|
|
|
|
|
|
|
নাটক সমালোচনা ১... |
|
|
ক্ল্যাসিকের নবজন্ম |
কী অভিনয়, কী গান। ‘অ্যান্টনি সৌদামিনী’
নাটক দেখা সত্যিই এক অনন্য অভিজ্ঞতা।
লিখছেন নবনীতা দেবসেন |
|
আজকাল চারিপাশের জীবন থেকে কোনও প্রেরণা পাই না। প্রাণমন মুষড়ে থাকে। এই রকম অবস্থায় আমার মন রূপকথা চায়। কল্যাণের ইচ্ছে দিয়ে সব ফাঁকফোকরগুলো যদি ভরে নেওয়া যেত? সেদিন একটি নাটক দেখে অন্তরাত্মা আনন্দে ভরে গেল।
শেষ কঠিন জয় যে চিরবিচ্ছেদের, ট্র্যাজেডির সেই সত্য শিল্পে সবার ওপরে। কিন্তু আমাদের প্রাত্যহিক জীবন আপাতত এমনই উদ্বেগে অন্ধকার, যে আমি অন্তত কোথাও একটু শিল্পের জয়, সততার জয়, প্রেমের জয় ইত্যাদি দীপ্তি দেখতে পেলে, জীবনের জয় হল মনে করে খুব আরাম পাই। কিন্তু আজকাল মানুষের স্বপ্ন সফল হওয়ার সরল (গাঁইয়া) কাহিনি গড়লে, সচরাচর সেই সৃষ্টির শৈল্পিক সম্মান থাকে না। মানছি, শিল্পে শুধুই বিনোদন নয়, কিছু চিন্তার খোরাক চাই, কিন্তু লক্ষ করছি, অতি জটিল, দুরূহ প্রশ্ন-সঙ্কুল না হলে আধুনিক মননে শিল্পের গ্রহণযোগ্যতা কমে যাচ্ছে। আমি চাই শিল্প হোক পজিটিভ এনার্জির উৎস। বর্তমান জীবন যেটা জুগিয়ে উঠতে পারছে না। সভ্যতার শুশ্রূষাও তো শিল্পের কাজ?
পর্তুগিজ পিতা আর বাঙালি জননীর এই ব্রিলিয়ান্ট সন্তান, তার বাংলাভাষা প্রেম, বাঙালি পত্নীপ্রেম, কালীভক্তি আর সুচতুর কবিগানের নৈপুণ্য নিয়ে স্বভাবতই নায়কোচিত, বাঙালির অতি প্রিয় ব্যক্তিত্ব। ঠনঠনের মেয়ে আমি। তাই ছেলেবেলা থেকেই ধর্মতলার ফিরিঙ্গি কালীবাড়ির কথা, আর তার প্রতিষ্ঠাতা অ্যান্টনি কবিয়ালের কথাও জানি। তাঁকে নিয়ে লেখালিখি হয়েছে, ফিল্ম হয়েছে, নাটকও হল। অ্যাকাডেমিতে ‘অ্যান্টনি সৌদামিনী’ দেখে আমি তো বিমোহিত! লজ্জার কথা, উত্তমের ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ডপ্রাপ্ত ছবিটা তখনও আমার দেখা হয়নি। শুধু গানগুলোই শুনেছি এত বচ্ছর ধরে! নাটকে আমার সেদিনের সঙ্গিনীটি আবার ‘অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি’ ফিল্মের গুণে বিশ বছর ধরে মন্ত্রমুগ্ধ।
|
|
“কেমন লাগল? সিনেমার চেয়ে ভাল? আমি কিন্তু দেখিনি সিনেমাটা!” “নাটকটিও খুব ভাল। দু’টো তো আলাদা মাধ্যম। আর কাহিনিও এক নয়। ওখানে সৌদামিনীর নাম নিরুপমা। এখানে ‘সই’ ডাকটি সুন্দর। তা ছাড়া তনুজা তো বাঈজি ছিল! গার্গী তা নয়। তনুজার মৃত্যু হয়, গার্গী বেঁচে থাকে। থিমটার আলাদা ট্রিটমেন্ট।”
“তা ছাড়া তনুজার গানগুলো গেয়েছেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। এখানে গার্গী অভিনয়ের মধ্যে নিজে গাইছেন, এটা ঢের বেশি চ্যালেঞ্জিং, তাই না? অবিশ্যি মঞ্চাভিনয় সব সময়ই পরদার চেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জিং।”
“অনির্বাণ ভট্টাচার্য কিন্তু গানগুলো সত্যিই ভাল গেয়েছেন! উত্তমকুমারের ম্যাজিকের সঙ্গে আর বেচারা পাল্লা দেবেন কেমন করে!”
পাল্লা দেওয়া সত্যি কঠিন। টিভিতে আমি গানের টুকরো দেখেছিলুম, ম্যান্ডোলিন নিয়ে উত্তমকুমার, ‘আমি যামিনী, তুমি শশী হে’ ফাটাফাটি’!
