|
|
|
|
|
|
|
মনোরঞ্জন... |
|
জোড়া হাফ সেঞ্চুরি |
সুচিত্রা সেনের। এ বছর ‘উত্তর ফাল্গুনী’, ‘সাত পাকে বাঁধা’-র পঞ্চাশ। লিখছেন কৃশানু ভট্টাচার্য |
আঁধি ছবির নায়িকা সম্পর্কে তাঁর ধারণায় এতটুকু টোল পড়েনি।
অভিনয় থেকে বিদায় নেওয়ার পরে চার দেওয়ালের মধ্যে স্বেচ্ছা নির্বাসনে নিজেকে বন্দি করে রাখা সেই নিভৃতচারিণীর সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা এখনও ভুলতে পারেননি পরিচালক গুলজার। সুচিত্রা সেনকে ‘সেরার সেরা’ তকমা দিতে তাঁর এতটুকু দ্বিধা নেই। প্রায় চার দশক পরেও।
মহানায়িকার দু’টি বাংলা ছবি, ‘সাত পাকে বাঁধা’ আর ‘উত্তরফাল্গুনী’ পঞ্চাশে পা দিল। দূরভাষে সেই খবর দিতেই মুম্বই থেকে গুলজারসাব উচ্ছ্বসিত। “আমি যত নায়িকার সঙ্গে কাজ করেছি, তাঁদের মধ্যে উনি অতুলনীয়া। অভিনয়ে, সৌন্দর্যে, কমনীয়তায়, ব্যক্তিত্বে সব মিলিয়ে তিনি আমার দেখা সেরা নায়িকা।”
গুলজারসাব জানেন কি, মস্কো ফিল্মোৎসবে সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কার পাওয়ার পরে মিসেস সেন ঘুমিয়ে পড়েছিলেন? তাঁর ঘুম ভেঙেছিল টেলিফোনের শব্দে? সারা দিন অজস্রবার বেজেছিল তাঁর ল্যান্ডফোন। ফুলের তোড়ায়, চলচ্চিত্র জগতের সহকর্মী আর কাছের মানুষের অভিনন্দনের তোড়ে ভেসে গিয়েছিলেন তিনি?
মস্কো ফিল্মোৎসবে সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কার ছিনিয়ে নিয়েছিলেন সুচিত্রা সেন যে-ছবিতে অভিনয় করে, সেই ‘সাত পাকে বাঁধা’ ছবির কথা আজ আর মনে পড়ে না সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের। আর কী করেই বা মনে পড়বে? ‘সাত পাকে বাঁধা’র বয়স তো আর কম হল না। পঞ্চাশ বছর। “আমি কত বড় বড় পরিচালকের গুরুত্বপূর্ণ ছবিতে অভিনয় করেছি যে, আলাদা করে ‘সাত পাকে বাঁধা’র কথা মনে পড়ে না।” অকপট স্বীকারোক্তি সৌমিত্রবাবুর।
শুধু ‘সাত পাকে বাঁধা নয়, মহানায়িকা অভিনীত ‘উত্তরফাল্গুনী’র বয়সও অর্ধ শতক। ১৯৬৩-তে মুক্তি পাওয়া দু’টি ছবিই সে যুগে আলোড়ন তুলেছিল বাঙালি মননে। ছবির কাহিনি, সংলাপ, নাটকীয়তার বৈচিত্রে, শিল্পীদের অভিনয়ে মজে গিয়েছিলেন সে যুগের দর্শক।
কিন্তু এত বছর পরেও বাঙালি ছবির ইতিহাসে ওই দু’টি ছবির প্রাসঙ্গিকতা কতটা? এ যুগের বিচারে ‘সাত পাকে বাঁধা’ বা ‘উত্তরফাল্গুনী’ কি কেবলই অতীত? ‘সাত পাকে বাঁধা’য় কিছু ‘আনএক্সপেক্টেড রিঅ্যাকশন’ ছিল। সেই যুগে কোনও স্ত্রী রাগ করে স্বামীর পাঞ্জাবি ছিঁড়ে দিচ্ছে, ভাবাই যেত না। ওই দৃশ্যটি স্মরণীয় ছিল। যুগের তুলনায় খুবই আধুনিক। মিসেস সেন এবং সৌমিত্রদার পারফরম্যান্স দারুণ”, মন্তব্য করলেন ‘শব্দ’ ছবির পরিচালক কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়।
