পুস্তক পরিচয় ১...
জীবৎকালেই তিনি কিংবদন্তি
রাজা দীন দয়াল/ আর্টিস্ট-ফোটোগ্রাফার ইন নাইনটিন্থ সেঞ্চুরি ইন্ডিয়া, দীপালি দেওয়ান ও ডেবোরা হাটন।
দি আলকাজি কালেকশন অব ফোটোগ্রাফি ও মাপিন পাবলিশিং, ৩,৯৫০.০০

আজব ইয়ে করতে হ্যাঁয় তসবির মেঁ কামাল কামাল
উস্তাদোঁ কে হ্যাঁয় উস্তাদ রাজা দীন দয়াল।
”— ষষ্ঠ নিজাম মেহবুব আলি খান

ভারতে ছবি তোলার প্রথম অর্ধশতাব্দীর ইতিহাসে ইয়োরোপীয়দেরই একচ্ছত্র দাপট। স্যামুয়েল বোর্ন তুলছেন হিমালয়ের নিসর্গ, ফেলিস বিটো ১৮৫৭-র মহাবিদ্রোহের কেন্দ্রগুলিকে লেন্সবন্দি করছেন, লিনিয়াস ট্রাইপ দক্ষিণের স্থাপত্য খুঁজে খুঁজে ছবি তুলছেন, মেজর গিল অজিণ্ঠা গুহায় পড়ে আছেন ভিত্তিচিত্রের অনুপুঙ্খ ক্যামেরায় ধরে রাখবেন বলে। আর্কিয়োলজিক্যাল সার্ভের জে ডি বেগলার কি হেনরি হার্ডি কোল পুরাকীর্তির ‘ডকুমেন্টেশন’ করছেন, কলকাতার ছবি তুলছেন ফ্রেডরিক ফিবিগ। উনিশ শতকের শেষ পাদে রমরমিয়ে দেশ জুড়ে ব্যবসা করছে বোর্ন অ্যান্ড শেফার্ড, জনস্টন অ্যান্ড হফম্যান-এর মতো সংস্থা। ভারতীয় রাজা-মহারাজারাও শখের ফোটোগ্রাফি চর্চা করছেন। জয়পুরের মহারাজা সওয়াই রাম সিংহ (দ্বিতীয়) ১৮৬২ সালে প্রথম ক্যামেরা কেনেন, ত্রিপুরার মহারাজা বীরচন্দ্রমাণিক্য দাগেরোটাইপ ছবি তুলতে শুরু করেছিলেন ১৮৫০-এর দশকের মাঝামাঝি। বীরচন্দ্রের ছেলে বড়ঠাকুর সমরেন্দ্রচন্দ্র দেববর্মণ রীতিমতো ভাল ছবি তুলতেন। ফোটোগ্রাফিক সোসাইটিতে রাজেন্দ্রলাল মিত্রের ভূমিকা ও সাহেবদের সঙ্গে তাঁর বিরোধের কথা সবিস্তারে লিখেছেন সিদ্ধার্থ ঘোষ। প্রায় শুরু থেকেই পেশাদার ফোটোগ্রাফির জগতেও কম ভারতীয় আসেননি, মুম্বই কি কলকাতায় তাঁদের রমরমা আজ ইতিহাস। লখনউয়ের আহমেদ আলি খান কি দারোগা হাজি আব্বাস আলি না থাকলে ‘পুরনো লখনউ’ অনেকটাই অধরা থেকে যেত। কিন্তু শুধু ‘ভাল ছবি’ তোলা নয়, বড় শহরে স্টুডিয়ো খুলে ছবি তোলার ভাল ব্যবসা করা নয়, ইয়োরোপীয়দের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ‘সেরা ছবি’ তোলা, আর তার জোরে এক দিকে সর্বভারতীয় অভিজাত সমাজে সম্মান ও পৃষ্ঠপোষণা অর্জন, অন্য দিকে দেশে-বিদেশে সাহেবদেরও প্রশংসা ও আনুকূল্য— এই দুইয়ের সমন্বয় রাজা দীন দয়ালকে (১৮৪৪-১৯০৫) মহীরূহ করে তুলেছিল। ব্যক্তিগত কৃতিত্ব ও ধারাবাহিক ব্যবসায়িক সাফল্য, দুই মেরুর সেতুবন্ধন করে তিনি ছবি তোলাকে যে উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন, তাঁর সমসাময়িক আর কোনও ভারতীয় তা পারেননি।
