স্মরণ...
রাজাই শুধু নেই
ডেনমার্কের যুবরাজ ছাড়া যেমন হ্যামলেট হয় না, তেমনি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ছাড়া বুধসন্ধ্যা ভাবা যায় না।
বুধসন্ধ্যা ব্যাপারটা কী? কান থেকে যন্ত্র খুলে এবং ল্যাপটপ থেকে চোখ সরিয়ে জানতে চাইল এক কিশোর। আমি তাকে বললাম, কাকাবাবু কাম সুনীল গাঙ্গুলি একটা ক্লাব বানিয়েছিলেন, বাংলায় যাকে বলে ঠেক, সেই ক্লাবে অনেক টপ টপ সেলিব্রিটি আসত, সমরেশ বসু, সাগরময় ঘোষ, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, সুবিনয় রায়, ড. জয়ন্ত সেন, পূর্ণেন্দু পত্রী, পবিত্র সরকার অনেকে। এঁরা আড্ডা দিতেন। মদ খেতেন (সবাই না), হাসপাতালে গিয়ে সমাজ সেবা করতেন (সবাই না), এঁদেরকে ঘিরে থাকতেন ডাকসাইটে সুন্দরীরা (সবাই না)। কিন্তু কোনও পলিটিক্স ছিল না। ‘আমরা-ওরা’ ছিল না।
আমি যুবরাজকে প্রথম দেখি থিয়েটার রোডের বুধসন্ধ্যায়, শেষ দেখি রাজডাঙ্গায় আমেরিকায় ফিরে না যাওয়া ধ্রুব কুণ্ডুর গেস্ট হাউসে, মাঝখানে আরও খান দশেক অস্থায়ী ঠিকানায়। পৃথিবীর আর কোনও যুবরাজকে এত বার বাড়ি পালটাতে হয়নি। এতগুলো বাড়িতে কাকে আসতে দেখিনি? বুধসন্ধ্যার মেম্বর না হয়েও অতিথি হিসেবে। কিংবা লেখা পড়ে শোনাতে এসেছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, বুধসন্ধ্যার পার্টিতে ওঁর টুইস্ট নাচ দেখেছিলাম দ্বিতীয়বার, প্রথমবার দেখেছিলাম ক্লাস এইটে স্কুল পালিয়ে কৃষ্ণনগরের সিনেমা হলে।
সবাইকে আসতে দেখেছি, দু’জন বাদে। এই দুজন হলেন শঙ্খ ঘোষ, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। অথচ দু’জনের সঙ্গেই সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের আমৃত্যু সম্পর্ক ছিল সুগভীর। শীর্ষেন্দুদা বললেন, “একেবারে যাইনি তা নয়। গিয়ে কী করব? এত লোকজন আমার চলে না। তাছাড়া পানভোজনের পর সবাই যখন ‘হাই’ হয়ে যায়, আমার তখন কিছু করার থাকে না। সুনীল-স্বাতী একবার ধরেছিল নাটক করার জন্য। ওরে বাবা, আমি নাটক করব? আমি ওদের রিহার্সালে গিয়ে দেখেশুনে একটা কভারেজ লিখে দিয়েছিলাম আনন্দবাজারে।” বুধসন্ধ্যা আয়োজিত যে কোনও অনুষ্ঠানে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় মঞ্চে উঠে একটা জিনিস মনে করিয়ে দিতেন, “আমরা ঠাকুরপুকুর ক্যানসার হসপিটালে বেড দিয়েছি, এরকম ভাল কাজ আমরা যেন করে যেতে পারি।”
