|
|
|
|
|
|
|
বেড়ানো... |
|
যেতে পারেন কিন্তু কোথায়... |
চার দিন পরেই খুলছে কেদার মন্দির। এই মাসের শেষ দিকে গঙ্গোত্রী, যমুনোত্রীর রাস্তা। সত্যি কি
আর বাধা নেই পুজোয় উত্তরাখণ্ড ভ্রমণে? সদ্য গাঢ়ওয়াল থেকে ফিরে লিখছেন গৌতম চক্রবর্তী |
এই সেই দেবতাত্মা হিমালয়ের পুণ্যপথ? ফি বছর পুজোর ছুটিতে এই রাস্তা বেয়েই কেদার, বদ্রীতে তীর্থ করতে আসে বাঙালি?
এত ক্ষণে কান্না পাচ্ছে। মনে হচ্ছে, অহেতুক ঝুঁকি না নিলেই হত। রুদ্রপ্রয়াগের অতিরিক্ত জেলাশাসক রাঘব ল্যাঙ্গার প্রায় আঁতকে উঠেছিলেন, “ওই রাস্তা? রুদ্রপ্রয়াগ টু কুণ্ড ইজ ভেরি ক্রিটিক্যাল এরিয়া।”
ক্রিটিক্যাল এরিয়া? এই রাস্তায় কত বার গিয়েছি! কুণ্ডের ব্রিজ পেরিয়ে গেলেই ও পারে শোনপ্রয়াগ। তার পর সীতাপুর, ফাটা পেরিয়ে গৌরীকুণ্ড। শুরু হত কেদারের হাঁটা পথ।
আর, ব্রিজ থেকে ডান দিকে ঘুরে গেলেই উখীমঠ। তার পর চোপতা, চামোলি পেরিয়ে সটান জোশীমঠ, বদ্রীনারায়ণ। পুজোর ছুটিতে কেদার-বদ্রী দর্শনে আসা আবাল-বৃদ্ধ-বনিতার রাস্তা ছিল এটাই। শুধু কেদারদর্শনেই সব হয় না, দীপাবলির পর কেদারের রাজছত্র নেমে আসে এই উখীমঠে। অক্ষয়তৃতীয়া অবধি পুরো শীত-বসন্ত জুড়ে তাঁর পুজো এইখানেই।
পঞ্চকেদারগামী বাঙালি ট্রেকারের কাছেও অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিন্দু এই উখীমঠ। এখান থেকেই টানা তিন দিনের চড়াই বেয়ে হাঁটতে হাঁটতে চৌখাম্বা শৃঙ্গের নীচে মদমহেশ্বর। কখনও বা চোপতা হয়ে হাঁটতে হাঁটতে উচ্চতম কেদার তুঙ্গনাথ। ১৭ জুনের ভয়াবহ বন্যায় কেদার মন্দিরের চারপাশ বা গৌরীকুণ্ড ধ্বংস হয়ে গিয়েছে বলে এই জায়গাগুলিও আর থাকবে না?
জবরদস্ত ট্রেকিং দরকার নেই, উখীমঠ পেরিয়ে সারিগ্রামের রাস্তা ধরে এক-দেড় ঘণ্টা হাঁটলেই পৌঁছানো যেত ঝকঝকে নীল জলের দেওরিয়া তাল। গাঢ়ওয়ালের মিথ, চাঁদনি রাতে দেবতারা স্বয়ং স্নান করতে আসেন এই সরোবরে। বাঙালি, গাঢ়ওয়ালি দূর অস্ত। ইন্দিরা গাঁধীও কত বার যে মুগ্ধ হয়েছেন উখীমঠের পর দোগলভিটার আরণ্যক সৌন্দর্যে! বিপর্যয়ের তিন মাস কেটে যাওয়ার পরেও পৌঁছানো যাবে না সেই সুন্দরের দেশে?