কিন্তু দীন দয়ালের গুরুত্ব কি শুধু এই সাফল্যের খতিয়ানেই সীমাবদ্ধ? বস্তুত গত কয়েক দশকে দেশ-বিদেশে নানা প্রদর্শনী, জুডিথ গাটমান (থ্রু ইন্ডিয়ান আইজ: নাইনটিন্থ অ্যান্ড আর্লি টুয়েনটিয়েথ সেঞ্চুরি ফোটোগ্রাফি ফ্রম ইন্ডিয়া, ১৯৮২) থেকে নরেন্দ্র লুথারের (প্রিন্স অব ফোটোগ্রাফার্স/ রাজা দীন দয়াল, ২০০৩) বই এক দিকে যেমন নতুন করে দীন দয়াল ‘মিথ’ গড়তে অনেকখানি সাহায্য করেছে, তেমনই নানা প্রশ্ন সামনে নিয়ে এসেছে। ঔপনিবেশিক প্রভুরা যে দক্ষিণ এশিয়ায় ‘আধুনিকতা’র বিস্তার ঘটিয়েছিলেন, ব্রিটিশ আলোকচিত্রী-কেন্দ্রিক আলোচনা সেই ছককে চমৎকার মিলিয়ে দেয়। কিন্তু দীন দয়াল সেখানে ব্যতিক্রমী, ‘প্রতিরোধী’ও বটে। মেরঠের কাছে সারধানা-র মধ্যবিত্ত জৈন পরিবারের সন্তান, রুড়কির টমাসন সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে পড়াশোনা করে ইনদওর-এ পূর্ত বিভাগে চাকরি নেন। ১৮৭৪-এ তাঁর ছবি তোলা শুরু, খুব সম্ভবত শখ করেই। বছর আটেকের মধ্যে তিনি একের পর এক লর্ড নর্থব্রুক আর প্রিন্স অব ওয়েলস-এর সফর, সাঁচি স্তূপে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের সংরক্ষণপর্ব, এবং মহু-তে ফৌজি মহড়ার ছবি তোলেন। এই তিন ধরনের কাজই পরে তাঁর আলোকচিত্রী জীবনের এবং ব্যবসায়িক সাফল্যের তিনটি স্তম্ভ হয়ে ওঠে। এই যে অনভিজাত দীন দয়াল ফোটোগ্রাফিকে পেশা করে ব্রিটিশ প্রতিদ্বন্দ্বীদের ছাপিয়ে গেলেন, এখানেই তাঁর কাহিনি ‘সাবলটার্ন’ বাঁক নিল বলে মনে করেন কেউ কেউ।
অথচ দীন দয়াল তো মোটের উপর তাঁর সময়ের প্রধান ক্ষমতা-কাঠামোর সহযোগে, অনেক সময় তাকে কাজে লাগিয়েই সাফল্য অর্জন করেছেন। ব্রিটিশ রাজ ও ভারতীয় রাজন্যদেরই ছবি তুলেছেন তিনি, ব্রিটিশ বা ভারতীয় সমাজের শীর্ষ স্তরের মানুষ তাঁর পৃষ্ঠপোষক ছিলেন (ইনদওর-এর মহারাজা দ্বিতীয় তুকোজি রাও থেকে হায়দরাবাদের ষষ্ঠ নিজাম মেহবুব আলি খান, ভাইসরয় থেকে ভারত-সম্রাজ্ঞী), তাঁদের জন্য যে কাজ তিনি করেছেন তার অধিকাংশটাই স্থিতাবস্থার পোষক। আবার তিনি ব্রিটিশ ও ভারতীয়— দুই সমাজেই অত্যন্ত স্বচ্ছন্দে চলাফেরা করেছেন, শুধু তা-ই বা কেন, শ্রেণি-বর্ণ-সংস্কৃতি নির্বিশেষে নানা জগতেই যে তাঁর গতায়াত অবাধ ছিল, তা-ও তো সত্যি। অভিজাত সম্প্রদায়ের পৃষ্ঠপোষণায় সন্তুষ্ট হয়ে বসে থাকেননি তিনি। কারিগরি উন্নতির দিকে তীক্ষ্ণ নজর রেখেছেন, প্রয়োজন মতো লেন্স তৈরি করিয়ে এনেছেন বিলেত থেকে। প্রচার ও ব্যবসার নতুন নতুন পথ খুঁজে বার করার চেষ্টা করেছেন সব সময়। দেশবিদেশে নানা প্রদর্শনীতে ছবি পাঠাতেন দীন দয়াল, পুরস্কারও পেয়েছেন। ইংরেজি সংবাদপত্র পর্যন্ত