সুচিত্রা সেনের সঙ্গে নিজের কেরিয়ারের অন্যতম স্মরণীয় ছবির স্মৃতি সৌমিত্রবাবুর মন থেকে মুছে যেতে পারে, কিন্তু ৮২ বছর বয়সেও সে দিনের ঘটনার বর্ণনায় তিনি এক্কেবারে তরুণীর মতো তরতরে। মস্কো ফিল্মোৎসবে মিসেস সেনের সেরা অভিনেত্রী হওয়ার সংবাদ পেয়েই যাঁর গানে হুবহু ঠোঁট মেলাতেন মিসেস সেন, সেই সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় ছুটে গিয়েছিলেন মহানায়িকার বাড়িতে। একটু দেরি হয়ে গিয়েছিল তাঁর। কারণ সেই সময়ে স্বামী দিবানাথ সেনের সঙ্গে তিনি বেরবেন বলে তৈরি হচ্ছিলেন। “ফুলে ফুলে ভরিয়ে দিয়েছিলাম তাঁকে। হাসতে হাসতে দিবানাথকে বলেছিলেন মিসেস সেন, সন্ধ্যা রানির মতো করে আমাকে সাজিয়ে দিল।” |
|
উত্তম-সুচিত্রা ছবির সাফল্যের পিছনে যাঁর অসীম অবদান সেই কোকিলকণ্ঠী গায়িকার মতে মহানায়িকার ‘সাত পাকে বাঁধা’ আর ‘উত্তরফাল্গুনী’ চিরদিনের, চিরকালের ছবি। সর্বদাই সমকালীন। শরৎচন্দ্রের সাহিত্যের মতোই তা ক্লাসিক পর্যায়ের। কখনও যা পুরনো হয় না।
একই মত মহানায়িকার সঙ্গে সমানে টক্কর দেওয়া অভিনেত্রী সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়েরও। দু‘টি ছবিকেই ‘চিরকালীন’ বলতে মুহূর্তে দ্বিধা করেলেন না।
বাংলা ছবির পঞ্চাশ বছরের গোল্ডেন জুবিলি উৎসবে ‘সাত পাকে বাঁধা’ দেখানো হতে পারে। হয়তো বা ‘উত্তরফাল্গুনি’ও। পুরো তালিকা হাতে পেলে জানতে পারবেন রঞ্জিত মল্লিক। দশ আনার লাইনে দাঁড়িয়ে উত্তম-সুচিত্রার ছবি দেখার স্মৃতিচারণ করতে করতে ‘দেবী চৌধুরানী’ ছবির ব্রজেশ্বর রঞ্জিত মল্লিক তাঁর মহানায়িকার প্রশংসায় আপ্লুত। অসমাপ্ত ‘চতুরঙ্গ’ এবং ‘কৃষ্ণকান্তের উইলে’ সুচিত্রার সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা হয়েছিল তাঁর। “কত বছর হয়ে গেল ছবি করা ছেড়ে দিয়েছেন। তবু আজও তাঁকে নিয়ে চর্চা হয়। অসাধারণ অভিনেত্রী। তাঁর নিষ্ঠা, একাগ্রতা, জেদ, সংকল্প সবই দেখার মতো ছিল,” সুচিত্রার প্রশংসায় তিনি পঞ্চমুখ। ‘দেবী চৌধুরানী’তে তিনি তখন নবাগত। “কিন্তু মিসেস সেন কখনও তা বুঝতে দেননি।”
মাধবী মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে কখনও মুখোমুখি দেখা হয়নি সুচিত্রা সেনের। তবু তিনি মিসেস সেনের ফ্যান। “সুচিত্রা সেন অহংকারী। কিন্তু অহংকার তাঁকেই মানায়। নিজের জায়গা এবং নিজের ইমেজ তিনি নিজেই তৈরি করেছিলেন। আর শুধু বাংলা নয়, হিন্দিতে ‘দেবদাস’ বা ‘আঁধি’ এবং ‘মমতা’য় দ্বৈত ভূমিকায় তাঁর কী সাবলীল অভিনয়।” বাংলা ছবির সেই যুগে সুচিত্রা সেনের সঙ্গে কি তুলনা করা যায় বাকি নায়িকাদের? “সাবিত্রী খুব শক্তিময়ী অভিনেত্রী। কমেডি, রোম্যান্টিক, ট্রাজেডি, সব চরিত্রেই একই রকমের সাবলীল। মিসেস সেনও দারুণ শক্তিময়ী অভিনেত্রী। তাঁর চেহারাও তেমনই”, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় অকপট।
মাধবীর মতে, সুচিত্রা ওনার মতো কাজ করে গিয়েছেন। তাঁরা তাঁদের মতো। নিজে দুরন্ত অভিনেত্রী হয়েও তুলনাহীনার সঙ্গে কোনও তুলনা না-টেনে এক কথায় সব যেন বুঝিয়ে দিলেন সত্যজিৎ রায়ের ‘চারুলতা’। “সাত পাকে বাঁধা’ বা ‘উত্তরফাল্গুনী’র ‘রি-মেক’ হলে আজকের সমাজে কি তা চলবে?
