পুস্তক পরিচয় ২...
‘তোমাদের গা থেকে মাছের গন্ধ আসছে’
দেশভাগের পরে পাকিস্তানের শাসনাধীন পূর্ববঙ্গে বাংলা ছবি করাটাই ছিল সেখানকার বাঙালির প্রায় অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই। স্বাধীনতার আগে গত শতকের বিশ-তিরিশ দশকের সন্ধিক্ষণে ঢাকায় যদিও ইতস্তত ছবি তৈরি শুরু হয়েছিল কিন্তু সে ভাবে চলচ্চিত্র-শিল্প গড়ে ওঠেনি, আর স্বাধীনতার পরে তো পাকিস্তানের চলচ্চিত্র-শিল্প চলে যায় পুরোপুরি লাহৌরের আয়ত্তে।
স্থানীয় মানুষজন উৎসাহী হয়ে উঠলেও অস্থানীয় পাকিস্তানের চলচ্চিত্র-ব্যবসায়ীরা বলেছিলেন যে, ঢাকার মতো আর্দ্র আবহাওয়ায় নাকি আদৌ ফিল্ম তৈরি সম্ভবপর নয়। এ-মতকে রীতিমতো চ্যালেঞ্জ করেই নাট্যকার আবদুল জব্বার খান বছর কয়েকের মধ্যে বাংলা ছবি বানান, দেখাদেখি তৈরি হয় আরও বাংলা ছবি, শিল্পমানের চেয়ে হয়ে-ওঠাটাই তখন জরুরি ছিল বাংলা ছবির পক্ষে।
গোটা ষাটের দশক জুড়ে বেশ কিছু বাংলা ছবি তৈরি হয় ঢাকায়, জহির রায়হান, সাদেক খান, সুভাষ দত্ত, সালাউদ্দিন, মুস্তাফিজ, আমজাদ হোসেন, খান আতাউর রহমান— এই পরিচালকেরা ছবি করা শুরু করেন। রবীন্দ্রনাথের ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি জহির তাঁর ছবি ‘জীবন থেকে নেয়া’য় শুধু ব্যবহারই করেননি, ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে পূর্ববঙ্গ যখন স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রে রূপান্তরিত হল, তখন সে রবীন্দ্রগান সে-দেশের জাতীয় সংগীতও হয়ে উঠল। ১৯৪৭-’৭০ অবধি পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক আন্দোলন, ছাত্র আন্দোলন, পুলিশি নির্যাতন, একুশে ফেব্রুয়ারি, বাঙালি জাতীয়তাবাদ, সাধারণ মানুষের প্রতিবাদ ইত্যাদি নানা প্রসঙ্গ এসে পড়ে জহিরের এ-ছবিতে। একনায়কতন্ত্রী সামরিক শাসনে প্রথমে না-মঞ্জুর হয় ছবিটির সেন্সর সার্টিফিকেট। নির্দিষ্ট তারিখে মুক্তি না পাওয়ায় বিক্ষোভে শামিল হন সচেতন দর্শকরা, এমন উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে বাধ্য হয় সামরিক সরকার ‘জীবন থেকে নেয়া’কে মুক্তি দিতে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ’৭১-এ সেই স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রামাণ্যচিত্র তৈরি করেন জহির রায়হানই— ‘স্টপ জেনোসাইড’।
স্বাধীনতা পরবর্তী সত্তর দশকে বেশ কিছু পরিচালক সুস্থ রুচির ছবি তৈরি করলেও ’৭৫-এ শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হওয়ার পর রাজনৈতিক পট-পরিবর্তনের সঙ্গে এল সিনেমারও পালাবদল— যে বদল বাংলাদেশের জন্যে কোনও সুবাতাস বয়ে আনল না। আশির দশকের গোড়ায় বাংলাদেশ সামরিক শাসনের আওতায় চলে গেলেও কিন্তু বিকল্প ধারার চলচ্চিত্র নির্মাণের আন্দোলন শুরু হল।