হরিদ্বারের লোকেরা অবশ্য পইপই করে বারণ করেছিলেন। সেখান থেকে কুণ্ড মাত্র ২১০ কিমি। কিন্তু আজকাল গাড়ি যাচ্ছে চামোলি ঘুরে। তাতে দূরত্ব বেড়ে প্রায় সাড়ে তিনশো কিমি। “উপায় নেই। রিলিফের লরিও ওই রাস্তায় ঢুকছে না,” বলছিলেন ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের দিলীপ মহারাজ।
অগস্ট মাসের শেষ মঙ্গলবার বিকেলে রুদ্রপ্রয়াগ পৌঁছে শোনা গেল, রাস্তা খুলেছে। তা হলে আর অহেতুক ১৫০ কিমি বাড়তি ঘুরব কেন? শোনা গেল, কুণ্ডের ব্রিজ এখনও মেরামত করা যায়নি। রাস্তার অবস্থাও তথৈবচ। টানা বর্ষা, যত বার বোল্ডার সরানোর চেষ্টা করা হয়, তত বারই পরদিন ধস নামে। এই আছে তো পরক্ষণেই গেল গেল। কিন্তু বর্ষায় বাইপাস, বেহালার নদীখাত পেরিয়ে যাকে নিত্য যাতায়াত করতে হয়, সেই কলকাতার ছেলে এতে ভয় পাবে কোন দুঃখে?
অগত্যা সহকারী জেলাশাসকের সতর্কবার্তা অগ্রাহ্য করে গাড়ি নিয়ে কুণ্ডের রাস্তায়। হরিদ্বার থেকে রুদ্রপ্রয়াগের এই ১৭০ কিমি রাস্তাই বা কী এমন কম? হৃষীকেশ, লছমনঝুলা ছাড়াতেই চিরাচরিত বোর্ড, ‘দেবভূমিপে আপকা হার্দিক স্বাগত’। দেবভূমিই বটে! লছমনঝুলার পরে শিবপুরীর খ্যাতি ছিল র্যাফটিং-য়ের জন্য। সার সার রাবার বোট, সাইবারকাফে, হোটেল, মেডিটেশন ক্যাম্প নিয়ে জমজমাট থাকত এই জায়গা। এখন শুধুই নিস্তব্ধ জনপদ। র্যাফটিংওয়ালারাও নদীতে নামার সাহস হারিয়েছে।
দেবপ্রয়াগের পাশে, নদীখাতে চাকা উল্টে চিৎপাত আস্ত এক ট্রাক। কীর্তিনগরে রাস্তার নীচে, ধু ধু বালিতে পড়ে থাকা টিন। বালি, মানে নদীর জলস্তর ওই অবধি, প্রায় ৫০ ফুট লাফিয়ে পলি ফেলে এসেছে। টিন মানে, একদা ঘরের চালা।
মানুষ নেই, বসতি নেই, শুধু ধ্বংসের চিহ্ন। শ্রীনগরে রাস্তার পাশেই ছিল আইটিআই। একতলার পুরোটা মাটিতে বসে গিয়েছে, মাত্র কয়েক ফুট জেগে।
হৃষীকেশ অবধি তাও ঠিক ছিল। তার পরই যত এগোচ্ছি, জায়গায় জায়গায় বোল্ডার সরানোর মেশিন, সিমেন্ট আর মর্টার মেশানোর মিক্সার, পে-লোডার,
বুলডোজার। মাঝরাস্তায় বিশাল পাথরের চাঁই, উপচে-পড়া গাছ। হয়তো দু’ দিন আগেই রাস্তা ঠিক হয়েছিল, তার পর গত রাতের বৃষ্টিতে ফের পাহাড় ভেঙেছে। কয়েক কিমি অন্তর নতুন নীল বোর্ডে তাই সেনাবাহিনীর সতর্কবার্তা, ‘স্লাইডিং এরিয়া অ্যান্ড রকফল জোন অ্যাহেড’।
ধস আর ঝুরো মাটি বেয়ে পাথর পড়ছে, সঙ্গে বৃষ্টি। সকালে হরিদ্বার থেকে যখন বেরিয়েছি, চার দিক রোদ্দুরে খটখটে শুকনো। হৃষীকেশ পেরিয়ে মুনি-কি-রেতি, শিবপুরী, ব্যাসী...যত এগোচ্ছি, টিপটিপ বৃষ্টি। দেবপ্রয়াগে চা খাচ্ছিলাম, দোকানি উদাস স্বরে জানালেন, “কাল রাত থেকে নেমেছে। যত উপরে উঠবেন, আরও পাবেন।” দু’দিন আগে হরিদ্বারের এক ব্যবসায়ীও বলছিলেন, “এ বার যত ক্লাউড বার্স্ট হচ্ছে, আগে দেখিনি।” বৃষ্টিতে তামাম গাঢ়ওয়াল এখনও চমকে ওঠে।