কলকাতায় থাকলে বুধসন্ধ্যায় আসেননি, এরকম কখনও হয়নি। রাত হয়ে গেলেও আসতেন। একটা দল চালাতে গেলে, তা সে বড়ই হোক আর ছোটই হোক, দলটাকে ভালবাসতে হয়। সেটা ওঁকে দেখে বুঝেছিলাম। অনেক সইতে হয়, মেনে নিতে হয়। সেটা ওঁকে দেখে বুঝতে পারতাম। কৃত্তিবাস-য়ের কবি শরৎ মুখোপাধ্যায়। তিনি একবার দেশ পত্রিকায় বুধসন্ধ্যা নিয়ে যা তা লিখে দিলেন। সবাইকে দেখলাম শরৎদার ওপর খেপে টঙ হয়ে আছেন, কিন্তু সুনীলদা একটার পর একটা সিগারেট খেয়ে গেলেন, একটাও মন্তব্য করলেন না। সেদিন মনে হয়েছিল সুনীলদার ডিএনএ টেস্ট করালে ব্রহ্মার সঙ্গে মিল পাওয়া যাবে। কেননা তার পরেই বুধবারে দেখলাম শরৎদা চলে এসেছেন, দুই বন্ধু মিলে বসে পড়েছেন আসরে।
সাগরময় ঘোষ প্রথম সভাপতি। নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী দ্বিতীয়, পরে সমরেশ বসুও হয়েছিলেন। বাপরে বাপ কী পে ডিগ্রি! আমি নীরেনদাকে বললাম, “আপনি এলেন কেন?” সোজা উত্তর, “সুনীলের জন্য। শিক্ষিত লোকজন একটা জায়গায় বসে দু’দণ্ড কথা কথা বলবে, তার চেয়ে ভাল কী আর হতে পারে? আমরা হাইকোর্টের জজ সাহেব বিমল বসাকের বাড়িতে নাটকের রিহার্সাল দিতাম। ‘প্রাণের প্রহরী’-তে একটা দৃশ্য ছিল আমি সুনীলকে একটা চড় মারব। মঞ্চে আমি হাতটা সুনীলের গাল পর্যন্ত নিয়ে গিয়ে নামিয়ে নিয়েছিলাম। চড়টা মারতে পারিনি।”
বুধসন্ধ্যা-র রজত জয়ন্তী উৎসবে
অনেক হোমড়াচোমড়া লোকের মধ্যে বুধসন্ধ্যার দু’জন হেভিওয়েট সদস্য ছিলেন, যাঁদেরকে আমি সমঝে চলতাম। ভয় পেতাম। মনে হত এই বুঝি ধমক খেতে হবে। একজন সৌমিত্র মিত্র। তখন তাঁকে দেখে মনে হত শুধু বুধসন্ধ্যার গুরুভার নয়, তাঁর কাঁধে যেন বিশ্বভুবনের ভার, লোকের উপকার করতে জানতেন। আর একজন বাদল বসু। ডাকসাইটে প্রকাশক। আমাকে একবার বলেছিলেন, সেটা ছিল বিবেকানন্দ পার্কের আরেক প্রকাশকের বাড়িতে, ভেতরের ঘরে “তোমরা কবিরা হলে এক একটা ঢ্যামনা।” আমার কী দোষ বুঝতে পারছিলাম না। আমি জানতাম, আমার একটাই দোষ। সেটা চন্দ্রদোষ। তারপর একটু থেমে আমার হাত ধরে বলেছিলেন, বাংলা কবিতার স্বার্থে ‘বন্ধু’র সঙ্গে গণ্ডগোলটা মিটিয়ে নাও। আজও সে গণ্ডগোল মেটেনি। মিটবেও না। কোনও কবি কবিতা সংসারে এত সমঝদার ছিলেন না সেই সময়ে। বুধসন্ধ্যায় না গেলে সেটা জানতে পারতাম না। তবে বুধসন্ধ্যার আসল অক্সিজেন সাপ্লায়ার কিন্তু স্বাতীদি। ওই ছোট্টখাট্ট মানবীটি যেন স্বর্গ থেকে বেড়াতে এসেছেন কিছু দিনের জন্য। তাঁর গায়ে কোনও ক্লেদ লাগে না, যেন পুরোটাই পারিজাত। কত মেয়ে যে তাঁর সুনীলকে নিয়ে পালিয়ে যেতে চায়, সেদিকে তাঁর কোনও ভ্রুক্ষেপ নেই। সুনীলদার বহু উপন্যাসের মেয়েরা খুব মায়াবী, খুব নরম, তাঁরা কোনও খারাপ কথা বলেন না, খারাপ কাজ করেন না, ফেমিনিজমও করেন না। শুধু বুধসন্ধ্যার নয়, সারা পৃথিবীর এত মেয়েকে দেখার পরও কী করে সুনীলদা পেরেছিলেন মেয়েকে ভাল করে দেখাতে? সেটা কি স্বাতীদির প্রভাব?
