|
|
|
|
শিক্ষারত্নে সম্মান পশ্চিমের ১০ শিক্ষককে |
নিজস্ব প্রতিবেদন |
স্কুলে গিয়ে দেখেন, স্কুল কোথায়? এ তো, খোলা মাঠ! পর দিনই জেলা স্কুল পরিদর্শকের অফিসে এসে ঘটনাটি জানালেন। স্কুল পরিদর্শকের অফিস থেকে জানিয়ে দেওয়া হল, “কোনও স্কুল-বাড়ি নেই, জানি তো। সবই আপনাকে করতে হবে।” ‘করতে হবে’, বলা যতটা সহজ, করা যে ততটা নয়, তা সকলেরই জানা ছিল। যদি না-ই হত, তা হলে কী আর খোলা মাঠে স্কুল চলে? খোলা মাঠে চালাঘর তৈরি করলেন নিজেদের মাইনের টাকা দিয়ে। পরে প্রশাসনিক সাহায্যে চালাঘর সম্প্রসারিত হল। আরও পরে সরকারি সাহায্যেই গড়ে উঠেছিল মেদিনীপুর শহরের টিভি টাওয়ার মাঠের কাছে বঙ্কিম স্মৃতি প্রাথমিক বিদ্যালয়। শিক্ষারত্ন পুরস্কারের জন্য মনোনীত হওয়ার পর থেকেই বারবার একথাই মনে পড়ছে বঙ্কিম স্মৃতি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক শেখ গোলাম কিবরিয়ার। তাঁর কথায়, “কী জন্য আমাকে পুরস্কারের জন্য মনোনীত করা হয়েছে তা জানি না। তবে বুঝতে পারছি, খোলা মাঠ থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে একটি সঠিক রূপ দিতে পারার জন্যই হয়তো পুরস্কৃত করা হয়েছে।”
পঠন-পাঠন তো রয়েছেই, তার বাইরে বেরিয়ে বিভিন্ন ক্ষেত্রে যাঁরা শিক্ষকতা নামক পেশাটিকে অন্য মাত্রায় নিয়ে যেতে পেরেছেন তাঁদের শিক্ষারত্ন পুরস্কার দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। গোলাম কিবরিয়ার মতোই পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার দশ জন শিক্ষক এই পুরস্কার পাচ্ছেন। তাঁদের ৫ জন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ও ৫ জন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের। আজ, বৃহস্পতিবার বিকেলে নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে রাজ্যের ১০০ জন শিক্ষক-শিক্ষিকাকে ‘শিক্ষারত্ন’ সম্মান প্রদান করবেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। |
শেখ গোলাম কিবরিয়া |
সুধাংশুশেখর মাহাতো |
চন্দনি সরেন |
বনমালী পাল |
সুবলচন্দ্র মণ্ডল |
|
অরুণকুমার ঘোষ |
চিত্তরঞ্জন মাইতি |
ওবাইদুল্লাহ খান |
আত্রেয়ী দত্ত |
|
—নিজস্ব চিত্র। |
|
শিক্ষারত্ন প্রাপকদের মধ্যে রয়েছেন ঝাড়গ্রাম ব্লকের চন্দ্রি চন্দ্রশেখর হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলের প্রধান শিক্ষক ৫৯ বছরের সুধাংশুশেখর মাহাতো। সুধাংশুবাবু নিজেই ওই স্কুলের প্রাক্তন ছাত্র। ফলে, স্কুলের প্রতি তাঁর নাড়ির টান। বাংলায় এমএ এবং বিএড সুধাংশুবাবু ১৯৮০ সালে নিজের স্কুলে প্রথমে সহ শিক্ষক পদে যোগ দেন। কিছু দিনের মধ্যেই স্কুলশিক্ষা