ধ্বংসের মধ্য দিয়ে এত দূর যাত্রার পর কুণ্ডের রাস্তা নতুন কি দেবে? একটু এগোতেই বোঝা গেল, ব্যাপারটা ভয়ঙ্কর। অর্ধেক রাস্তা মন্দাকিনীর গ্রাসে, ১২ ফুট চওড়া রাস্তা এখন মেরেকেটে পাঁচ-সাত ফুট। সেই ভাঙা রাস্তা বেয়ে বালির উৎরাই নেমে গিয়েছে নদীর পাশে। কোনও ক্রমে ব্রেক চেপে গড়িয়ে নামা, নদীর জলের ঝাপটা ছিটকে আসছে চোখে। সামান্য অসতর্ক হলেই ছিটকে নদীর স্রোতে। ওই ভাবেই কাদা আর বালি বেয়ে ফার্স্ট গিয়ারে কোনও ক্রমে ওঠা, বারে বারেই পিছলে যাচ্ছে গাড়ির চাকা! আরে, এটাই তো চন্দ্রপুরী!
এখানে গাঢ়ওয়াল মণ্ডল বিকাশ নিগমের একটা বাংলো ছিল না? নদীর ধারে চমৎকার হনিমুন স্পট। সেই বাংলোর অস্তিত্ব নেই, পুরোটাই মন্দাকিনীর গ্রাসে।
চন্দ্রপুরী নেই, সিয়ালসোর নেই। দিন কয়েক আগে দেখে এলাম, বদ্রীর রাস্তাতেও এক গল্প। বিরহীতে, অলকানন্দার ধারে নিগমের একটা বাংলো ছিল। সেখানেও শূন্যতা, পাড় ভাঙছে নদী। আগে ভাগীরথী, অলকানন্দা আর মন্দাকিনীর স্রোত আলাদা ভাবে চেনা যেত। কোনওটার জল একটু নীল, কারও বা পান্না-সবুজ। এ বার সর্বত্র রাক্ষুসে ঘোলা জল।
বাড়িগুলি ভেঙে চৌচির। কোনও কোনও দোতলা বাড়ির ছাদ উড়ে গিয়েছে, দেওয়াল জুড়ে ফাটলের আঁকিবুকি। একটা ফাটলওয়ালা বাড়ি নদীর ধারে হেলে পড়েছে, যে কোনও মুহূর্তে মুখ থুবড়ে পড়বে। এখানেই কাকড়াগাদে ছিল যশপাল সিংহ নেগির বার্ড ওয়াচিং ক্যাম্প। তামাম ভারতের পক্ষীপ্রেমিকরা ম্যাগপাই, রবিন ও অন্যান্য পাখি দেখতে জড়ো হত সেখানে। রেস্তোরাঁ, বার্ড মিউজিয়াম ইত্যাদি নিয়ে সেই দোতলা বাড়ি আর নেই। দূরে এক পাশে চিৎপাত হয়ে একটা পে-লোডার। নদীর জল প্রায় কাপড় কাচার মতো আছড়ে ছুড়ে ফেলেছে সেই যন্ত্রদানবকে।
অগস্ত্যমুনি ছাড়িয়ে দেখা গেল, এক জায়গায় নদীর জলে নেমে এসেছে পাহাড়ি অরণ্য। নদী বয়ে যেত পাহাড়ের পাশ দিয়ে। সেই পাহাড়ের গায়েই ছিল বার্চ, পাইনের এই জঙ্গল। জলের তোড় মাটি এমন ভাবে ধসিয়ে দিয়েছে যে গাছপালা নিয়ে আস্ত পাহাড়টা আছড়ে পড়েছে মন্দাকিনীর বুকে। ইরাক, আফগানিস্তানের মতো বোমায় বিধ্বস্ত হয়নি ঠিকই কেদারগামী এই জাতীয় সড়ক। কিন্তু জল এখানে সব কিছু নিয়ে দুমড়েমুচড়ে খেলা করেছে।
ভাঙা রাস্তায় গাড়ি এক বার এ দিক, এক বার ও দিক। মাঝে মাঝেই ধাক্কা খেতে হচ্ছে মাটিতে পড়ে-থাকা পাথরের চাঁইয়ে। কেন যে মরতে এলাম! কলকাতায় বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন সবাই চমকে উঠেছিল, ‘গাঢ়ওয়াল? পাগল নাকি!’ কেন যে ছেলেবেলায় শুভানুধ্যায়ীদের কথা শোনা প্র্যাকটিস করিনি!
