|
|
|
|
স্টাফরুমের পরিবেশ হওয়া দরকার ক্লাসরুমের মতোই
আনন্দবাজারকে একান্ত সাক্ষাৎকারে বললেন শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু। |
ভাল শিক্ষক কে?
পাঠ্য বিষয়টি যিনি পাঠ্যবই ছাড়াই শেখাতে পারেন, তিনিই ভাল শিক্ষক। আমার ছাত্র জীবনের অভিজ্ঞতা বলে, বই দেখে পড়ানো আর না-দেখে পড়ানো, এই দুয়ের মাত্রা আলাদা।
কিন্তু অনেক শিক্ষক পাঠ্যবই পড়ানো শেষ করতেই বেশি আগ্রহী। পড়ুয়ারা লিখতে-পড়তে শিখছে কি না, নজর করছেন না।
পাঠ্যবইটা ছাত্রদের পড়তেই হবে। তবে পড়ানোর পদ্ধতি এমন হওয়া দরকার যাতে বিষয়টা ছাত্ররা আত্মস্থ করতে পারে।
শিক্ষকদের পড়ানো আর ছাত্রদের শেখা, এই দুইয়ের মধ্যে কোথায়, কতটা ফাঁক থেকে যাচ্ছে, তা বুঝতে একটি সমীক্ষা হচ্ছে। ‘ASER’ রিপোর্ট যাঁরা প্রকাশ করেন, সেই ‘প্রথম’ সংস্থা কাজ শুরু করেছে উত্তর ২৪ পরগনায়। প্রতিটি শ্রেণি ধরে ধরে সমীক্ষা হচ্ছে। একে আমরা বলছি, ‘উৎকর্ষ অভিযান।’ সমীক্ষার ফল হাতে এলে বুঝতে পারব, পাঠক্রম, পাঠ্যবই কিংবা পাঠদানে কী সমস্যা থেকে যাচ্ছে।
কে ভাল শিক্ষক, কে মন্দ, তা কী করে জানবে শিক্ষা দফতর?
আমরা জেলায় জেলায় ১৫ জনের স্কুল ইনস্পেকশন কমিটি তৈরি করেছি। অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকরা তার সদস্য। হঠাৎ গিয়ে তাঁরা স্কুল পরিদর্শন করবেন। ছাত্রদের শিক্ষার মানও তাঁরা দেখবেন। কোনও শিক্ষক যত্ন নিয়ে ছাত্রদের পড়াচ্ছেন কি না, তা ছাত্রদের শিক্ষার মান, স্কুলে নিয়মিত আসা, স্কুলে আসতে ভাল লাগা, এ সবের মধ্যেই প্রতিফলিত হবে। আশা করছি, এই হঠাৎ-পরিদর্শনে আমরা শিক্ষকদের ক্লাসে থাকাটুকু অন্তত নিশ্চিত করতে পারব। |
হ্যাপি টিচার্স ডে। ছবিটি এঁকেছে সায়ক হালদার, আদিত্য অ্যাকাডেমি স্কুলের তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র। |
এক ২৩-২৪ বছরের তরুণ বা তরুণী স্কুলে পড়াতে এল। কেরিয়ারে কী উন্নতি সে আশা করতে পারে?
আমি প্রস্তাব দিয়েছি, কলেজের অধ্যাপকদের মতো স্কুলের শিক্ষক এবং অশিক্ষক কর্মচারীদেরও ‘গ্রেডেশন’ চালু করা হোক। কাজের মানের ভিত্তিতে প্রমোশন হবে। শিক্ষকরা ‘পারফর্ম্যান্স’ বা কাজের ভিত্তিতে ভাতার একটি অংশ পাবেন, এই প্রস্তাব কার্যকর করার চেষ্টা করছি।
শিক্ষামন্ত্রী হিসেবে শিক্ষকদের জন্য আপনি কী করতে পেরেছেন?
