মুখোমুখি...
এ দেশে সাদা চামড়ার প্রতি মোহ তো রয়েছেই

পত্রিকা: আপনার জন্ম মস্কোতে। তার পর জার্মানি, পাকিস্তান হয়ে ভারতে এলেন কেন? শুধু তাই নয়, এখন একেবারে নাসিরুদ্দিন শাহের সঙ্গে সিনেমা?
কাজান: হ্যাঁ, ‘জন ডে’ করেছি ওঁর সঙ্গে। তবে এই বিভিন্ন জায়গায় থাকার লিস্টে আপনি আমার আমেরিকায় কাটানোর সময়টা বাদ দিয়েছেন। আর আমি এক মাসের জন্য পাকিস্তানে বেড়াতে গিয়েছিলাম। ওখানে অবশ্য থাকিনি সেভাবে। হ্যাঁ, আমার জন্ম মস্কোতে। ওখানেই আমার মা-বাবার পরিচয় হয়। আমি যখন খুব ছোট তখন ওঁরা আমায় নিয়ে ইউক্রেনের কিভ শহরে চলে যান। আমি ছ’বছর বয়স অবধি ওখানেই কাটিয়েছি। তার পর তো সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গেল। বাবা-মা তখন ঠিক করেন জার্মানি চলে যাবেন।

পত্রিকা: হঠাৎ জার্মানি কেন?
কাজান: সে সময় ওঁরা অনেক কিছু ভেবে ছিলেন। কোন দেশে গেলে ঠিক হয়। কিছু কিছু পরিবার আমেরিকায় চলে যায়। জার্মানি থেকে তখন একটা প্রোগ্রাম ছিল। শেষ পর্যন্ত ঠিক হয়, আমরা জার্মানি চলে যাব।

পত্রিকা: জার্মানিতে গিয়ে প্রথম-প্রথম রিফিউজির জীবনে অসুবিধে হয়নি?
কাজান: আমি তো ছোট ছিলাম, তাই বুঝিনি। তবে বাবা-মায়ের অসুবিধে হয়েছিল। বেকারির সমস্যা ছিল খুবই। বাবা ইউক্রেনে ইকনমিক্সের লেকচারার ছিলেন। রিটায়ার করে গিয়েছিলেন। জার্মানিতে কাজ করেননি। মা ছিলেন নার্স। জার্মানিতে গিয়ে নার্সের কাজ পেতে বেশ ঝামেলা হয়েছিল। আমি ছোট ছিলাম। সহজেই নতুন ভাষা শিখে ফেলেওছিলাম। কিন্তু ওই বয়েসে বাবা-মায়ের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা বেশ চাপের ছিল।

পত্রিকা: তা’হলে আপনাকে কি জার্মান বলব, নাকি রাশিয়ান?
কাজান: আমার বাবা-মা’র জার্মানির পাসপোর্ট। আমারটা ইউক্রেনের।
পত্রিকা: জার্মানি থেকে ওয়াশিংটন হয়ে ভারতে এলেন কী ভাবে?
কাজান: আমি জার্মানিতে পড়াশোনা করতে করতেই ঠিক করি, আমেরিকায় যাব। ওখানকার একটা কলেজে মডার্ন মিড্ল ইস্টার্ন ইতিহাস নিয়ে পড়াশোনা করতে যাই। এক বছরের একটা এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রামে। তার পর স্কলারশিপ পাই। এক বছর বাদে জার্মানি ফিরে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সেটা হয়নি। আমেরিকাতে আরও কিছু দিন থেকে যাই। আমার কিছু বন্ধুবান্ধব তখন নানা দেশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমার ইচ্ছে ছিল ইয়েমেনে চলে যাব। কিন্তু তখন ওই দেশের পরিস্থিতি এতটাই জটিল যে যাওয়া হয়ে উঠল না। আমার কিছু বন্ধু লাতিন আমেরিকাতে গেল। হঠাৎই একটা চাকরি পেয়ে গেলাম ভারতে। সেটা ২০০৮ সাল।

পত্রিকা: কোথায় চাকরি?
কাজান: ইন্দো-জার্মান চেম্বার অব কমার্সে। তাই ইয়েমেন না গিয়ে সোজা কলকাতায় চলে এলাম। কাজ শুরু করলাম। আমার অফিসটা ছিল বালিগঞ্জ ফাঁড়ির কাছে।

