি দেন, মারধরও করেন। বিষয়টি নিয়ে ইসিএলের আধিকারিকদের সংগঠন বৈঠক করে সে দিনই। অভিযোগ, বৈঠক শেষে এক দল লোক তাঁদের উপরে হামলা চালায়। কর্তৃপক্ষ খনি বন্ধের সিদ্ধান্ত নেন। পরে শ্রমিক সংগঠনগুলি গণ্ডগোল হবে না, এই আশ্বাস দিলে কাজ চালু হয়। ইসিএলের আধিকারিকদের একাংশের মতে, বেশ বড় এলাকা জুড়ে কর্মকাণ্ড এই সংস্থার। এলাকার মানুষ ও শ্রমিকদের নানা দাবিদাওয়া ও প্রত্যাশা সংস্থাকে ঘিরে। কোনও সময়ে দাবি আদায়ে মরিয়া চেষ্টা এবং তা না মিটলেই রোষ পড়ে আধিকারিকদের উপরে। কোল ইন্ডিয়া অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের ইসিএল শাখার সম্পাদক দামোদর বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “রাজ্য সরকারকে সব থেকে বেশি রয়্যালটি ও সেস দেয় এই সংস্থা। শেষ অর্থবর্ষে যা ছিল ১৭০০ কোটি টাকা। প্রশাসনের উচিত, এই সংস্থার আধিকারিকদের নিরাপত্তার দিকটি গুরুত্ব দিয়ে দেখা।” তাঁর অভিযোগ, “ইদানীং দেখা যাচ্ছে, ব্ল্যাকমেল করতে আধিকারিকদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ দায়ের করার প্রবণতা বেড়েছে। যা খুবই দুর্ভাগ্যজনক।”
দামোদরবাবু জানান, আধিকারিকদের উপরে হামলা হলে তাঁরা ইসিএল কর্তৃপক্ষকে জানান। ঘটনায় সংস্থার কোনও কর্মী জড়িত থাকলে তার বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা পুলিশ-প্রশাসনের উচ্চ স্তরে বিষয়টি লিখিত ভাবে জানানোর আবেদন করা হয়। কোনও শ্রমিক সংগঠন যুক্ত থাকলে, তার উচ্চ নেতৃত্বকে জানানো হয়। আধিকারিকদেরও বোঝানো হয়, তাঁরা যেন কোনও ভাবে পক্ষপাতমূলক কোনও আচরণ না করেন।
এআইটিইউসি-র কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি তথা রাজ্যসভার প্রাক্তন সদস্য রামচন্দ্র সিংহের মতে, “ভুল বোঝাবুঝি থেকে এমন ঘটে। শ্রমিক-কর্মীদের সঙ্গে আধিকারিকদের সমন্বয় বাড়ানো ও সংবেদনশীল হওয়া দরকার।” আইএনটিটিইউসি অনুমোদিত কোলিয়ারি মজদুর ইউনিয়নের নেতা তরুণ গঙ্গোপাধ্যায়ের বক্তব্য, “শ্রমিক সংগঠনগুলিকে দলীয় অনুশাসনের উপরে জোর দিতে হবে। শ্রমিক-কর্মী ও অফিসারদু’পক্ষই আন্তরিক ভাবে এগিয়ে এলে এই সমস্যা মেটা সম্ভব।” |