তাঁর কাজের স্বীকৃতি দিয়েছে। বিলেতের পত্রিকায় (‘দ্য গ্রাফিক’, ‘ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট’) তাঁর ছবি প্রকাশিত হয়েছে। এক দিকে ভারতীয় চিত্রাঙ্কনের ধারাবাহিকতায় ছবি রঙ করা, বিশেষ করে অনেক বড় আকারের প্রতিকৃতিচিত্র তৈরি করা (এক সময় দীন দয়ালের স্টুডিয়োয় এই কাজের জন্য ২৯ জন শিল্পী ছিলেন), আবার বড় প্রিন্ট বা অর্ডারমাফিক অ্যালবাম বিক্রির পাশাপাশি ৫ টাকা দামের ছোট ছোট ছবির পুস্তিকাও বিক্রি করেছেন, যেখানে ছবি দীন দয়ালের, লেখা হেনরি হার্ডি কোল-এর, আর ছাপা অটোটাইপ কোম্পানির। অর্থাৎ ক্রেতার চাহিদা মাথায় রেখে ব্যবসা ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা অবিরতই করেছেন দীন দয়াল। ইনদওর, সেকেন্দরাবাদ, হায়দরাবাদ ও মুম্বইয়ে রাজা দীন দয়াল অ্যান্ড সন্স-এর চারটি স্টুডিয়ো সেই বিপুল কর্মকাণ্ডের সাক্ষী।
১৯০৩-এর দিল্লি দরবার-এর ছবি তোলার জন্য দুটি অস্থায়ী স্টুডিয়ো খুলেছিলেন দীন দয়াল। অজস্র ছবি তোলা হয় এই দরবারে, তৈরি হয় ব্যয়বহুল ‘করোনেশন অ্যালবাম’। কিন্তু নিজাম-এর পৃষ্ঠপোষণা এই খরচ পোষাতে পারেনি। সময়টা জটিল, ক্যামেরা সাধারণের হাতের নাগালে চলে আসছে, আস্তে আস্তে ঢুকছে ‘ফিল্ম’ প্রযুক্তি। দুই ছেলে ধ্যানচন্দ ও ধর্মচন্দ প্রয়াত, স্ত্রীও চলে গেলেন। অসুস্থ দীন দয়াল তারপর অল্প দিনই বেঁচেছিলেন। হায়দরাবাদের স্টুডিয়ো অবশ্য কাজ করেছে আরও অনেক দিন।
জীবৎকালেই তিনি কিংবদন্তি আলোকচিত্রী, নিজামের দেওয়া খেতাব অনুযায়ী ‘রাজা বাহাদুর মুসাভির জঙ্গ’। দেশবিদেশের বহু সংগ্রহে ঠাঁই পেয়েছে তাঁর ছবি। ইন্দিরা গাঁধী ন্যাশনাল সেন্টার ফর দি আর্টস সংগ্রহ করেছে তাঁর প্রায় তিন হাজার গ্লাসপ্লেট নেগেটিভ, স্টুডিয়ো রেজিস্টার ইত্যাদি। আলকাজি সংগ্রহে আছে তাঁর বহু ছবি। এই সব মিলিয়েই দীন দয়ালকে খুঁজতে চেয়েছেন দুই গবেষক দীপালি দেওয়ান এবং ডেবোরা হাটন। দীন দয়ালের ছবির মাধ্যমে তাঁর জীবনের পর্ব থেকে পর্বান্তরে ঘুরেছেন তাঁরা। দীন দয়ালের মৃত্যু পর্যন্ত তাঁর স্টুডিয়ো যে হাজার তিরিশ ছবি তুলেছিল, তার মধ্যে ঠিক কতটা দীন দয়ালের তোলা তা বলা কঠিন। আলোকচিত্র ‘শিল্পী’ হিসেবে তাঁর যে মর্যাদা, তার প্রকৃত মূল্যায়ন এখনও তাই অনেকটা গবেষণার অপেক্ষায়। শুধু আলোকচিত্র নয়, ঔপনিবেশিক আধুনিকতা ও উনিশ শতকে ভারতের ইতিহাস বোঝার জন্যই দীন দয়ালকে আরও ভাল করে বোঝা দরকার, এ কথা যথার্থ ভাবেই মনে করালেন দীপালি দেওয়ান ও ডেবোরা হাটন।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.