পত্রিকা: তা’হলে তো আপনি বাংলাতে সড়গড়?
কাজান: কলকাতা গেলে বাংলা বলি। বুঝতে তো পারিই।

পত্রিকা: কলকাতায় আপনার কাজের ধরনটা কেমন ছিল?
কাজান: কোনও লিগ্যাল কেস থাকলে আদালতের বাইরে মিটমাট করার জন্য মধ্যস্থতা করতাম। অনেক ক্ষেত্রেই দেখতাম বাচ্চাদের মতো বয়স্ক মানুষের মধ্যে ঝগড়া হচ্ছে। ভুল বোঝাবুঝি হচ্ছে। একটু ঠিকঠাক ভাবে দু’তরফকে বুঝিয়ে দিলেই অনেক সমস্যার সমাধান হয়। একবার তো এক পেটি আম পাঠানো নিয়ে কী ঝামেলা! তবে ঠান্ডা মাথায় বুঝিয়ে সুঝিয়ে দেখতাম অনেক কিছুর সমাধান বেরিয়ে আসছে।

পত্রিকা: আম তো না হয় বুঝলাম, কিন্তু অভিনয়ে এলেন কী করে?
কাজান: আরে, সেটাও তো কলকাতাতেই। একদিন এক বন্ধুর সঙ্গে কলকাতায় একটা সিনেমার সেটে পৌঁছলাম। সিনেমাটার নাম ছিল ‘দ্য ওয়েটিং সিটি’।

পত্রিকা: সেই হলিউডের অভিনেত্রী রাধা মিচেলের ফিল্মটা?
কাজান: হ্যাঁ। আমি গিয়েছিলাম শ্যুটিং দেখতে। ওখানে পৌঁছে দেখি একটা অল্পবয়েসি ছেলেকে নাচতে বলা হয়েছে। ও একটু নার্ভাস। আমি ওকে ডেকে নিলাম। বললাম, ‘অত নার্ভাস হয়ো না। যাও তো পাশের ঘরে গিয়ে নিজে নিজে একটু প্র্যাকটিস করে নাও।’ ছেলেটি তাই-ই করল। তত ক্ষণে আমার ইউনিটের কিছু লোকের সঙ্গে আলাপ হয়ে গিয়েছিল। তার মধ্যে একজন ছিলেন, যিনি জাতীয় পুরস্কার পাওয়া পরিচালক সুভদ্র চৌধুরীর অ্যাসোসিয়েট ডিরেক্টর। উনি হঠাৎই আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, আমি অভিনয় করব কি না। আমি বললাম, চেষ্টা করে দেখতে পারি, আপত্তি কীসের।

পত্রিকা: আর তার পরই ‘ক্লার্ক’-য়ের শ্যুটিং? আধবেলার কাজ ছিল নাকি?
কাজান: বোধ হয় আর একটু বেশি ছিল। প্রসেনজিৎদা ছিলেন ফিল্মটায়। তাই ভিড় সামলে শ্যুটিং করতে বেশ সময় লেগেছিল। এর পর কলকাতাতে আরও কিছু ফিল্ম করি। কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘রং মিলান্তি’ করেছিলাম। এর পরই চাকরি ছেড়ে মুম্বই চলে যাই। কয়েকটা ছোট ছোট ফিল্ম করি। তারপর ‘গাঁধী টু হিটলার’ আর ‘এজেন্ট বিনোদ’-য়ে কাজ করলাম। আর কিছু দিনের মধ্যেই ‘প্রাগ’ আর ‘জন ডে’ রিলিজ করবে।

পত্রিকা: ‘প্রাগ’-য়ে তো আপনি একজন চেক মহিলা? আর ‘জন ডে’-তে ইরানি। হিন্দি ফিল্মে ভিনদেশি মহিলার চরিত্রে কাজ করার অভিজ্ঞতা কেমন?
কাজান: ‘প্রাগ’-য়ে আমার চরিত্রটা একদম জিপসির মতো। খুব প্রাণবন্ত একজন মহিলা। আমার উলটো দিকে চন্দন রায় সান্যাল। আর ‘জন ডে’-তে আমার চরিত্রটা একদমই আলাদা। মুম্বইয়ের বাসিন্দা। মাদকাসক্ত। একটা অন্ধকার অতীত রয়েছে তার। এখানে আমার বিপরীতে কাজ করছে রণদীপ হুডা। ছবিতে আমি প্রেম আর আশার প্রতীক।