বছর পাঁচেক আগে মুক্তধারা-র রিহার্সাল চলছে। অভিনয় করতে এলেন লালাদা। মানে ‘কোয়েলের কাছে’র লেখক, ‘মাধুকরী’র লেখক বুদ্ধদেব গুহ। তিনি উঠতে গিয়ে পড়ে গেলেন। সে এক মর্মান্তিক দৃশ্য। যেমনি ফরসা টকটকে গায়ের রং, তেমনি ভারী হয়ে গেছে তাঁর শরীর, অসাধারণ কণ্ঠে গেয়ে উঠেছিলেন গান, মানুষটা পড়ে গেলেন সবার সামনে? তখন বুধসন্ধ্যা বসত স্পেশাল ব্র্যাঞ্চের রাস্তায়, শ্রীশিক্ষায়তন কলেজের কাছে দামি একটা হাফ পোড়ো বাড়িতে। আমরা সবাই চিন্তায় পড়ে গেলাম কী হয়, কী হয়, কিন্তু সব চেয়ে গম্ভীর মুখে বসে রইলেন সুনীলদা নিজের বাড়িতে। সব চেয়ে চিন্তিত, সেদিন সব চেয়ে ব্যথিত মুখটার নাম সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। অথচ আমরা জেনে এসেছি লালাদার সঙ্গে সুনীলদার সম্পর্ক ছিল চিরকালই বালি কিচকিচে।
পবিত্র সরকারের ফোন তুললাম, “আপনি কেন এসেছিলেন বুধসন্ধা-য়?” বললেন, “আমাকে নিয়ে এসেছিল প্রমা-র সুরজিৎ। গিয়ে দেখলাম বিখ্যাত লোকেদের দস্যুপনা। বুঝলাম এটা আমার জায়গা নয়। উপাচার্য হওয়ার পরে আর বিশেষ যেতাম না। তবে সুনীল ছিলেন অসাধারণ মানুষ। তাঁর দরজা সবার জন্য খোলা থাকত।”
খুব কম দেখেছি নবনীতা দেব সেনকে। নবনীতাদি এলে একটা বসন্ত নিয়ে আসতেন সঙ্গে, কোনও কোনও মানুষের উপস্থিতিটাই যথেষ্ট। মদ খান না, হইচই করেন না, শুধু আমেরিকা চলে যান, আর চিন থেকে ফিরে আসেন, হাসেন খুব অদ্ভুতভাবে, যেন ব্যঙ্গমির হাসি, ঈষৎ ভাঙা গলায়। নবনীতাদি নিজেই একটা কোম্পানি খুলে বসলেন, মেয়েদের কোম্পানি, নাম দিলেন ‘সই’। সেটার এখন বেশ রমরমা। সব নামকরা লেখকরা সই-য়ের সদস্য। মেয়ে-লেখক বললে ওরা আমাকে মারবে, তাই লেখক বললাম, নো জেন্ডার। সবাই নবনীতাদির বাড়িতে আড্ডা দিতে আসেন, হিন্দুস্থান পার্কের সেই বিখ্যাত বাড়িতে, রাধারানি দেব-নরেন্দ্র দেবের বাড়িতে, যে বাড়ির জামাই অমর্ত্য সেন।
দেশিকোত্তম প্রাপ্তির পর সাগরময় ঘোষকে সম্মান ‘বুধসন্ধ্যা’র
সেবার গোয়া গিয়েছিলাম আমরা, সাহিত্য একাডেমির একটা অনুষ্ঠানে। আমি, মল্লিকা, স্বাতীদি, কেদারনাথ সিংহ, প্রফেসর নুর রাও, আমরা অনেকে। সুনীলদার ঘরে বসল সন্ধ্যা আটটা থেকে আড্ডা। সেই আড্ডা যেন একটা ছোট্ট ভারতবর্ষ, বিভিন্ন ভাষার কবি লেখক এসে আড্ডায় বসে পড়ছেন, ঘরটাও বড় হয়ে চলেছে, খাদ্যপানীয়র কোনও অভাব পড়ছে না। রাত দেড়টার সময় আমি আর মল্লিকা উঠলাম নিজেদের ঘরে