দফতরের উচ্চ আধিকারিকের পদে চাকরির সুযোগ এলেও তিনি তা নেননি, শুধুমাত্র নিজের স্কুলে থাকবেন বলে। ১৯৯৬ সালে ওই স্কুলেরই প্রধান শিক্ষক হন সুধাংশুবাবু। তিলে তিলে নিজের স্কুলকে পরিকাঠামোগত দিক থেকে এবং পঠনপাঠনের উন্নয়নে ঝাড়গ্রাম ব্লকের অন্যতম সেরা স্কুল হিসেবে গড়ে তুলেছেন। ছুটির দিনে সুধাংশুবাবু নিজেই এলাকার গ্রামে গ্রামে গিয়ে অভিভাবকদের নিয়ে সভা করেন। এর ফলে এলাকায় স্কুলছুটের সংখ্যা কমেছে। পড়াশুনার পাশাপাশি, বিভিন্ন সেবামূলক কাজে ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে নিয়মিত যোগ দেন ওই প্রবীণ শিক্ষাব্রতী। বাল্য বিবাহ রোধ করতে স্কুলে অভিভাবক ও পড়ুয়াদের নিয়ে নিয়মিত সেমিনার এবং আইনি সচেতনতা শিবির করে থাকেন তিনি। সুধাংশুবাবুর বক্তব্য, “এই সম্মান কেবল আমার একার নয়। সহকর্মী, এলাকাবাসী ও অগণিত ছাত্রছাত্রীরাও এই সম্মানের শরিক।”
বিনপুরের আউলিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহ-শিক্ষিকা ৫৩ বছরের চন্দনি সরেন-ও এ বার শিক্ষারত্ন পাচ্ছেন। মাধ্যমিক উত্তীর্ণ হওয়ার পর অভাবের সংসারে পড়াশুনা বন্ধ করতে বাধ্য হন চন্দনিদেবী। তখনই শপথ নিয়েছিলেন, কোনও দিন সুযোগ পেলে শিক্ষকতা করবেন। স্কুলছুটের সংখ্যা কমাবেন। তাই পুলিশের চাকরি পেলেও যোগ দেন নি। বিয়ের পর শিক্ষকতাকেই পেশা হিসেবে বেছে নেন। ’৯১ সালে আউলিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষিকা পদে যোগ দেন। চন্দনিদেবীর বাড়ি শিলদার মাহুতডাঙা গ্রামে। পড়াশুনার পাশাপাশি, শিশুদের মনের বিকাশ ঘটানোর জন্য যোগাসন, নাচ, গান ও খেলাধুলোর উপর বেশি জোর দেওয়া উচিত বলে মনে করেন চন্দনিদেবী। চন্দনিদেবীর প্রচেষ্টায় প্রাথমিক স্কুলস্তরের ক্রীড়ায় প্রতি বছর ভাল ফল করে তাঁর স্কুলের পড়ুয়ারা। তিনি নিজেও খেলাধুলায় পারদর্শী। চন্দনিদেবীর বক্তব্য, “এই পুরস্কার আমার দায়িত্ব আরও বাড়িয়ে দিল।”
ধরা যাক, চিত্তরঞ্জন মাইতির কথা। তিনি পিংলা ব্লকের পিএন বিদ্যাপীঠের বাংলার সহ-শিক্ষক ছিলেন। চলতি বছরেরই জুন মাসে অবসর নিয়েছেন। স্কুলে পড়ানোর সঙ্গেই পণপ্রথা বিরোধী সভাতে যোগ দিয়েছেন, মাদক বিরোধী অভিযান চালিয়েছেন, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখতে আলোচনা সভাও করেছেন। এমনকী ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে বেতারে শিক্ষামূলক অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছেন, যোগ দিয়েছেন নাটক বিষয়ে দূরদর্শনের আলোচনাতেও। পঞ্চম শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণির জন্য বিভিন্ন পাঠ্যবই লিখেছেন। পটুয়াদের জীবন, পটচিত্র নিয়ে বই লিখেছেন, যার নাম ‘প্রসঙ্গ-পট, পটুয়া, পটসঙ্গীত’। লোকসংস্কৃতি নিয়ে তাঁর গবেষণাধর্মী বই হল, ‘বাংলা লোকসঙ্গীতে লোকজগত’।