রাত আটটায় পৌঁছানো গেল উখীমঠ! চারদিক অন্ধকার। সারা গাঢ়ওয়ালে এক গল্প। হরিদ্বার, হৃষীকেশ প্রতিটি জায়গাতেই দু’ তিন ঘণ্টা নিষ্প্রদীপ। কোথাও ঝড়ে তার ছিঁড়ে পড়ছে, কোথাও বা রাস্তায় বসানো ট্রান্সফর্মার এখন নদীর সামনে। মেরামতির জায়গা ধসে নদীতে। ভাগীরথী থেকে মন্দাকিনী, অলকানন্দা কোনও নদীতেই জলবিদ্যুৎ প্রকল্প করতে ছাড়েনি যে রাজ্য, সেখানে অন্ধকার! তিন মাস পরেও দেখছি, দেবতার রোষ পুরো কাটেনি।
রোষ মানে? অন্ধকার উখীমঠের সামনে গুপ্তকাশীর পাহাড়ের আলো। দুটো জায়গার মধ্যে দূরত্ব বেশি নয়, মাত্র ১৭ কিমি। কিন্তু রাস্তা ভাঙা। ফলে ১৭ কিমি পাড়ি দিতে গাড়িকে প্রায় ১০০ কিমি ঘুরে অন্য পাহাড় বেয়ে যেতে হচ্ছে। সকালবেলায় উখীমঠের মহকুমাশাসক রাকেশচন্দ্র তিওয়ারি জানালেন, জেলাশাসকের সঙ্গে বৈঠক করতে তিনি গুপ্তকাশী যাচ্ছেন। ভাঙা রাস্তায় ট্রেক করবেন। ‘বঙ্গালকা পত্রকার’ ইচ্ছে করলে তাঁর সঙ্গী হতে পারেন। পরে অযাচিত প্রস্তাবের কারণ জেনে শিউরে উঠেছিলাম। জুন মাসের বিপর্যয়ের পর হরিদ্বার থেকে কুণ্ড দিয়ে নাকি উখীমঠে প্রথম এল আমার গাড়িটাই। কৃতিত্ব অবশ্যই চালক, হরিদ্বারের যুবক তপন দেবনাথের।
তপনবাবুও কেদার-বিপর্যয়ের সাক্ষী। ১৫ জুন সকালে হরিদ্বার থেকে মা, ছেলে, জেঠা, জেঠির চার দলের এক পরিবারকে নিয়ে রওনা দিয়ে বিকেলে পৌঁছেছিলেন গৌরীকুণ্ড। অক্ষয় তৃতীয়ার সিজনে তখন গৌরীকুণ্ডে পার্কিং-এর জায়গা মেলেনি। অগত্যা যাত্রীদের নামিয়ে তিনি চলে যান সীতাপুর। কথা ছিল, পর দিন যাত্রীরা কেদার যাবেন। ১৭ তারিখ নেমে ড্রাইভারকে ফোন করবেন। তার আগে ১৬ তারিখ রাতেই নদী ফুঁসে ওঠে। ব্রিজ ভেঙে, গৌরীকুণ্ডের পার্কিং লটে থাকা গাড়িগুলিকে মোচার খোলার মতো ভাসিয়ে নিয়ে যায়। সীতাপুর গ্রামটা গৌরীকুণ্ডের তুলনায় উঁচু, নদীর অনেকটা ওপরে পাহাড়ের ঢালে ছিল বলে বেঁচে যায়। তপনবাবুর সেই যাত্রীদের ফোন আর আসেনি, তাঁকে মিসিং ডাইরি করতে হয়।