ঘুমোতে যাব বলে, আমি যেতে যেতে উচ্চকণ্ঠে বললাম, “সুনীলদা আজ বুধবার ছিল। গোয়ায় বুধসন্ধ্যা হল। সুনীলদা দরজা পর্যন্ত এগিয়ে এলেন, বললেন, শোনো তোমরা একটা লেখার টেবিলের ব্যবস্থা করতে পারো? আমার ঘরে সব আছে শুধু ওটা নেই। পরের দিন দুপুর বারোটায় ব্রেকফাস্ট করতে গিয়ে শুনি সকাল সাতটা থেকে লিখে ১০/১২ পাতা দেশ পত্রিকার দফতরে ফ্যাক্স করে পাঠিয়ে দিয়েছেন। এই সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে আমি কোনও দিন ভুলব না।
গোয়া থেকে ফিরে মল্লিকা ’১১ সালে চলে গেল, ’১২ সালে নবমী নিশির মতো সুনীলদা চলে গেলেন। আমি স্বাতীদিকে বললাম, “মনে আছে কী ভাবে শুরু করেছিলেন বুধসন্ধ্যা?” স্বাতীদির স্পষ্ট মনে আছে, “আমরা পানশালায় বসেছিলাম। হঠাৎ ঠিক হল, একটা ক্লাব করলে কেমন হয়। কবি লেখক গায়ক বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে? ড. ধ্রুব ব্যানার্জি, তক্ষুনি একটা নাম দিলেন বুধসন্ধ্যা। এলেন আরও দু’জন ডাক্তার জয়ন্ত সেন, শৈবাল গুপ্ত।” আমি বললাম, “সেটা ছিল সোনার যুগ। সাগরময়, সমরেশ বসুদের যুগ। তার পরেও সুনীলদা ধরে রাখতে পেরেছিলেন। কিন্তু সুনীলদা থাকতে থাকতেই শেষ দিকে বুধসন্ধ্যা-র মান পড়ে যায়। এখন কী অবস্থা?” স্বাতীদি দ্বিধাহীন কণ্ঠে স্বীকার করে নিলেন, “এখন ডিক্লাইন চলছে।”
একজনের কথা না বললেই নয়। বুধসন্ধ্যা-র সাবলটর্ন। অথচ পরিষ্কার জুতো জামা পরা সরকারি অফিসে কর্মরত সদা হাস্যময় যুবক সবার হাতে হাতে মদের গ্লাস ধরিয়ে দিত। কেউ তাকে এ কাজ দেয়নি, সে নিজেই দায়িত্ব নিয়েছে, তাকে আমি কুড়ি বছরে একবারের জন্যও মুখে মদ দিতে দেখিনি। আমি অনেক ভেবেছি, কেন সে টেন্ডারের কাজটা করত? উত্তর একটাই, সুনীলদাকে ভালবেসে। এই ভালবাসা সব লেখকের কপালে থাকে না। মুখে সবাই বলত, সুনীলদাকে ভালবাসি। পান থেকে চুন খসলেই সুনীলদার নামে তারাই বাজে কথা বলেছে বুধসন্ধ্যার ব্যালকনিতে। কারও হয়তো লেখা ছাপা হল না, কারও হয়তো সে বছর পুরস্কার ফসকে গেল, কেউ হয়তো সামান্য কবিতা পড়ার সুযোগ পেল না, অমনি ফোঁস। ছোটরাও করেছে, বড়রাও ছেড়ে দেয়নি। আজ সেই বুধসন্ধ্যা আর নেই। চাক ভাঙা মধু শেষ হয়ে গেছে। এখন শুধু মোম পড়ে আছে। আজ মৃত্যুর পর প্রথম জন্মদিন, দিগন্ত থেকে ভেসে আসছে সুনীলদার কণ্ঠে কবিতা পাঠ ভ্রুপল্লবে ডাক দিলে দেখা হবে চন্দনের বনে।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.