শেখ নিয়ামত আলি ও মসিহউদ্দিন শাকের পরিচালিত ‘সূর্য দীঘল বাড়ি’, মানবিক ও সমাজবাস্তবতার এই ছবিটি প্রায় পথ-প্রদর্শক হয়ে উঠল এ আন্দোলনের। অংশীদার হলেন আলমগীর কবির, বাদল রহমান, সৈয়দ সালাহ্উদ্দিন জাকি-র মতো বিশিষ্ট পরিচালকেরাও। আশির দশকের মাঝামাঝি মোরশেদুল ইসলামের ‘আগামী’, তানভীর মোকাম্মেলের ‘হুলিয়া’, আরও পরে তারেক ও ক্যাথরিন মাসুদের ‘মুক্তির গান’ বিকল্প চলচ্চিত্র আন্দোলনের ধমনীতে রক্ত উজিয়ে দিল। জাতীয় স্তর ছাপিয়ে বাংলাদেশের এই ‘অন্য সিনেমা’ পৌঁছে গেল আন্তর্জাতিক দরবারে, সম্মান-পুরস্কার-খ্যাতির আলো এসে পড়ল আন্দোলনে। ক্রমান্বয়ে এগিয়ে এলেন এবং এখনও আসছেন আরও তরুণ শিক্ষিত পরিচালকেরা, যেমন একজন নাসিরউদ্দীন ইউসুফ। অসম্ভব সাহসী পরিচালক এলেন মেয়েদের মধ্যেও— শামীম আখতার, নিশাত জাহান রানা, ফৌজিয়া খান, ইয়াসমিন কবির।
বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের সামগ্রিক প্রেক্ষিতে এই বিকল্প ধারার চলচ্চিত্রের ইতিহাস সম্প্রতি ছ’খণ্ডে প্রকাশ পেল সুশীল সাহার সম্পাদনায়: বাংলাদেশের অন্য সিনেমা (অভিযান, ১০০০.০০)। সম্পাদক তাঁর আত্মপক্ষ-এ জানিয়েছেন: ‘বাংলাদেশের ছবিও এখানে নিয়মিত দেখানো হয় না। ক্বচিৎ কখনও একটি-দুটি ছবি দেখানো হলেও আম-জনতার কাছে সে খবর পৌঁছায় না।... বিগত কয়েকটি দশক ধরে সম্পূর্ণ স্রোতের বিরুদ্ধে লড়াই করে সুস্থ ধারার ছবি তৈরির যে প্রয়াস ওখানে দেখা গেছে তারই একটি আনুপূর্বিক ইতিহাস এখানে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে।’
বাংলাদেশের অন্য সিনেমার ইতিবৃত্ত প্রথম খণ্ডে, সেখানে অরুণ সেনের কলমে এ-বঙ্গের চোখ-দিয়ে-দেখা বাংলাদেশের ছবির দীর্ঘ ইতিহাস। সুধীর চক্রবর্তী সঞ্জয় মুখোপাধ্যায় ইরাবান বসুরায় সৌমিত্র দস্তিদার সুগত সিংহ নবীনানন্দ সেন এবং আরও কেউ-কেউ লিখেছেন এ-বঙ্গ থেকে। দ্বিতীয় খণ্ডে অন্য সিনেমার কয়েকজন পথিকৃৎ, তাতে যেমন আলমগীর কবিরকে নিয়ে তানভীর মোকাম্মেল আর তারেক মাসুদের রচনা, তেমনই সম্প্রতি-প্রয়াত তারেককে নিয়ে মোরশেদুল ইসলামের (উপরে তাঁরই ছবি ‘আমার বন্ধু রাশেদ’-এর স্থিরচিত্র) রচনা। কয়েকটি উল্লেখযোগ্য কাহিনিচিত্র ও প্রামাণ্যচিত্রের আলোচনা তৃতীয় ও চতুর্থ খণ্ডে, বিকল্প ধারার চলচ্চিত্র আন্দোলনের স্বরূপ নিয়ে পঞ্চম খণ্ডটি, আর শেষ খণ্ডে বিশিষ্ট কয়েক জন পরিচালকের সাক্ষাৎকার। এমনই এক সাক্ষাৎকারে শামীম জানিয়েছেন ‘আমার মনে আছে স্কুলে পড়ার সময় আমাদের পাশে বসা অবাঙালি মেয়েরা নাকে হাত দিয়ে বলত— তোমাদের গা থেকে মাছের গন্ধ আসছে— বাঙালি লোগ সে মাছলিকা বদবু আতা হে। এটা এক ধরনের এথনিক এক্সটরশন বা ইভটিজিংয়ের মধ্যে পড়ে, যার শিকার বাঙালিকে হতে হয়েছে।’


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.