কত জনই যে সে দিন এই ভাবে চিরতরে হারিয়ে গিয়েছেন! উখীমঠের ভারত সেবাশ্রমের ধর্মশালায় দেখলাম ফুটফুটে বাচ্চা বিজয় তিন্ডোরিকে। আশ্রমের স্কুলে নার্সারিতে পড়ে, তার বাবা-মা-দাদা সহ গোটা পরিবার ভেসে গিয়েছে। “এ রকম ৪০টি বাচ্চা এখানেই থাকে, ওদের থাকা-খাওয়া-পড়াশোনা আমরা ফ্রি করে দিয়েছি,” বলছিলেন আশ্রমের সুধীর মহারাজ। উখীমঠের মহকুমাশাসক এখনও শিউরে উঠছেন। সে দিন তিনিও কাজের খাতিরে কেদারে। বৃষ্টির মধ্যে আচমকা নদীগর্জন, সব অন্ধকার। মহকুমাশাসক কন্ট্রোল রুম থেকে বেরিয়ে আসেন, প্রবল তোড়ে জল-কাদা-নুড়িপাথর মেশানো ‘মালবা’য় ভেসে যেতে থাকেন। কোনও ক্রমে মন্দিরের রেলিং আঁকড়ে বেঁচে যান। তত ক্ষণে শঙ্করাচার্যের সমাধি শেষ, ভারত সেবাশ্রমের বাড়িটাও তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়েছে। “সেলফোন, ওয়াকি কিছুই কাজ করছিল না,” বলতে বলতে শিউরে উঠলেন তিনি।
গাঢ়ওয়াল এখনও এই রকম। চার দিকে শুধুই বিপর্যয়ের ট্রমা। কিন্তু পর্যটন-নির্ভর এই রাজ্যে মন্ত্রীরা আশা ছাড়ছেন না। মুখ্যমন্ত্রী বিজয় বহুগুণা থেকে পর্যটনমন্ত্রী অমৃতা রাউত সকলে আশ্বাস দিচ্ছেন, বর্ষাশেষে সেপ্টেম্বরে সব ঠিক হয়ে যাবে। মন্ত্রীরা তারিখ স্থির করেও দিয়েছেন। আর চার দিন পর, ১১ সেপ্টেম্বর পূজারিরা খুলে দেবেন কেদার মন্দিরের দ্বার। ৩০ সেপ্টেম্বর খুলে দেওয়া হবে গঙ্গোত্রী, যমুনোত্রীর রাস্তা। সেই ডেটলাইন মেনেই এখন রাস্তায় রাস্তায় মানুষ বনাম প্রকৃতির ২৪×৭ ঘণ্টার অসম যুদ্ধ। এক দিকে নাছোড় বৃষ্টি, অন্য দিকে গুপ্তকাশীর হেলিপ্যাড থেকে উড়ছে সেনাবাহিনীর ‘এম আই ১৭’ হেলিকপ্টার। কেদারনাথের রাস্তা ঠিক করতে লোহার বেইলি ব্রিজের অংশ পাঠানো হচ্ছে সেই চপারে।
প্রশাসন প্রাণপণ লড়ছে, কিন্তু সাধারণ মানুষের মাথায় হাত। ঘোড়া, খচ্চর থেকে গাড়ি...সবই ভাসিয়ে নিয়েছে নদী। হরিদ্বার, হৃষীকেশের হোটেলওয়ালারা দুশ্চিন্তায়। কলকাতার ট্রাভেল এজেন্সিগুলি পুজোর বুকিং বাতিল করে দিয়েছে। সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে বাঙালি পর্যটকরাই তো গাঢ়ওয়ালের লক্ষ্মী।