একটা জগদ্দল পাথর নাড়ানোর চেষ্টা করছি। বোঝাতে চাইছি, ক্লাসে পড়ানোটা দরকার। স্কুলে এমন পরিবেশ দরকার, যেন শিক্ষকের মনে হয়, ‘আমি পড়াতে এসেছি।’ মাস্টারমশাইদের জন্য আলাদা ‘কিউবিকল’ চাই, যেখানে তাঁরা চক-ডাস্টার, বই-খাতা রাখতে পারেন। শিক্ষকরা স্বভাবত ফাঁকিবাজ, তা মনে করি না। কিন্তু অনেক স্কুলে ক্লাসরুমের পরিবেশ আর স্টাফরুমের পরিবেশ আলাদা। সেটা কেন হবে? ভাল শিক্ষার জন্য ক্লাসরুম যত গুরুত্বপূর্ণ, স্টাফরুম ততটাই। আমি জানি, বহু স্কুলে স্টাফ রুম খারাপ, অনেক স্কুলে তা নেই। এগুলোই বদলানোর চেষ্টা করছি।
|
শিক্ষকের মূল্যায়ন করতে পারে ছাত্র, অভিভাবকরাই |
শিক্ষকদের জীবন, চরিত্র ও নৈতিকতাই মূল্যায়নের মাপকাঠি হওয়া উচিৎ। এখন বেশিরভাগ শিক্ষক মুখে ভাল কথা বলছেন, কিন্তু আচরণ ঠিক তার উল্টো। একই অপরাধে এক ছাত্রকে কম শাস্তি দিচ্ছেন, অন্যকে বেশি। শিক্ষককের চরিত্রে এই বৈষম্য কাম্য নয়। কারও কাছে শ্রদ্ধা আশা করলে, অন্যকেও একই ভাবে সম্মান জানাতে হবে। বিবেকানন্দের কথা মেনে একজন শিক্ষকের চরিত্র ও নৈতিকতাই আদর্শ হওয়া উচিত।
স্বামী পরাশরানন্দ। অধ্যক্ষ, মালদহ রামকৃষ্ণ মিশন আশ্রম। |
|
ডিগ্রি থাকলেই ভাল শিক্ষক হওয়া যায় না। প্রথমেই দেখতে হবে একজন শিক্ষকের কাছ থেকে সমাজ ও ছাত্রছাত্রীরা কী পাচ্ছে। একজন শিক্ষকের শিক্ষকসুলভ আচরণ থাকা প্রয়োজন। শিক্ষা থেকে ছাত্রছাত্রীরা শিক্ষকের কাছে নেওয়া পাঠ থেকে উৎসাহ পেতে হবে। একজন শিক্ষকের সময়ানুবর্তিতা থাকা প্রয়োজন, চারিত্রিক দিকটাও ভাল হওয়া প্রয়োজন। এগুলিও শিক্ষকের মূল্যায়নের মাপকাঠি হওয়া উচিত।
মলয়কান্তি রায়। শিক্ষক, কোচবিহার জেনকিন্স হাইস্কুল। |
|
আমাদের স্কুলে শিক্ষকদের স্বমূল্যায়ন ফর্ম পূরণ করতে হয়। তবে সারপ্রাইজ ভিজিট, অ্যানুয়াল ইনস্পেকশনের ব্যবস্থা থাকায় প্রত্যেক শিক্ষকের কাজ সম্পর্কে নজরদারি চলে। রয়েছে টিচার্স ডায়েরি। তাতে এক জন শিক্ষক গোটা সপ্তাহে কী কী পড়াবেন তা আগাম লেখা থাকে। প্রিন্সিপাল প্রতি মাসে শিক্ষকদের সঙ্গে মিটিং করেন, প্রয়োজনীয় মতামত-নির্দেশ দেন। শিক্ষকদের বিশেষ কোর্স করতে হয়। দক্ষতা প্রমাণে দিতে হয় পরীক্ষা।
স্বপনকুমার দাস। কেন্দ্রীয় বিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষক |
|
ছাত্রছাত্রীরা ভাল ফল করলে সেটাই শিক্ষক-শিক্ষিকাদের কাজের মূল্যায়ন। তবে কেবল পরীক্ষার ফল দিয়েই তা বিচার করলে হবে না। কোনও ছাত্রছাত্রী জীবনে বড় হয়ে দাঁড়াতে পারলে সেটাই শিক্ষক-শিক্ষিকাদের সব চেয়ে বড় পাওয়া। সাম্প্রতিক কালে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের গায়েও হাত তোলা হচ্ছে। এ ধরনের ঘটনা ব্যথিত করে। মূল্যায়নের ক্ষেত্রে এই সব বিষয়েই গুরুত্ব দেওয়া উচিত।
শেফালি মজুমদার। প্রধান শিক্ষিকা, শিলিগুড়ি গার্লস স্কুল |
|
শিক্ষকদের সঠিক মূল্যায়ন করতে পারে ছাত্ররাই। তাদের সঙ্গে আলাদা করে কথা বললেই অনেক কিছু পরিষ্কার হয়ে যাবে। কথা বলা যেতে পারে অভিভাবক এবং সহ-শিক্ষকদের সঙ্গেও। আসলে গোটা প্রক্রিয়ায় সকলেরই একটা ভূমিকা থাকে। এ ক্ষেত্রে আলাদা করে কোনও স্কুল কর্তৃপক্ষ নয়, স্কুল শিক্ষা দফতর উদ্যোগী হলেই ভাল। তারা যদি নির্দিষ্ট নিয়ম-নির্দেশিকা বানিয়ে দেয়, তবে তা মেনেই শিক্ষকদের মূল্যায়ন হবে।
অমল আচার্য। শিক্ষক, বাঁকুড়া জেলা স্কুল |
|
|
|
|
|
|
|