পত্রিকা: শুনেছি ‘প্রাগ’-য়ের সেন্সরশিপ নিয়ে প্রচুর সমস্যা হয়েছিল?
কাজান: না, স্ক্রিনে আমাদের রোম্যান্সটা খুব মিষ্টি। দু’জন অল্প বয়েসি ছেলেমেয়ে প্রেম করলে যা হয় আর কী। অন্তরঙ্গ কিছু মুহূর্ত তো আছেই, কিন্তু সেগুলো বেশ ‘অরগেনিক্যালি’ শ্যুট করা হয়েছে। যেটুকু অসুবিধে একজন মহিলার অন্য একজন অভিনেতাকে ক্যামেরার সামনে চুমু খেতে গেলে হয়, সেটা আমার হয়েছিল ঠিকই। তবে এই নয় যে গোটা ছবি জুড়ে আমরা শুধু শারীরিক ভাবে মিলিত হয়েছি। সেন্সরশিপে ঝামেলা হয়েছিল গানের কথা নিয়ে।

পত্রিকা: নাসিরুদ্দিন শাহের সঙ্গে রণদীপ হুডা আগে থিয়েটার-সিনেমা করেছেন। আপনার তো এই প্রথম। কেমন লাগল?
কাজান: খুব টাইট সিডিউলে কাজ করেছি। তবে একটা কথা বলব, প্রথম যেদিন ওঁকে সেটে ঢুকতে দেখি, খেয়াল করলাম, মুহূর্তে চারপাশটা কেমন নিস্তব্ধ হয়ে গেল। মানুষটার প্রতি লোকজনের কী অসম্ভব সম্ভ্রম, সেদিনই বুঝতে পেরেছিলাম। সেটে উনি ঢুকছেন, কারও মুখে একটা কথা নেই।

পত্রিকা: কেউ কেউ বলছেন যে নার্গিস ফাখরির সঙ্গে নাকি আপনার জোর প্রতিযোগিতা চলছে?
কাজান: আমি তো জানি না!

পত্রিকা: ইন্টারনেটে তো দুই বিদেশিনিকে এই নিয়েই হেডলাইন করা খবর রয়েছে...
কাজান: আমি ‘রকস্টার’ দেখিনি। তবে ‘ম্যাড্রাস ক্যাফে’-তে ওকে বেশ ভাল লেগেছে। আমার মনে হয় একটা সিনেমাতে কাস্টিং করার সময় প্রথমে দেখা উচিত যে সেই অভিনেতা ওই ভূমিকায় মানানসই হবেন কি না। সেটা হলে কাজটা ভাল হবেই।

পত্রিকা: আপনার কি মনে হয় যে নার্গিস এক ধরনের রোল-য়ের জন্য ভাল, আর আপনি অন্য ধরনের?
কাজান: দু’জনেই ভার্সেটাইল অভিনেত্রী হতে চাইব। তাই আলাদা কোনও স্পেশালাইজেশন নিয়ে স্বপ্ন দেখা উচিত নয়।