গাড়িওয়ালারা ফুঁসছেন। জুন মাসে, গঙ্গোত্রীর রাস্তায় যে গাড়িগুলি আটকে গিয়েছিল, সেগুলি এখনও সেখানেই। মাঝরাস্তায় হরশিল, ভাটোয়ারি জায়গাগুলি আজও ঠিক হয়নি। কর্ণপ্রয়াগ থেকে নারায়ণবগড় হয়ে গোয়ালদাম, কৌশানি, আলমোড়া, রানিখেতে ঢুকে যায় একটা রাস্তা। গাড়োয়াল-কুমায়ুন পাহাড়ের সেই যোগসূত্রও ভেঙে চৌপাট। বদ্রীনারায়ণের ভারত সেবাশ্রম থেকে সন্ন্যাসীরা নীচে হরিদ্বার, কলকাতা চলে এসেছেন। যাত্রী নেই, উপরন্তু জোশীমঠের পর তিন কিমি গাড়ি যাচ্ছে না, পয়দল-মার্গই ভরসা। যুদ্ধকালীন তৎপরতায় বদ্রীগামী ওই জাতীয় সড়ক মেরামতে ব্যস্ত সেনাবাহিনী। বদ্রী, মানাগ্রাম পেরিয়ে ওই রাস্তাই সটান চলে গিয়েছে চিন সীমান্তে। উত্তরাখণ্ড পর্যটন উন্নয়ন বোর্ডের যুগ্ম সচিব অজিত সিংহ আশাবাদী, “রাস্তা নিশ্চয় ঠিক হবে। আর হরিদ্বার, হৃষীকেশ, দেরাদুন, মুসোরি, নৈনিতাল, ল্যান্সডাউন, পাউরি, খিরসু আরামসে বেড়ানো যাবে।”
কথাটা মিথ্যে নয়। এখনও হরিদ্বারে বিড়লাঘাট, বিষ্ণুঘাট, মোতিবাজার হয়ে হর কি পৌরীর রাস্তাটা সেই এক রকম। সাতটা ‘দাদা-বউদি’, তিনটে ‘প্রাচীন মথুরাওয়ালা’, দু’ধারে ছোট ছোট তামা, পিতলের বাসন, ল্যাব-টেস্টেড একমুখী রুদ্রাক্ষ, নবরত্নমালা, ১৫০ টাকার সোয়েটারের উপচে-পড়া পসরা। বাংলাদেশী রসনার লইট্যা মাছের ভর্তা যদি ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের দু’ধারে সাম্রাজ্য বিস্তার করে, পশ্চিমবঙ্গের আলুপোস্ত, ধোকার ডালনা, বড়ি-বেগুনের ঝোল অশ্বমেধের ঘোড়া ছুটিয়েছে এই সব দাদা-বৌদির দোকানে। এখনও হর কি পৌড়ীর ঘাটে সন্ধ্যারতির সময় ষাঁড়, তীর্থযাত্রী, সন্ন্যাসী, দেশি-বিদেশি ট্যুরিস্ট, কুষ্ঠরোগী, বাইক আর সাইকেলের থিকথিকে ভিড়। গঙ্গায় ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে লক্ষ প্রদীপের মালা। হরিদ্বার আছে হরিদ্বারেই!