কিন্তু এই নাটকে খুব বুদ্ধি এবং দুঃসাহস করে এই গানটিকে ডুয়েট করে দিয়েছেন পরিচালক। নায়ক-নায়িকা একত্রে এক এক লাইন করে গেয়েছেন নাচের ছন্দে মঞ্চে হেঁটে চলে, সত্যি অসাধারণ মহড়া হয়েছে গানটির। আমি যেহেতু ফিল্ম তখনও দেখিনি, মনপ্রাণ খুলে উপভোগ করেছি নাটকটির প্রত্যেকটি দৃশ্য, গোড়া থেকে সমাপ্তি অবধি।
সঙ্গিনীর অনুপ্রেরণায় আমি ফিরে এসেই ‘অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি’ ডিভিডি আনিয়ে রাত জেগে দেখে ফেললুম। দেখে ভাল লাগল ঠিকই, জটিলতর গল্প, ট্র্যাজেডি, কিন্তু ফিল্মের শেষে নিরুপমার অপমৃত্যু ভোলা ময়রাকে হারিয়ে অ্যান্টনির ঘরে ফেরার সাফল্যকে অর্থহীন, বিবর্ণ করে দেয়। ঢের ভাল লেগেছে নাটকের সদর্থক পরিসমাপ্তি, যেখানে ফিরিঙ্গি কালীমন্দির গড়া হচ্ছে, বিজয়গর্বে সৌদামিনীর কাছে ফিরে আসছে অ্যান্টনি, দুষ্টু খুড়োখুড়িও বিষদাঁত হারিয়ে আশ্রয় চাইতে আসছে সৌদামিনীরই সংসারে, দুষ্টের হার, জীবনের জয় ঘোষিত হচ্ছে। এখানেই কবিয়ালের কৃতিত্ব। |
শঙ্খ ঘোষ
‘অ্যান্টনি সৌদামিনী’ একটি সুষ্ঠু প্রযোজনা। অনেক দিন পরে গার্গীর অভিনয় দেখে বেশ ভালই লাগল। দাপটে অভিনয় করেছে। অ্যান্টনি কবিয়ালের চরিত্রে অনির্বাণ ভট্টাচার্যর অভিনয় নজর কাড়ে। নাটকে সঙ্গীতের ব্যবহার খুবই সুন্দর। |
ব্রাত্য বসু
‘অ্যান্টনি সৌদামিনী’ বাংলা থিয়েটারে এক ক্ল্যাসিকের নবভাষ্য। পরিচিত গল্প, কিন্তু অভিনয় ও পরিবেশনার প্রসাদগুণ উপভোগ্য। পরিচালক হিসেবে সৌমিত্র মিত্র এই থিয়েটারের আবিষ্কার। |
|
তনুজার নিরুপমা খুবই ভাল, কিন্তু গার্গীর সৌদামিনীকে সে ভুলিয়ে দিতে পারল না! গার্গী সৌদামিনীতে অসামান্যা। যেমন মানিয়েছে তাঁর রূপ, তেমনই তাঁর অভিনয় এবং গানের গলা। সোজা তো নয় ওই সব চেনা গান গাওয়া! সন্ধ্যার গলা সকলের কানে এখনও বাজছে। পরদায় অসিতবরণও অতি চমৎকার, কিন্তু রজত গঙ্গোপাধ্যায়ের ভোলা ময়রা বুঝি আরও এক কাঠি বেশি অথেনটিক, দেখতে এবং শুনতে! আর তাঁর গলার গান, আহা! এককথায় অনবদ্য! চোখে, কানে ছুঁয়ে রয়েছে। অ্যান্টনির কথা আর কী বলি! কাজটা ছাব্বিশের তরুণ অনির্বাণের কঠিন চ্যালেঞ্জ ছিল, সামনে উত্তম, পিছনে মান্না দে! বাঘ আর সিংহ! সেটা তিনি কিন্তু তাঁর মতো করে জিতে গিয়েছেন। প্রতিটি গান সুগীত। তাঁর অনেক উন্নতি দেখব।
ওই যে শুরু করেছিলুম, অবিচার আর নির্মমতা দেখতে দেখতে মন পরিশ্রান্ত। আজকাল সব কিছুর শুভ দিকটা, সুন্দর, সদর্থর্ক সমাপ্তি দেখতে ভাল লাগে। সে আপনারা আমায় যতই কাঁচাগোল্লা ভাবুন। শুধু কি অভিনয়, আর গান? নাটকের কাহিনি, পরিকল্পনা, পরিচালনা সব কিছুই আমার মনের মতো। পাকা নাট্য সমালোচকেরা হয়তো আমার এমন সমালোচনাহীন আলোচনায় বিচলিত বোধ করবেন। বয়েস হয়ে নবনীতার হল কী? কী আবার হবে! অনেক ধ্যাষ্টামি সহ্য করে এখন সহজ-সরল-সুন্দরের প্রতি মমতা হয়েছে।যে নাটকে ২০১৩-তে আদর্শের জয় হয়েছে, প্রেমের জয় হয়েছে, পাপীর দণ্ড হয়েছে, গুণীর গুণের জয়জয়কার হয়েছে, ভাল মানুষদের ভাল হয়েছে, মন্দের মন্দমনের বদল হয়েছে, সেটি দেখে তৃপ্তি হবে না? আমি অত পাকা নই, আমার খুশি হতে ভাল লাগে। যজ্ঞেশ্বরীর গান ও অভিনয়ও অত্যন্ত মনোরম। সকলে মিলে চেষ্টা করেছেন নিজের শ্রেষ্ঠ কাজটি করে দেখাতে। সেটা বোঝা যায় এবং সেই জন্যই এ ভাবে দর্শকের অন্তর স্পর্শ করে নাটকটি। অভীপ্সা কাজীর লিন্ডাও সুন্দর (ফিল্মে মারিয়ানা), ললিতা চট্টোপাধ্যায় খুশি হবেন। গান-বাজনা সবই যথাযথ। বিশেষ করে আলোর খেলা। পরদায় আঁকা ছায়ার মায়াগুলি বড় মনের মতো লেগেছে। শেষ দৃশ্যে ঘোড়ার গাড়ির চালটি বিশেষ করে। পরিচালক সৌমিত্র মিত্রকে ধন্যবাদ এমন একটি নাটক উপহার দেওয়ার জন্য। |
|
|
|
|
|