এঁদের মতোই শিক্ষাজগতে বর্ণময় চরিত্রেরা হলেন, মাধ্যমিকে আত্রেয়ী দত্ত, গৌরীশঙ্কর মাইতি, মহম্মদ ওবাইদুল্লাহ খান। আর প্রাথমিকে অরুণকুমার ঘোষ, বনমালী পাল ও সুবল চন্দ্র মণ্ডল। আত্রেয়ীদেবী দাঁতনের পুঁয়া পদ্মলোচন কন্যা বিদ্যাপিঠের টিচার-ইন-চার্জ। তিনি আসার পর স্কুলের পঠনপাঠনের উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে হস্টেল নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে। মালিগ্রামের ছোটখেলনা সুরেন্দ্র স্মৃতি বিদ্যামন্দিরের প্রধান শিক্ষক গৌরীশঙ্কর মাইতি তো পঠনপাঠনের পাশাপাশি নাটকেও অভিনয় করেন, ছাত্রদের আবৃত্তি শেখান, খেলাধুলোতেও ঝোঁক রয়েছে তাঁর। খইরুল্লাচক নেতাজী বিদ্যামন্দিরের প্রধান শিক্ষক ওবাইদুল্লা খান প্রথমে একটি মাদ্রাসার পত্তন করেছিলেন। সেই সূত্রে সেই মাদ্রাসার প্রধান হিসাবেই ছিলেন। পরবর্তীকালে খইরুল্লাচকে প্রধান শিক্ষক হিসাবে যোগ দেন। শিক্ষকতার পাশাপাশি হোমিওপ্যাথি চিকিৎসাতেও হাতযশ রয়েছে তাঁর।
রসকুণ্ডু প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক অরুণকুমার ঘোষও স্কুল পরিচালনার পাশাপাশি এলাকার নানা উন্নয়নমূলক কর্মসূচীতে যুক্ত থাকেন। ক্ষীরপাইয়ের পাহাড়িপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বনমালী পাল উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন। সেই সময়ই বাড়ির পাশে শিক্ষা প্রসারের উদ্দেশ্যে একটি স্কুল তৈরি করেন এলাকার মানুষ। অবৈতনিক শিক্ষক হিসাবে তিনিও সেখানে যোগ দিয়েছিলেন। পরে স্কুলটির সরকারি অনুমোদন মেলায় তিনিও শিক্ষক হিসাবে থেকে যান। তাঁর আবার সঙ্গীত চর্চাতেও ঝোঁক রয়েছে। ছেড়ুয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক সুবলচন্দ্র মণ্ডলের গ্রামীণ এলাকার মানুষের সঙ্গে যোগ বরাবরের। এলাকার মানুষ সমস্যায় পড়লেই এগিয়ে যান। রোগগ্রস্ত হলে চিকিৎসায় সাহায্য করেন। তাঁর কথায়, “আমাদের মতো গ্রামীণ শিক্ষকেরা কত কষ্টে কাজ করে যায়, তা অনেকেই জানেন না। যাঁরা এত দিন ‘দূরের লোক’ ছিলেন তাঁদের জন্য সরকার পুরস্কারের ঘোষণা করায় ভাল লাগছে। এই সম্মান শিক্ষকদের আরও উৎসাহিত করবে।” জেলা বিদ্যালয় পরিদর্শক (মাধ্যমিক) সংঘমিত্র মাকুড় বলেন, “একটি জেলা থেকে ১০ জন শিক্ষক পুরষ্কার পাচ্ছেন, এটাই আমাদের বড় প্রাপ্তি। আমি চাই, ভবিষ্যতে শিক্ষকেরা আরও ভাল কাজ করুক। আরও বেশি শিক্ষক, পুরস্কারের জন্য মনোনীত হোক।” |
|
|
|
|
|