চলবে না। সাফ কথা কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের। “নো মোর সেলেবল।” তাংর মতে, এখনকার সমাজে বিবাহবিচ্ছেদ কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। বিবাহবিচ্ছেদ মানেই মুক্তির আনন্দ।
কৌশিকবাবু বললেন, “এক সময়ে ক্যান্সার নিয়ে ছবি হয়েছে। ‘আনন্দ’, ‘সফর’ ‘মিলি’। তখন ক্যান্সার এমন ভাবে ছড়িয়ে পড়েনি। এখন নায়ক-নায়িকার ক্যান্সার নিয়ে ছবি করলে তা চলবে? চলবে না।”
রোম্যান্টিক যুগে নায়ক-নায়িকার হাত ধরাধরি দেখলে দর্শকের গায়ে কাঁটা দিত। “এখন তো সমাজ থেকে লজ্জাবোধই উঠে গিয়েছে। প্রেমিক-প্রেমিকার যুগ এখন অতীত। এখন ছেলেমেয়েদের ‘তুই-তোকারি’র সম্পর্ক। ‘ওগো তুমি যে আমার, শুধু তুমি যে আমার, কানে কানে বলি’ গানের দিনও শেষ। এখন দেহ মিলনের পরে বিয়ের কথা ওঠে,” টি-টোয়েন্টির ঢংয়ে ব্যাট করলেন কৌশিকবাবু। তাঁর মতে, ‘সাত পাকে বাঁধা’ ‘সপ্তপদী’ ‘হারানো সুর’ বাংলা ছবির ডায়নোসর যুগের মাইলস্টোন। শেষবেলার বনলতা সেনের মতো। ‘সাত পাকে বাঁধা’র রি-মেক হলে আপত্তি নেই মাধবীর। কিন্তু তাঁর প্রশ্ন, “অর্চনার চরিত্রে সুচিত্রার জায়গায় কে কাজ করবেন? পরিচালক হিসেবে অজয় করকে কোথায় পাব?” ‘সাত পাকে বাঁধা’কে শাশ্বত ছবি হিসেবে স্বীকার করে নিলেন পরিচালক সৃজিত মুখোপাধ্যায়। “আমার অত্যন্ত প্রিয় ছবি। সম্পর্কের ওঠানামা-টানাপোড়েন নিয়ে তৈরি এই ছবি আজও ‘রেলেভেন্ট। কিন্তু রি-মেক-এ বিশ্বাস করি না।” আপনার ‘জাতিস্মর’ কি ‘অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি’র রিমেক নয়? “মোটেই নয়। ‘জাতিস্মর’ ২০১৩-র প্রেমের গল্প। ভগৎ সিংহ বা গাঁধীকে নিয়ে যদি একাধিক ছবি হয়, তা হলে কি একটি ছবি আরেকটির রি-মেক? জীবন তো একটাই। ভগৎ সিংহ বা গাঁধীর মতো রক্তমাংসের কোনও একটি মানুষের জীবন নিয়ে একাধিক ছবি হতেই পারে।” ‘উত্তরফাল্গুনী’র এখনকার স্বত্বাধিকারী ‘ছায়াবাণী প্রডাকসন্স’-এর এখনকার কর্ণধার রামলাল নন্দীর সাফ কথা, পান্না বাইয়ের চরিত্র খুব কঠিন। রি-মেক হলে মাধুরী দীক্ষিত হয়তো করতে পারতেন। কিন্তু তাঁর বাইরে অন্য কেউ পারতেন কি না, আমার সন্দেহ আছে। এখন তো ‘বাংলা নাচে ভাংড়া’র মতো সব ছবি। পান্না বাইয়ের ভূমিকায় কে অভিনয় করবে?” প্রশ্ন তোলেন তিনি। কেন রাইমা বা পাওলি? “ওরা পারবে না।” ‘সাত পাকে বাঁধা’র রিমেক হতে পারে কি পারে না, সে সম্পর্কে সৌমিত্রবাবু সংযত। “আমার অনেক বয়স হয়েছে। ওই ছবির গল্প কী ছিল, মনেই পড়ে না। স্মৃতি কাজ করে না।” বাইকে করে দেব আর শুভশ্রী ‘এই পথ যদি না শেষ হয়’ গাইতে গাইতে যাচ্ছে, সিনেমায় এমন দৃশ্য এখন অচল”, কৌশিকবাবুর সাফ কথা। আর রামলালবাবু কী বললেন? “এখনকার পরিচালকেরা তো নতুন করে ‘অপুর সংসার’ বানায়, ‘চারুলতা’ বানায়। কিন্তু নতুন করে আর ‘সাত পাকে বাঁধা’ বা ‘উত্তরফাল্গুনী’ আরম্ভ করতে পারবে না। অসম্ভবকে কি সম্ভব করা যায়?”
দর্শকেরা নিশ্চয়ই একমত? সব হবে। কিন্তু ‘দাদাসাহেব ফালকে’ পুরস্কার নেওয়ার প্রস্তাব যিনি অনায়াসে ফিরিয়ে দিতে পারেন, সেই কিংবদন্তির জায়গা কে নিতে পারবেন? মহানায়কের মতোই মহানায়িকাও আজ টলিউডের ধরাছোঁয়ার বাইরে। থেকেও তিনি সবার অধরা। |
|
|
|
|
|