তাল কেটেছে দুই জায়গায়। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা সর্বভারতীয় মিডিয়ার ওপর তুমুল ক্ষুব্ধ। বিপর্যয়ের পর টিভি এবং খবরের কাগজে বারংবার দেখানো হয়েছে, গঙ্গার স্রোতে ভেঙে গিয়েছে হরিদ্বারের শিবমূর্তি। ঘটনা, হরিদ্বারের শিবমূর্তি অটুট। ভেঙেছে হৃষীকেশের ‘পরমার্থ নিকেতন’-এর মূর্তি। মিডিয়ার বয়ানে নাকি মনে হয়েছে, হরকি পৌরী, বিষ্ণুঘাটেও গঙ্গার স্রোতে ভেসে এসেছে শব। কিন্তু যে তিনটি মৃতদেহ, খান কয়েক গ্যাস সিলিন্ডার স্রোতে নাকানিচোবানি খেতে খেতে ভেসে যাচ্ছিল, তা চণ্ডী পাহাড়ের নীচে নীলধারায়। “হরিদ্বার ঠিক ছিল, আখবরওয়ালারাই সর্বনাশ ঘটাল,” আফশোস করছিলেন বিষ্ণুঘাটের ব্যবসায়ী সন্দীপ গুপ্তা।
তাল কেটেছে গানেও! হরিদ্বারে গঙ্গার ঘাট থেকে মনসা পাহাড়ের নীচে ইলেকট্রনিক গুডসের দোকান, সর্বত্র স্থানীয় ডিভিডিতে সাধারণত একই গান বাজে। ‘গঙ্গা মাইয়া যব তক তেরি পানি রহি’ কিংবা ‘হর হর গঙ্গে’। এ বার প্রতিটি দোকানে বাজছে গাঢ়ওয়ালি গায়ক প্রেম মেহরার ‘বম বগড় করেঙ্গে।’ নিউজ ক্লিপিংস থেকে কম্পিউটার গ্রাফিক্সে তৈরি সেই ভিডিয়োতে বন্যায় খড়কুটোর মতো ভেসে যাচ্ছে গাড়ি, ধসে পড়ছে বাড়ি। গানেই বলা হচ্ছে, শিব ‘বগড়’ বা তাণ্ডব করেছেন কেন! কিছু লোক এই পুণ্যধামে এসে মদ-মাংস খায়। বারণ করা সত্ত্বেও সরকারি নির্দেশে কিছু লোক ধারি দেবীর মূর্তি উঠিয়েছে। শ্রীনগর ছাড়িয়ে, কালিয়াসোরে অলকানন্দা নদীতে ছিল ধারি দেবীর মন্দির। শ্রীনগরে নতুন জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরি হচ্ছে। সেটি চালু হলে ওই জলাধারে মন্দির ভেসে যাবে। ফলে ইঞ্জিনিয়ারেরা নদীতে পিলার গেঁথে নতুন এক টিনের চালা তৈরি করেন। বারংবার বারণ করা সত্ত্বেও ক্রেন দিয়ে মূর্তিটি উঠিয়ে সেই নতুন চালাঘরে বসানো হয়। ১৬ জুন সকাল ৯টা নাগাদ কাণ্ডটি ঘটে, তার পর রাতেই বৃষ্টি এবং কেদারনাথে বিপর্যয়। ‘চেন্নাই এক্সপ্রেস’ বা ‘ইয়ে জওয়ানি হ্যায় দিওয়ানি’র চেয়েও গাঢ়ওয়ালে এখন বেশি জনপ্রিয় এই গান।
দেবভূমির এই নতুন দেবীকে দর্শন করা যায় না? রুদ্রপ্রয়াগ-গামী জাতীয় সড়ক থেকেই চোখে পড়ছে নদীর ওপরে পিলার বসিয়ে লাল টিনের চালা। ধাপে ধাপে সিঁড়ি নেমে গিয়েছে সেখানে, নদীর মাঝে মন্দিরে পৌঁছানোর জন্য বসানো হয়েছে লোহার সেতু। মূর্তি নয়, লাল চেলিতে ঢাকা কালো পাথরের এক ট্রাইবাল দেবীমুখ। নাকে সোনার নোলক, মাথায় রুপোর মুকুট ও রাজছত্র। স্থানীয়রা এই দেবীকে জানতেন, দু একটি গাড়ির গায়ে লেখা ‘জয় মা ধারি দেবী’। কিন্তু প্রেম মেহরার মিউজিক ভিডিয়ো-ই আসন্ন টুরিস্ট সিজনে তাঁকে সর্বভারতীয় পরিচিতি দিতে চলেছে। জনপ্রিয়তা পেতে এক সময় ‘জয় সন্তোষী মা’ থেকে ‘বাবা তারকনাথ’ সকলে সিনেমাকে বাহন করেছেন। এ যুগের ধারী মাতা বেছে নিলেন মিউজিক ভিডিয়ো।
বাঙালি বিপদতারিণীর মতো এখানেও হাতে লাল-হলুদ সুতোর তাগা পরিয়ে দিলেন পুরোহিত। ছবি নিতে যাচ্ছিলাম, তিনি হাঁ হাঁ করে বারণ করলেন, ‘‘মা এখন খোলা জায়গায়। ফলে, ঘরে বন্দি করলেই রেগে যাচ্ছেন।’’ খান দশেক বাঁধানো ফটোগ্রাফ বের করে দেখালেন তিনি। বিপর্যয়ের পর উৎসাহী অনেকে এসে ছবি তুলে, সেটি বাঁধিয়ে বাড়িতে পুজো করছিল। তার পর রুষ্ট দেবীর এমন স্বপ্নাদেশ হয়েছে যে বাপ বাপ বলে ছবি ফেরত দিয়ে গিয়েছেন। এই জন্যই বাজারে কেদার, বদ্রীর ছবি থাকলেও তাঁদের আসল শক্তি ধারী দেবীর কোনও ছবি পাওয়া যায় না। সঙ্গে সঙ্গে ক্যামেরা ঢুকিয়ে নিলাম ব্যাগে। তুচ্ছ সাংবাদিকতার দায়ে দেবীর রোষে পড়ার ঝুঁকি নেবে কোন মূর্খ!