পত্রিকা: বহু বছর হল বলিউডে বিদেশি অভিনেত্রীরা এসে কাজ করছেন। এখন তাঁদের সংখ্যাটা আরও বেড়ে গিয়েছে। এর কারণটা কি আমাদের দেশের সাদা চামড়ার প্রতি আসক্তি? নাকি বিদেশে মন্দা বাজারের চাপ?
কাজান: এটা তো ঠিক যে এ দেশে সাদা চামড়ার প্রতি একটা আকর্ষণ রয়েছে। কিন্তু আমার মনে হয় সেটার বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া দরকার। আমি নিজে কোনও ফেয়ারনেস ক্রিমের বিজ্ঞাপন করি না। এমন অনেক সুন্দর মানুষকে আমি চিনি যাঁদের গায়ের রং শ্যামলা। আমার নিজের ধারণা যে শুধুমাত্র সাদা চামড়ার মোহ দিয়েই একটা ইন্ডাস্ট্রিতে নিজের জায়গাটা করা যায় না। ভাষাটাও জানতে হয়। আমি নিজে হিন্দি জানি। বাংলা বুঝতে পারি। ‘পিয়াসা’, ‘কাগজ কে ফুল’ ইত্যাদি ছবি আমি দেখেছি। ওয়াহিদা রহমান আর মধুবালা আমার খুব পছন্দের। কলেজে পড়তে আমি ঋত্বিক ঘটক আর সত্যজিৎ রায়ের সিনেমা দেখেছি। ‘মেঘে ঢাকা তারা’ আমার ফেভারিট। যদিও আমি এই নতুন ‘মেঘে ঢাকা তারা’টা দেখিনি। ভারত সম্পর্কে আমার একটা ধারণা ছিল এ দেশে আসার আগেই। অন্যান্য বিদেশি অভিনেত্রী তো মডেলিং করার পর অভিনয়ে এসেছেন। আমি সেই রাস্তা দিয়ে হাঁটিনি। আমাকে কিছু সাউথ-য়ের ছবি করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। আমি বলেছিলাম, ভাষাটা জানি না, করব কী করে! উত্তরে শুনি যে ভাষাটা নাকি কোনও সমস্যা নয়। আমি তাতে বেশ আশ্চর্য হয়ে যাই। হিন্দি ছবিতে আমি নিজে নিজের লাইন ডাব করেছি। আমাদের জার্মানিতে তো কেউ ছবি করতে ডাকবে না যদি সেই অভিনেতা জার্মান ভাষাটা না জানেন। আমি নিজে রাশিয়ান, জার্মান, ইংলিশ, ফ্রেঞ্চ আর একটু স্প্যানিশ বলতে পারি।

পত্রিকা: এই সব কাজ করার মাঝেও শুনেছি আপনি কলকাতাতে ফিরে এসে ডিপ্লোমা ছবি করে যান। শুধুমাত্র বিমানভাড়াটা নিয়ে কাজ করে গিয়েছেন...
কাজান: হ্যাঁ, আমার দারুণ লাগে ফিল্ম ইনস্টিটিউটের বাচ্চাদের সঙ্গে কাজ করতে। দু’টো ডিপ্লোমা ছবি করেছি। আমাকে যদি কেউ একটা মডেলিংয়ের কাজ আর একটা ডিপ্লোমা ছবিতে অভিনয়ের মধ্যে বাছতে বলে, আমি ডিপ্লোমা ছবির কাজটাই বেছে নেব। মডেলিংয়ে পয়সা ভাল। কিন্তু সত্যি বলতে কী, ওই দুনিয়াটা একটু আনরিয়েল আর ফেক লাগে আমার। তবে টাকা রোজগারের জন্য তো সেই কাজটা করতে হয়। সেফ আলি খানের সঙ্গে কিছু চিপসের বিজ্ঞাপন করেছি।

পত্রিকা: ‘জন ডে’, ‘প্রাগ’-য়ের পর কী?
কাজান: এই মাসে ফিলিপিন্স যাচ্ছি। জার্মান-ফিলিপিনো কোলাবরেশনে একটা কাজ করব। ছবিটির নাম ‘রুইনড্ হার্ট’। পরিচালক খোয়ান দে লা ক্রুজ। বার্লিন শর্ট ফিল্ম ক্যাটেগরিতে একটা ছবি বানিয়ে পুরস্কার পেয়েছেন খোয়ান। সেটাকেই এখন ফিচার ফিল্ম বানাচ্ছেন তিনি। আর সব থেকে বড় ব্যাপার কী জানেন? ফিল্মের চিত্রগ্রাহক হলেন ক্রিস্টোফার ডয়েল, যিনি ওং কার ওয়াই-য়ের সব ক’টা ছবি শ্যুট করেছেন!

পত্রিকা: কোনও দিন ভারতীয় কোনও চরিত্রে অভিনয় করতে পারবেন?
কাজান: হ্যাঁ, করছি তো। ‘আত্মা’ বলে একটা ফিল্মে কাশ্মীরি একটা মেয়ের চরিত্র। পরিচালক সুদীপ্ত সেন। কাশ্মীর লিবারেশন স্ট্রাগলের ওপর বানানো ফিল্ম। কাশ্মীরে গিয়ে শ্যুটিং করার কথাও হয়েছে সেটার জন্য। আর দুটো বাংলা ছবি করারও অফার রয়েছে।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.