কেদার-বদ্রীর ভাঙা রাস্তার শেষে ফিরতি পথে দেহরাদূন হয়ে মসুরি। কুয়াশাঘেরা আবহ, মেঘ উড়ে যাচ্ছে দেওদার গাছের ফাঁকে। গাঢ়ওয়ালে এই যাত্রায় প্রথম মিঠে ঠান্ডার অনুভূতি। ক্যামেল্স ব্যাক রোডে ওয়েলহ্যাম বয়েজ স্কুল, উডস্টক স্কুলের ছেলেমেয়েরা হস্টেলে ফেরার পথে স্টিক জ, হোমমেড চকোলেট কিনতে ভিড় জমিয়েছে। বৃষ্টি পড়ছে। কিন্তু এই হাল্কা পাহাড়ি বৃষ্টিতে আতঙ্ক নেই, রয়েছে মেদুর আশ্বাস। হিমাচলের সিমলা রাজধানী শহর, গায়েগতরে কুৎসিত ভাবে সেখানে বেড়েছে কংক্রিটের জঙ্গল। দার্জিলিঙের মেজাজ ব্লাড প্রেশারের রোগীর মতো, কখন চড়ে যাবে ঠিক থাকে না। মসুরির সেই ঝামেলা নেই। সেখানে রাজা-মহারাজা, সাহেবসুবোরা শুধুই মজা করতে আসতেন, রাজধানী হওয়ার জগদ্দল পাথর তার ঘাড়ে আজও কেউ চাপায়নি। সাধে রাস্কিন বন্ডের মতো লেখক, ভিক্টর ব্যানার্জির মতো অভিনেতা বা প্রণয় রায়ের মতো সাংবাদিক এখানেই থেকে যান! ভারতে যদি কোথাও সঠিক হিলস্টেশন থাকে, তা এইখানে, এইখানে, এইখানে! “এই দিকে তেমন প্রভাব পড়েনি। কিন্তু ঘটনাটা ভাবলে এখনও মন খারাপ হয়ে যায়,” তাঁর কটেজে বসে বললেন রাস্কিন বন্ড। অসুস্থ শরীরেও স্মৃতিকথা লেখায় ব্যস্ত তিনি, আগামী বছরেই পেঙ্গুইন ইন্ডিয়া থেকে প্রকাশ পেতে পারে সেই বই। সেই লেখায় কি আসবে এই সব প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কথা? “এখনও ভাবিনি। আসলে বিপর্যয়েই সব শেষ নয়। তার পরও নতুন চারা জন্মায়, পাখিরা আকাশে ওড়ে। গাঢ়ওয়ালও দেখবে, ঠিক বেঁচে উঠবে। নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে পড়বে। এটাই জীবনের নিয়ম,” হাসলেন লেখক। মনে ভেসে এল ওঁর বহুপঠিত, জনপ্রিয় এক বইয়ের নাম। ‘আওয়ার ট্রিজ স্টিল গ্রোজ ইন দেহরা’। দূন উপত্যকায় আমাদের গাছেরা এখনও বেড়ে ওঠে! |
|
|
|
|
|